অরুণালোক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “নারী” কবিতায় বলেছেন “সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ রমণীর কোন ভেদাভেদ নাই/বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর.....। ” কেননা, সমান বৈপরিত্য না থাকলে কোন সৃষ্টিই সার্থক নয়। আল্লাহ তা’লার সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দিলে এই বৈপরিত্য চোখে পড়ে। সমান বৈপরিত্য আছে বলেই স্রষ্টার সৃষ্টি এতো সুন্দর, এতো মনোরম। আলোর বিপরীতে আঁধার না থাকলে যেমন আলোর মূল্যায়ন হতো না, যোগের বিপরীতে বিয়োগ না থাকলে যেমন অঙ্ক নিরস হতো, তেমনি নারী না থাকলে পুরুষ হয়ে পড়তো মূল্যহীন, অথর্ব।
দশম হিজরিতে মহানবী (সাঃ) নারীদের অধিকার যাতে খর্ব না হয় সে ব্যাপারে পুরুষদের হুশিয়ার করে গেছেন। অথচ আমাদের দেশে সেই নারী সমাজ আজও অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত, নির্যাতিত। সমাজের অর্ধেক অংশকে দূরে ঠেলে দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি কখনো সম্ভব নয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরবর্তী সুবিধা বঞ্চিত, অনগ্রসর, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত নূর-উন-নাহার মেরী।
নূর-উন-নাহার মেরী অধিকার বঞ্চিত নারীদের একত্রিত করে “জাগো নারী ফাউন্ডেশন” নামে জাতীয় ভিত্তিক নারী ও মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
তিনি এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও চেয়ারপার্সন। এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আফ্রিকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এর এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, আদীব আহসান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ নাগরিক সমাজের কার্যনির্বাহী সদস্য (কেন্দ্রীয় কমিটি)।
নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় দেশের বাইরেও বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর সফর করেন এবং সেই সমস্ত দেশে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং মিডিয়ার সাথে বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে মত বিনিময় করে থাকেন। এই মহিয়সী নারীর জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ এপ্রিল জামালপুর জেলায়। তাঁর বাবা মরহুম এম. এন. ইসলাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লেফটেনেন্ট ছিলেন এবং মা তাহমিনা বেগম গৃহিনী। নূর-উন-নাহার মেরী করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, পরে ওসলো ইউনিভাসির্টি ও “নরওয়েজিয়ান শিপিং একাডেমির” যৌথ ব্যবস্থাপনায় (১৯৮৯-৯০) “প্রফেশনাল শিপিং” এর উপর উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে সফর করেন এবং এই সফরকালে নিউইয়র্ক ইথাকায় অবস্থিত “কর্নেল ইউনিভার্সিটি” থেকে “হায়ার লেবার লিডারশিপ” এর উপর ডিপ্লোমা লাভ করেন এবং ১৯৮৪ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় “ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট” সেন্টার থেকে জেনারেল ম্যানেজমেন্ট এর উপর ডিপ্লোমা করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে সহকারি মহা-ব্যবস্থাপক হিসাবে দীর্ঘদিন অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ২০০৩ সালে বিগত সরকার স্বেচ্ছায় অবসর আনতে বাধ্য করেন। নূর-উন-নাহার মেরীর স্বামী মোঃ আব্দুস সোবাহান একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সমাজ সেবক। বাংলাদেশের নারী সমাজের বর্তমান অবস্থান কি, এ বিষয়ে স¤প্রতি তার সাথে কথা বলেন বিবর্তন পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক তৈয়ব খান এবং তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন বিজ্ঞাপন নির্বাহী সাদেকুর রহমান।
বিবর্তনের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নূর-উন-নাহার মেরীর সাথে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু তুলে ধরা হলো।
বিবর্তন ঃ জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
