গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে চলে এলো বছর বিদায়ের মাস ডিসেম্বর। বিশ্বজুড়ে নতুন বছর বরণের আয়োজন, পুরনো বছরের সালতামামিসহ নানা দেনদরবার চলে এ মাসে। কালপ্রভাতের এ ধারার বাইরে আমরা নই। আমাদের দেশেও ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ করা হয় বিদেশিদের মতো করে। পুরনোকে ঘষামাজা করা হয়, পরানো হয় নতুন মোড়ক।
প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশার হিসাব কষা হয় কড়ায়-গণ্ডায়। প্রত্যাশা যাই হোক, প্রাপ্তির ঠিলে সবসময় শূন্য থেকে যায়। অতীতে তাই থেকেছে। এবারও শূন্য না থাকার কোনো কারণ দেখছি না। বিশেষ করে রাজনীতিতে, সেখানে প্রাপ্তির মাপকাঠি ‘শূন্য’ অতিক্রম করে এখন বিয়োগে।
বিয়োগের মাত্রা কত তা বিশ্লেষণ করবেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। আমি দৃষ্টিপাত করছি আমাদের সর্বকালের সেরা প্রাপ্তি বিজয়ের দিকে।
২.
প্রবাসে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের বিজয়ের ভাবনা নিয়ে লিখব ঠিক করেছিলাম। তাদের ভাবনা জানতে কথা বলতে শুরু করি প্রবাসী তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে। ভেনিসের বিশ্ববিদ্যালয় ‘কাফোসকারী’র ছাত্রী সুমনার সঙ্গে কথা বলে আমার লিখার ভাবনা বদলে যায়।
সে পাল্টে দেয় মূল পরিকল্পনা। তার কিছু প্রশ্ন ঘুণ পোকার মতো মাথার মধ্যে কুটকুট করতে শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে ঘিরে দেশে বিদেশে কেন এত আয়োজন? কেন মাথায় পতাকা বেঁধে, কবিতা লিখে, গান গেয়ে, কুচকাওয়াজ করে, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী দিয়ে বিজয় উদযাপন করা হয়? কেন বিজয়কে ঘিরে পত্রিকাগুলো বিশেষ পাতা বের করে? টেলিভিশন প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠান? কেন কলাম লেখেন গুণী মানুষরা? এগুলো কি শুধুই উৎসবের জন্য? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? যদি শুধুই উৎসব বা আনন্দের জন্য করা হবে তাহলে প্রতি বিজয়ে মাথায় পতাকা বাঁধার দরকার কি? দেশের গান করার দরকার কি? উৎসব তো আরও অনেকভাবে করা যায়। থার্টি ফার্স্ট নাইটের মতো অতি আধুনিকতা আনা যায়। যায় না?
সুমনার এমন প্রশ্নে কিছুটা কুঁকড়ে গেলাম।
আমার কুঁকড়ে যাওয়া দেখে সে নিজেই উত্তর দিতে শুরু করলÑ ‘না’ যায় না। বিজয় উদযাপনে থার্টি ফার্স্ট নাইটের মতো অতি আধুনিকতা আনা যায় না। কারণ বিজয় উৎসব শুধুই একটা উৎসব নয়। এ উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে দেশপ্রেম, শহীদদের প্রতি ভালোবাসা। আমরা প্রবাসে বসেও মাথায় দেশের পতাকা বাঁধি, কবিতা লেখা টি-শার্ট পরি, দেশের গান করি।
কারণ সব কিছুর সঙ্গে মিশে আছে দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা। বিদেশে বসে এর বাইরে খুব একটা কিছু করার নেই। কিন্তু আমি বুঝি না, দেশে থাকা মানুষের তো অনেক কিছু করার আছে। তারা কেন শুধু এসব করে বিজয় উদযাপন করবে? এগুলো তো প্রকৃত দেশপ্রেম নয়। এগুলো দেশপ্রেমের উপলক্ষ, প্রেম প্রকাশের কিছু সহজ মাধ্যম মাত্র।
দেশপ্রেম আর প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম তো এক কথা নয়, যে রাত জেগে রক্ত দিয়ে প্রেমের চিঠি লিখতে হবে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই বিজয় উদযাপন করা হয়। আমরা কেন দৃষ্টি দেই না তারা কিভাবে বিজয় উদযাপন করে? তারা বিজয় উদযাপন মানে কি বোঝে, কি বোঝায়? তাদের বিজয়ের আলোচনা কেমন হয়? অথচ তারা থার্টি ফার্স্ট নাইট কিভাবে উদযাপন করে, ভালেনটাইন ডে-তে কি করে তা বেশ ভালোই বুঝি। গত ২৫ এপ্রিল ছিল ইতালির বিজয় দিবস। সে দিনকে সামনে রেখে ইতালির একটা জুতার কোম্পানি ইতালীয় পতাকার নকশায় এক ধরনের জুতা বাজারজাত করে।
তরুণ-তরুণীরা সেই জুতা পায়ে দিয়ে তাদের বিজয় উৎসব পালন করেছে। কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তারা মনে করে এতদিন দেশের জন্য কাজ করেছে। দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছে। এখন যেভাবে খুশি তারা বিজয় দিবস উদযাপন করবে এবং দেশ গড়ার গল্প শোনাবে।
