আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজয় তোমাকে বিনম্র অভিবাদন

বিজয় তোমাকে বিনম্র অভিবাদন "আজ নেই বর্গী নেই ইংরেজ নেই পাকিস্তানী হানাদার, আজও তবু আমার মনে শূন্যতা আর হাহাকার? আজও তবু কি লাখো শহীদের রক্ত যাবে বৃথা? আজও তবু কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা?" এই কথাগুলো একজন শিল্পীর, কিন্তু প্রশ্নবোধক হয়ে বিদ্ধ করছে আমার মত কোটি কোটি মানুষের বক্ষ! আজ বিজয়ের দিন আমি লিখতে বসে বারবার হতাশার কথা আসছে, বারবার বিদগ্ধ মনটা মুচড়ে উঠছে, কিন্তু কেন? কার কাছে তার উত্তর আছে? বাংলাদেশ এখন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত, স্বাধীন একটি দেশ, সে দেশে ৪১ বছর পর আজো গাইতে হয় এমন গান! আজ ১৬ ডিসেম্বর । বাঙালির বিজয় শব্দটার মধ্যে অর্ন্তনিহত রয়েছে আমাদের বিশ্বাস, ত্যাগ, রক্ত, স্বজন এবং সম্ভ্রম হারানোর বিষাদময় অবক্ষয়ের একটি দলিল আর বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অধ্যায়। আমরা আজ ৪১ বছর পরও বিজয়ের আনন্দে আন্দোলিত হই, আমরা যূথবদ্ধ হই উৎসব আনন্দে। কিন্তু ইতিহাসের পর্যালোচনায় আমরা কতটুকু তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারছি? প্রশ্নটা এখন আমাদের মাঝে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এবং বিষধর ফলার মত বিদ্ধ করে; এক চল্লিশ বছর পর আমাদের উত্তরসূরি অথবা বর্তমান প্রজন্মের জন্য কতটা ফলপ্রসূ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে, সেটাই আজ ভাববার বিষয়! মহান বিজয়ের পটভূমিকে নির্মল ইতিহাস পর্যালোচনায় নৈতিকভাবে তার যথার্থ মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বিবেচিত করতে পারছিনা কেন? বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস বলতে আমরা রক্ত আর যুদ্ধের ভেতর দিয়েই অর্জন করেছি আমাদের স্বাধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের সর্বশেষ অর্জন ভৌগলিক সীমানা। শত শত বছরের ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই আমাদের রক্তক্ষয়ী বীরত্বের ইতিহাস, কিন্তু আজ যেন ধীরে ধীরে রূপকথার উপাখ্যানে পরিণত হচ্ছে! পৃথিবীতে নানা সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালি ও বাংলা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য যে দিক নির্দেশনার পরিচয় বহন করে।

সেটা কি আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি না? আমরা আমাদের ইতিহাসকে বিপর্যস্ত করছি, অপমান করছি! বিজয়ের মাসে একজন একজন বিশ্বজিতের মৃত্যুর মধ্যদিয়েই গৌরবের মাসকে আবারো রক্তাক্ত করছি! এমন ধিক্কার আমরা কাকে দেবো? বাংলার অর্থনীতি, শিল্প আর বাণিজ্যকে ধ্বংস করেছিল ব্রিটিশ বেনিয়ারা সাথে সাথে তারা বাঙালি সংস্কৃতির অবকাটামোকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। আমরা বারবার বাংলাভাষা, কৃষ্টি আর স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে অস্ত্রের মুখামুখি হয়েছি, প্রতিনিয়ত আমাদের সংগ্রাম আর যুদ্ধ চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। অথচ এক সময় বাংলার অর্থনীতি আর শিল্প-বাণিজ্যকে আকৃষ্ট করেছিল পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার লিপিবদ্ধ করেছিলেন বাংলার শিল্প-বাণিজ্যের ইতিহাস। ব্রিটিশরা বাংলা দখল করার একশো বছর আগে ১৬৫৮ সালে ভারতবর্ষে এসেছিলেন ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার, ১২ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন ভারতবর্ষে একজন চিকিৎসক হিসাবে। সুযোগ পেয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের হেরেমে প্রবেশের এবং সাথে সাথে পেয়েছিলেন ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার অনুমোদন।