নূর-উন-নাহার মেরী ঃ আপনাকে ধন্যবাদ। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। বিষয়টি আসলেই সত্য ও বাস্তব।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের জনগোষ্ঠির অর্ধেক নারী। এ অর্ধেক নারী যদি সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় না হয়, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অংশ গ্রহণ না করে তাহলে একটি উন্নত জাতি ও সমৃদ্ধ দেশ আশা করা যায় না। আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে যেটুকু জানি, ইসলাম ধর্মে নারীকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে অথচ বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একাবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভাল। তবে তাই বলে আমি বলবো না যে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছুতে পেরেছি। এখনেও আমাদের অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের নারীদের সত্যিকারের যেটা চিত্র, বিশেষ করে আমি বলতে চাচ্ছি, পারিবারিক নির্যাতনের হার আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হলো, আমাদের নারীদের আরও বেশি সচেতন ও স্বনির্ভর হতে হবে এবং আমাদের আত্ম উন্নয়ন করতে হবে। পুরুষের পাশাপশি প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের সমান অংশিদারিত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী সমাজ স্বাধীনতার পর থেকে অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম করে আজ এ পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি “১৯৯৭” যতদিন পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হবে, জাতিসংঘের “সিডো কনভেনশন” এর সবগুলো ধারা যতোদিন বাস্তবায়িত না হবে, ততোদিন পর্যন্ত আমরা বলতে পারি না যে, আমরা আমাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জন করেছি।
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নিকট আমাদের স্বনির্বন্ধ অনুরোধ যে জাতিসংঘের সিডো কনভেনশন কমিটিতে বর্তমানে একজন বাঙালি নারী ইসমত জাহান জাতিসংঘের বৈষম্য বিলুপ সংক্রান্ত কমিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। উনার অবস্থানকালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১৩ যদি বাস্তবায়িত হয় (১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির আদলে) তাহলে আমাদের দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম, আন্দোলন, সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা এখনও সংগ্রামরত, তবে আশাবাদি অন্ধকারের পথ পেরিয়ে একদিন আলোর মুখ দেখব। নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অনেক বাস্তবমুখী উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সেই আলোকে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় সরকার কর্তৃক গৃহীত সে সকল উদ্যোগ অদ্যাবধি কার্যকারিতা বয়ে আনছে না।
বিশেষ করে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রণীত আইনগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হয় না বিধায় আমরা আমাদের অগ্রযাত্রার পথে বারংবার বাধা প্রাপ্ত হচ্ছি।
বিবর্তনঃ সামাজিকভাবে বাংলাদেশের নারী এখনও অবহেলিত। এ থেকে উত্তরণের জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় বলে আপনি মনে করেন?
নূর-উন-নাহার মেরীঃ আমি একটু আগেও বলেছি, বাংলাদেশের নারীরা সামাজিকভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে এখনও অধিকাংশ নারী জানে না যে তাদের মৌলিক অধিকার কি, মানবাধিকার কি, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তাদের অধিকার মর্যাদা ও প্রাপ্যতা কি। তাদের এই অজ্ঞতাই তাদের পিছিয়ে পড়ার মুল কারণ।
এর থেকে উত্তোরণের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার তার মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে এবং আমাদের মতো যে সমস্ত নারী উন্নয়ন ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মূলক সংগঠন কাজ করছে এই সমস্ত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের সংঘবদ্ধ করে তাদের আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাবলম্বী করে গড়ে তুলার প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই নারীকে আমরা তার অধিকার মর্যদা ও প্রাপ্তির সমন্ধে জ্ঞান দান করতে পারি। একটি শিক্ষিত ও সচেতন নারীই পারে নিজের অধিকার মর্যাদা আদায়ের জন্য লড়াই, সংগ্রাম করতে। “প্রতিকার পাবো কি পাবো না তাই বলে প্রতিবাদ করবো না? তা হবে না তা হবে না। ” এই শ্লোগানে বিশ্বাসী হয়ে তাদের আত্মপ্রত্যয় দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়।
নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে মূলত পরিবার থেকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই নারীরা অধিক নির্যাতিত হয়ে থাকে, তারপর সেটা আসে সামাজিক ভাবে। এই সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়ার প্রধান উপায় হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ধর্মান্ধতা ও সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে নারীকে মুক্ত করতে হবে। “নারী শুধু নারী নয় নারীরাও মানুষ” “নারীর অধিকার মানবাধিকার” সমাজের পুরুষ ভাইদের এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে হবে এবং তাদের চেতনায় এ সত্যকে ধারণ করতে হবে, লালন করতে হবে এবং সংসার জীবনে তা প্রতিটি ক্ষেত্রে তা পালন করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সম্পুরক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয় “সে যুগ হয়েছে বাসি, যে যুগে পুরুষ ছিল নাকো দাস নারীরা আছিল দাসী”। আজ হতে এক শতাব্দী বছর পূর্বে নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘তুমি যে মানুষ সেটা কি তুমি বিশ্বাস করো? তুমি কি জানো পুরুষের সমকক্ষ কাজ তুমি করতে পারো? তোমাকে বাদ দিয়ে এ দেশ চলতে পারে না। ’ বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতের এ দর্শন অবলম্বন করেই আমাদের নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবে সকল প্রকাশ পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাবো।
বিবর্তনঃ স¤প্রতি আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ফলে ১১১জন পোশাক শ্রমিক দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কারখানাটি শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উপযোগী বা যথাযথ মান পালনকারী (কমপ্লায়েন্ট) ছিলো না এ কথা বলা হয়েছে। অথচ পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমই এ অগ্নিকা- পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন তাজরিন ফ্যাশন অত্যাধুনিক ও যথাযথ মান পালনকারী বা কমপ্লায়েন্ট। যতদুর জানা গেছে অগ্নিকা- সংঘঠিত হওয়ার সময় কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপদে বের হতে না দিয়ে বরং কারখানায় অবস্থান করে কাজ অব্যহত রাখার নির্দেশ দেন। ফলে অকালে এতগুলো প্রাণ ঝরে যায়। কথা হলো প্রতিষ্ঠানটি কতটুকু মান পালনকারী তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাজরিন ফ্যাশন কর্তৃপক্ষের দুরদর্শিতা।
এই প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
নূর-উন-নাহার মেরী ঃ ধন্যবাদ আপনাকে, এটি একটি সময়োপযোগী প্রশ্ন। এই প্রশ্নটির জন্য আমি আপনাদের কাছে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করতে নিজেও আগ্রহী। আশুলিয়া নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ফলে ১১১ জনের প্রাণহানী শুধু বাংলাদেশকেই নয় বরং সারা বিশ্বকে বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই যে ১১১ জন নিষ্পাপ প্রাণ আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেল এই মানুষগুলোর কি অপরাধ ছিলো? এরা তো নিজেদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এ সব প্রতিষ্ঠানে কাজে নিয়োজিত ছিল।
১১১ জন মানুষের অকাল মৃত্যুতে আজ ১১১টি পরিবারের মৃত্যু ঘটেছে বলে আমি মনে করি। প্রতিটি শ্রমিক তার প্রতিটি পরিবারের অন্য বস্ত্রের যোগানদাতা ছিল। এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ফলে তাদের মৃত্যু বরণ করায় এই ১১১টি পরিবারের সদস্যরা আজ দিশেহারা। এর চেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। পোশাক শিল্প জগতটি আমাদের বাংলাদেশের একটি বৃহৎ “রেভিনিউ আর্নিং সোর্স”।
এই শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অথচ এ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য দায়ী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক একটি চক্র বলে আমি মনে করি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কারখানাটি শ্রমিকদের কর্মোপযোগী নয় বলে উল্লেখ করেছে। যে সাধারণ অগ্নিকান্ডে এর ভয়াবহতা এতো বেশি হতে পারে না। এর জন্য প্রতিষ্ঠানটির মালিককে অবশ্যই দায়ভার নিতে হবে।
উনি যদি বলেন যে, না আমি দায়ী নই আমার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা দায়ী, তবে আমি বলবো, কর্মচারী কর্মকর্তা নয় বরং মালিক হিসাবে এটি উনারই দায়িত্ব যে, প্রতিষ্ঠানে কাজের উপযোগী পরিবেশ আছে কি না, দুর্ঘটনার সময় বিকল্প পথে বের হওয়ার সুব্যবস্থা আছে কি না এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিক এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমরা মনে করি সুক্ষ্ম তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করা প্রয়োজন যে প্রকৃত পক্ষে মানপালনকারী কারখানা ছিলো কি না। যদি থাকতো অগ্নিকা-ের ভয়াবহতা এত ব্যপক হতো না। বাংলাদেশে এ শিল্পটাকে বাঁচানো দরকার। এই শিল্পকে বাঁচাতে আমরা যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তাহালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ব্যাপক ধস নামবে।
পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা এবং শিল্পে নিয়োজিত বিশ লক্ষ শ্রমিক তাদের জীবন রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি উনি যেন এই দুর্ঘটনার সূক্ষ্ম তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেন এবং সঠিক বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মৃত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে যদি বলেন, তবে বলবো লক্ষ কোটি টাকার বিনিময়েও তাদের জীবন আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রমিকই দক্ষ এবং উন্নত কারিগর। তাদের বিন্দু বিন্দু রক্ত ও ঘাম ঝরানো উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের বাজারে রপ্তানী করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়, তা দিয়ে আমরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী মজবুত করতে সক্ষম হয়েছি।
কারখানার মালিকরা যে বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন; তার পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অবদান। অথচ এই শ্রমিকরাই মানবেতর জীবন যাপন করে। এ ব্যাপারে মালিকদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকি কাজ করতে গিয়ে জীবনের নিরাপত্তাটুকুও পায় না। আমি গভীর দুঃখ ও ভারাক্রান্ত চিত্তে স্মরণ করছি তাজরিন গার্মেন্টস এর ঐ ১১১ জন শ্রমিকদের।
যারা জীবনে বিনিময়ে এই শিল্পকে দিয়ে গেছে তাদের জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু। আমি তাদের সকলের বিদেহী আত্মার মাগাফেরাত কামনা করছি এবং তাদের পরিবারে সকল সদস্যগণকে জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।
পরিশেষে এই শিল্পকে ধ্বংসের মহাযজ্ঞ থেকে বাঁচানোর জন্য জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করতে হবে। বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সুদৃঢ় অবস্থান ধরে রাখতে হবে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখতে হবে।
বিবর্তনঃ- “জাগো নারী ফাউন্ডেশন” সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলুন?
নূর-উন-নাহার মেরী এদেশের পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের যে করুণ চিত্র আমি দেখেছি তাতে নারীরা যতদিন তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা বুঝতে না পারবে ততদিন তারা শোষিত বঞ্চিত ও নির্যাতিত হতে থাকবে।
সমাজের এই অবহেলিত নির্যাতিত, নিগৃহীত নারী সমাজকে সুসংগঠিত করে তাদের আত্মোন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তারা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে সেই লক্ষ্যে জাগো নারী ফাউন্ডেশনের জন্ম। মূলত ২০০৩ সালে আমি যখন বাধ্যতামূলক অবসরে আসি তখনই কিছু মানবতাবাদি ও সমাজ হিতৈষী নারীদের একত্রিত করে এ সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করি। প্রথম দু’বছর সাদামাটাভাবে কাজ করার পর আমি এ প্রতিষ্ঠানটিকে জয়েন্টস্টক কোম্পানী কর্তৃক নিবন্ধন করি এবং নিবন্ধনের পর নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি। জাগো নারী ফাউন্ডেশনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, এদেশের নারী সমাজকে সচেতন করা, তাদের আত্মনির্ভরশীল করা। তাদের অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।
সেই সাথে এদেশের নারীদের প্রসাশনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অংশদারিত্ব নিশ্চিত করা। আমাদের মূল কার্যক্রমের মধ্যে পারিবারিক সহিংসতা বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধ করা। দীর্ঘ সাত আট বছর কাজ করার পর নারী নির্যাতনের এক অন্ধকার জগৎ সমন্ধে আমাদের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। রূপনগরে আমাদের প্রধান কার্যালয়। আপনারা জানেন যে, বৃহত্তর মিরপুর একটি পোশাক শিল্প এলাকা।
এ এলাকায় দেশের শত সহস্র নারীরা পোশাক শিল্প কারখানায় নিয়োজিত। জাগো নারী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ফলে মিরপুরে পোশাক শিল্পে নিয়োজত অগনিত নারী শ্রমিকদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ নারী নির্যাতন, যৌতুকের কারণে সহিংস্রতার ঘটনা এই সমস্ত নারীদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। তাই শতকরা ৬০% নারীরাই আমাদের এই সংস্থার সেবা গ্রহণকারী। জাগো নারী ফাউন্ডেশন এর শাখা কার্যালয় বর্তমানে নীলফামারী, জামালপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও জয়পুরহাটে কার্যক্রম চলমান আছে।