দিনজুড়ে তাদের মিডিয়ায় উন্নয়নের গল্প। কে কিভাবে দেশের জন্য অবদান রেখেছে, স্বাধীনতার সময় দেশের অবস্থা কেমন ছিল, এখন তারা কোথায় নিয়ে এসেছে, আগামীতে কোথায় যেতে চায়, গল্প শুধু এগুলোই। একদম যেন পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। জুতা কোম্পানির ব্যাখ্যা ছিল, শুধু বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে রাখার নাম দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়। বরং দেশের পতাকা সর্বস্তরে সকল কাজে সহজ করে ব্যবহার করা এবং সকলের কাছে পৌঁছে দেয়াই হলো দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা।
আমি বলছি না আমাদের দেশেও এমনটা করতে। যা বলছি তা হলোÑ মাত্র ছয় দশক আগে ইতালি যখন বিজয় অর্জন করে তখন ইতালির অর্থনৈতিক অবস্থা এমন ছিল যে, সাধারণ মানুষ সপ্তাহে একদিন মাত্র মাংস খেতে পারত। ছাগলের দুধের পনির ছিল তাদের কাছে স্বপ্নের খাবার। অথচ মাত্র ৬০ বছরের ব্যবধানে আজ ইতালিতে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি বিদেশি শ্রমিক অভিবাসী জীবনযাপন করছে। আর আমাদের দেশ এখনও আগের জায়গায় পড়ে আছে।
আমাদের দেশপ্রেম আটকে আছে কবিতা, গান আর বক্তৃতায়। বাংলাদেশে তো অনেক যুবক ভোটার, সেখানে কিভাবে অযোগ্য মানুষ পালা করে ক্ষমতায় আসে? তারা কিভাবে ভোট পায়? যে যুবক দেশের পতাকা মাথায় বাঁধে, দেশের গান করে, সে কিভাবে অযোগ্য অসৎ মানুষকে ভোট দেয়? যুবকরা থাকতে কিভাবে দেশপ্রেম শুধু উৎসবের মধ্যে আটকে থাকে?
৩.
আগেই বলেছি সুমনা আমার লেখার ভাবনা বদলে দিয়েছে। তার প্রশ্ন মাথার মধ্যে কুটকুট করছে ঘুণ পোকার মতো। আমাদের বিজয় চার দশক পেরিয়ে পাঁচ দশকে পা রেখেছে। গত চার দশকে আমাদের অর্জন কি? আমরা কি আজও পর্যন্ত সত্যিকারের কোনো দেশপ্রেমিক যোগ্য নেতা পেয়েছি, যে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে? দেশ সৃষ্টির নেতা আমরা পেয়েছি কিন্তু দেশ গড়ার নেতা পাইনি।
যদি পেতাম বিজয়ের এতগুলো বছর পরে আমাদের দেখতে হতো না পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শ্রমিকের লাশ নিয়ে নোংড়া রাজনীতি। পোশাক ফ্যাক্টরির নামে মৃত্যুকূপ নির্মাণকারীদের আস্ফালন দেখতে হতো না। অকার্যকর সংসদ দেখতে হতো না। লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অপ্রশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা দেখতে হতো না। সর্বোপরি আমাদের এক কোটিরও বেশি শ্রমিককে প্রবাসী ভাগ্য বরণ করতে হতো না।
তারা নিজ দেশের আপন আলো বাতাসে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতে পারত। চার দশক পেরিয়ে এসেও বিজয় উৎসব বা দেশপ্রেম শুধু কবিতা গানে আর গলাবাজিতে সীমাবদ্ধ থাকত না।
সত্যিই কি আমরা দেশপ্রেম বুঝি? আমাদের নেতানেত্রীরা বোঝে? একটা উন্নত দেশের দেশপ্রেম প্রকাশের ভাষা আর একটা অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের দেশপ্রেমের ভাষা যে এক নয়, এক হওয়া উচিৎ নয়, তা কি আমরা বুঝি? আমাদের বোধে কি সে খবর আছে? দেশ স্বাধীনের পর থেকেই শুরু হলো আওয়ামী লীগ, জাসদের লড়াই। ক্ষমতার বণ্টন থেকে শুরু হলো মহাঅসন্তোষ। পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ, অবিশ্বাস, অসহযোগিতা, ষড়যন্ত্র তখন থেকেই আমাদের পিছু নিয়েছে।
এত বছর পরেও আমরা সেই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখনও আমরা পরস্পরকে শত্রু ভাবি। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ, দলের স্বার্থ, দলীয়দের স্বার্থ আমাদের কাছে বড় হয়ে আছে। আর কতকাল এভাবে চলবে? আর কত দশক আমাদের বিজয় উৎসব শুধু কবিতা গানে সীমাবদ্ধ থাকবে? আমরা কি বুক ফুলিয়ে কখনোই বলতে পারব না দেশ গড়ার কথা? দেশের জন্য নিজের অবদানের কথা? আমাদের উচিৎ ছিল আগে দেশ গড়া, তারপর কবিতা লেখা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা। কিন্তু আমরা করছি উল্টোটা।
ঠিন যেন প্রবাদের মতোÑ বরের খবর নেই, সবাই রং খেলায় ব্যস্ত।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।