ক্ষমতার লড়াই তিনি কাছ থেকে দেখেছেন, শুধু তা-ই নয়, একজন ইউরোপীয় হিসেবে তৎকালীন ভারতবর্ষকে দেখেছেন নতুন এক দৃষ্টিতে। সাথে সাথে এসেছিলেন বাংলায়ও, তারপর দেশে ফিরে তাঁর ভারতীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন 'ট্রাভেল ইন দ্য মুঘল এম্পায়ার'। তিনি লিখেছেন, “বাংলার মত পৃথিবীর অন্য কোথাও বিদেশী বণিকদের আকৃষ্ট করার জন্য এত বেশী রকমের মূল্যবান সামগ্রী দেখা যায় না... বাংলায় এতো বিপুল পরিমাণ সূতী ও রেশমি পণ্যসামগ্রী রয়েছে যে, কেবল হিন্দুস্থান বা মোগলদের সাম্রাজ্যের জন্য নয় বরং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এবং ইউরোপের বাজারসমূহের জন্য বাংলাকে এ দুটি পণ্যের সাধারণ গুদামঘর বলে অভিহিত করা চলে। আমি মাঝে মাঝে বিস্ময়াভিভূত হয়েছি যে, কেবলমাত্র ওলন্দাজ বণিকেরা বিভিন্ন প্রকারের ও মানের সাদা এবং রঙ্গিন সুতিবস্ত্র বিপুল পরিমাণে, বিশেষ করে জাপান ও ইউরোপে রফতানি করে থাকে, তা নয়। ইংরেজ, পর্তুগীজ ও দেশীয় বণিকেরাও এসব দ্রব্য নিয়ে প্রচুর ব্যবসা করে থাকে...” বাংলা ছিল বরাবরই ঈর্ষণীয় অবস্থানে এবং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানীদের কাছেও বাংলা ছিল সমান ঈর্ষা এবং লোভনীয় ভূখণ্ড।

যার পরিপ্রেক্ষিতে দিতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মাহুতি। বাংলা ভাষা ও একটি সার্বভৌম ভূখণ্ডের জন্য পাকিস্তানীদের বিপক্ষে বাঙালিদের সর্বাত্মক বিসর্জনের মাধ্যম বিজয় ছিনিয়ে আনা একটি ঐতিহাসিক অর্জন। সেদিন একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল নিতান্তই নিরস্ত্র বাঙালিরা কিন্তু আত্মায়-প্রাণে ছিল দেশ ও জাতির জন্য অপূর্ণ ভালবাসা আর নেতৃত্বের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা যার বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস রক্ত-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়ের লাল সূর্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়কর বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। এই বিজয়কে কেন্দ্র করে বাঙালির অহংকার! আজ সেই বিজয়ের দিন।

সেই মহান বিজয়ের আজ ৪১তম ঐতিহাসিক বিজয় বার্ষিকী। দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ ৪১ বছর পরেও যেন আমাদের সংশয় থেকেই যাচ্ছে, আমরা বিজয়ের মহিমাকে ধারণ করতে পারছিনা, দিনটিকে আমাদের নিতান্তই কঠিন অবক্ষয় আর হতাশার ভেতর দিয়ে স্মরণ করতে হয় । ডিসেম্বর আসলেই আমাদের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভাজিত হয় বাংলাদেশ ও বাঙালির হৃদয়-প্রাণ। আমরা বিজয়ের পরম তৃপ্তি বা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারিনা! এখনো আমাদের শরীরে বিসর্জিত রক্তের দাগ, আমরা মুছতে পারছিনা! আমাদের উপর এখনো পাশ্চাত্যের বিভ্রান্তিকর রাহুগ্রাসের হিংস্র ছোঁবল উৎ পেতে আছে, বাঙালিকে দ্বি-খণ্ডিত করে রাখছে প্রতিনিয়ত! পলাশীর সেই যুদ্ধ আর বিপর্যয়ের মূল নায়ক মীর জাফর আর জগৎশেঠকে আমরা কোথায় পাবো? কিন্তু গোলাম আজম আর নিজামীরা আমাদের মাঝেই বীরত্বের মহান গর্বে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে- আমরা মীর জাফর আর জগৎশেঠের বংশধর আমরা এখনো আছি, আমরা থাকবো। আমাদের কেউ কিছুই করতে পারবেনা।