এছাড়া আরও কিছু জেলায় আমাদের শাখা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, দেশের বাইরে যুক্তরাজ্যে লন্ডন এসেক্স-এ একটি শাখা করেছি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মেলবোর্নে একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। প্রতিবছর এ সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আমাকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন, আমেরিকা ও লন্ডনে এ সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় সফল হবে? আমার কথা হলো নারী আন্দোলন তো শুধু একটি দেশের জন্য নয়, এ আন্দোলন এখন বিশ্বব্যাপী আন্দোলন। ওদের দেশে হয়তো আমাদের মতো নারীরা এতটা শোষিত বঞ্চিত নয়, তবে নির্যাতিতার সংখ্যা পাশ্চাতের দেশগুলোতেও কম নয়।
বাংলাদেশের আট কোটি নিগৃহীত নারীর অধিকার আদায় আন্দোলনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসী বাঙালি নারীরা। প্রতিবছর তারা বিশ্ব নারী দিবস পালন করে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলো উদযাপিত করে। বাংলাদেশের নারীদের বৈষম্য-বঞ্চনা ও দুঃখ যাতনা নিয়ে তারা কথা বলেন এবং নৈতিক সমর্থন দেন। এইটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। জাগো নারী ফাউন্ডেশন এনজিও ব্যুরো কর্তৃক নিবন্ধন হয় নি বিধায় বৈদেশিক কোন সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব নয়।
তাই সাধ্যমত নিজের অর্থায়নে এই বিশাল দায়িত্ব পালন করে চলেছি। তবে ২০১৩ সালের মধ্যে এনজিও ব্যুরোর এনলিস্টমেন্টের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো বলে আশা ব্যক্ত করছি। কিন্তু ৭/৮ বছর যাবত নিজ অর্থায়নে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে, উন্নয়ন মূলক কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন বড় অঙ্কের অর্থের বিকল্প নেই। যেমন ধরুন পোশাক শিল্প কারখানায় নিয়োজিত যে সব নারীরা কাজ করছে তাদের জন্য একটা আশ্রয় নিবাস করতে চাই। কারণ অনেক নারী আছে যাদের স্বামীরা রাতের আঁধারে কিংবা দিনের আলোতেই মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয়।
ঢাকা শহরে তাদের একরাত থাকা বা এক বেলা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। যারা একেবারেই অসহায় আমি এ ধরনের নারীদের একটা প্রতিষ্ঠান করতে চাই। যেখানে তাদের থাকা খাওয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এ প্রজেক্টে আমি যদি হাত দিতে যাই তবে তার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। আমাদের অর্থ জোগানের কোন দেশি বা বিদেশি দাতা নেই।
বিদেশি দাতা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন। বিদেশ অবস্থানকালে সময় বিভিন্ন সভা সেমিনারে অনেক প্রবাসী বাঙালি এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন আছে কিনা জানতে চান। অর্থনৈতিক কিছু সাহায্য সহযোগিতা করার ইচ্ছাও পোষণ করেন। একমাত্র এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন না থাকার কারণে আমাদের বিদেশি সহযোগিতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। তাই অনেক বিলম্বে হলেও ২০১৩ সালে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
বিবর্তনঃ আপনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?
নূর-উন-নাহার মেরী ঃ স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও আমার মনে হয় এখনও আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি নি। নারীর গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক বাধা বিঘœ অতিক্রম করতে হবে। আমি এদেশের নারীদের অধিকার ভিত্তিক সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা ও একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমাদের বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চান।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে এ দেশের নারীর সম অধিকার ও সমমর্যাদা ভিত্তিক রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। নারী যতদিন পর্যন্ত সম অধিকারে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত না হবে ততদিন পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে যাবে। বাংলাদেশে নারীর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সমান অধিকার ও মর্যাদা ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, আলোকিত বিশ্ব দেখতে চাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।