এবং তাই হচ্ছে, এখনো বাংলার মাটি ও ঘাস বিশ্বজিতদের রক্তে রাঙা হয়। বাংলাদেশ আজো ষড়যন্ত্রের স্বীকার! কারা করছে এই ষড়যন্ত্র, কেন করছে? বিবেকের কাছে আমরা ধারস্থ হলে তার উত্তর পাওয়া যাবে.. কিন্তু আমরা বিবেকবর্জিত বাঙালিয়ানার পরিচয় দিচ্ছি দিনের পর দিন..। সংগ্রাম, যুদ্ধ, লুঠতরাজ আর সম্ভ্রমহানির মধ্যদিয়ে অর্জিত বিজয়কে আমরা এখনো মূল্যায়ন করতে পারছিনা। আমরা যেন আমাদের ঐতিহ্যকে ঠিকয়ে রাখতে পারছিনা। এখনো আমাদের ভেতরে শঙ্কা, ভয় আর ভীতি! বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকার সংস্থার সার্বক্ষণিক এবং যে সর্বশেষ জরিপের উদ্বেগের কথা যদি আমরা দেখি, যেমন; "Bangladesh was created because of human rights violations. After the victory of the Awami League in Pakistan’s first elections in 1970, the Pakistani Army brutally suppressed the aspirations of the Bengali people in East Pakistan leaving upwards of 3 million people dead, millions of women raped, tens of millions of people forced into squalid refugee camps in India... Bangladesh was free from the brutality of Pakistani rule but faced an almost impossible task to rebuild a country that was already desperately poor in a land prone to flooding and cyclones. Yet, Bangladesh has achieved much in its 40 years of independence. For that, we can only be grateful. But, unfortunately, Bangladesh continues to be wracked by human rights violations... This points to a broken policing system in the country, where the police act as vigilantes instead of police. Women bear the brunt of many human rights violations at the community level, where social norms prevent women from being able to access their full basic rights under international law. Finally, Bangladesh faces a catastrophe as rising sea levels due to climate change threatens the livelihood of millions. It's a country with a lot of promise, lots of it fulfilled, some still to fulfil." Human Rights Concerns আমাদের বিশ্বাস আমরা সত্যিকারের বিজয়ের স্বাদ নিতে পারবো একদিন..! আজ এই বিজয়ের দিনে স্মরণ করি ৩০ লাখ শহীদদের, স্মরণ করি লাঞ্চিত মানুষদের আর সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন ভুখন্ডকে বাংলাদেশ বলতে পারছি।

সাথে সাথে স্মরণ করতে হয় মিলন, নুরহোসেন সহ অসংখ্য প্রাণ, সর্বশেষ বিসর্জিত প্রাণ বিশ্বজিতকেও ! বর্তমান সরকার আওয়ামীলীগ সরকার, যে আওয়ামীলীগের ডাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, আজ সেই আওয়ামীলীগ সরকারই দেশ শাসনের মানদন্ড হাতে উপস্থিত, অথচ রাস্তায় আজো কেন আমাদের রক্ত দিতে হয়! একজন বিশ্বজিতকে কেন একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সময় জনসমুদ্রে প্রাণ দিতে হয়। আমরা জানি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে রোধতে আওয়ামীলীগ সরকারের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে কিন্তু সাথে সাথে সরকারের প্রতি আমাদের সর্বশেষ চাওয়া; মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয় এবং ৭১ এর রাজাকারদের শাস্তি যেন কার্যকর হয় যথার্থভাবে! বাঙালির স্বপ্ন যেন বাঙালিয়ানায় পূর্ণ হয়। বিজয়ের শুভেচ্ছা নিরন্তর... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।