জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগে শিবির ও ছাত্রদল থেকে অনুপ্রবেশকারী ছদ্মবেশী ছাত্রলীগ কর্মীরাই হত্যা করেছে বিশ্বজিৎ দাসকে। ১৮ দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধের দিন পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় বিশ্বজিৎকে হত্যাকারী যে ৫ জনের ছবি গণমাধ্যমে এসেছে তাদের তিনজনই কলেজ জীবনে শিবির ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। বাকি দুজন ছাত্রলীগের কর্মী হলেও সাংগঠনিক কার্যক্রমে তারা সক্রিয় নয়। তবে এর আগে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ইভটিজিং, ছিনতাই ও শিক্ষক লাঞ্ছিত করার অভিযোগে তাদের তিনজনের ছাত্রত্ব স্থগিত করে বিশ্বদ্যিালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা এবং সাধারণ ডায়েরি রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি এমএম শরিফুল ইসলাম বলেন, শিবির ও ছাত্রদল থেকে অনেকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে। গ্রুপিংয়ের রাজনীতির কারণে শীর্ষ নেতারা ইচ্ছা করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজিতের ওপর হামলাকারী ৫ জনের মধ্যে তিনজন আগেই ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত। এ ছাড়া ছিনতাই করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে দুই কর্মী। অন্য একজন পরীক্ষা কেন্দ্রে ধারাল অস্ত্রসহ শিক্ষকদের হাতে আটক হয়েছিল।
তিন জনের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে ছাত্রলীগের ‘সাইনবোর্ড’ নিয়ে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের রাজনীতি করার অভিযোগ। হামলায় অংশ নেয়া প্রথম সারির চারজন হলো মাহফুজুর রহমান নাহিদ, শাকিল আহমেদ, নূরে আলম লিমন ও ইমদাদ।
এদিকে রবিবার পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হলেও পুলিশ আসামি হিসেবে মামলায় কারও নাম উল্লেখ না করায় অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। এমনকি কারা এ হত্যাকা-ে জড়িত, এমন তথ্য মামলায় নেই। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে হামলাকারী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জনা যায়।
শাকিল আহমেদ ॥ বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালির ছেলে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করার পর থেকে জহিরউদ্দিন বাবরের ক্যাডার হয়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে শাকিল। ক্যাম্পাসে সবাই ‘কোপা শাকিল’ হিসেবে তাকে চেনে। ক্যাম্পাসে শাকিল ছাত্রলীগ করলেও পূর্বে ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শাকিলের বড় ভাই শাহিন পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, শাকিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় চিহ্নিত ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত। বছরখানেক আগে এই শাকিল ক্যাম্পাসের পাটুয়াটুলী গেটের পাশে ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় থানা পর্যন্ত যেতে হলেও তাকে মামলায় পড়তে হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা বলেন, শাকিল বিভিন্ন নেশায় আসক্ত ছিল।
তাই নেশার টাকা যোগাড় করতে ছিনতাইয়ের আশ্রয় নিত প্রায়ই। এসব অভিযোগ যাচাই করে ওই সময় তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ক্যাম্পাসে নতুন কমিটি হলেও তাকে আর সংগঠনে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, রবিবার বিশ্বজিৎ যখন দৌড়ে একটি ভবনের দোতলায় উঠে যান, তখন সেখানে গিয়ে শাকিল প্রথম বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। উপর্যুপরি কুপিয়ে শাকিল দ্রুত নিচে নেমে যায়।
আবদুল কাদের তাহসিন ॥ জগন্নাথের মনোবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। বিশ্বজিৎ হত্যা মিশনে তাকে রড নিয়ে হামলা চালাতে দেখা যায়। সূত্র জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তভাবে থাকলেও ছাত্রলীগের মারামারিতে দেখা যায় তার আসল রূপ। সূত্র জানায়, তাহসিনের বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের একটি আবাসিক হলের সভাপতি। এ ছাড়াও তার বাবা ‘শিবিরের আমির’ বলে জানা যায়।
নূরে আলম লিমন ॥ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ব্যাচের (২০০৫-০৬) ছাত্র। ২০০৯ সালে সে বিভাগের পরীক্ষার হলে একটি চাপাতিসহ শিক্ষকদের হাতে আটক হয়েছিল। ওই সময় মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেও তার চরিত্রের বদল ঘটেনি। কয়েক দিন আগে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক শিক্ষককে লাঞ্ছনা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রত্ব হারালেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল।
অভিযোগ রয়েছে তিনি ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতার হয়ে সংঠনের নাম ব্যবহার করে ক্যাম্পাসের আশপাশে চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা জানান।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজিৎকে হামলার সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে নূরে আলম লিমন। প্রাণভয়ে বিশ্বজিৎ দৌড়ে একটি ক্লিনিকের দোতলায় উঠলেও সে তার পিছু নেয়। বিশ্বজিৎকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর পর লিমন তাকে রড দিয়ে মাথায় ও পিঠে আঘাত করে।
মাহফুজুর রহমান নাহিদ ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের (সেশন ২০০৪-০৫) ছাত্র। ছাত্রলীগের কোন পদে না থাকলেও সে বর্তমান সভাপতি শরীফুল ইসলামের আস্থাভাজন কর্মী বলে ছাত্রলীগ সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই নাহিদের বিরুদ্ধেও হত্যাচেষ্টা, মারামারিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সে ছয় মাস আগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হয় বলে ক্যাম্পাস সূত্র জানায়।
প্রত্যাক্ষ দর্শী সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজিৎকে নিচে নামানোর পর রড গিয়ে এলোপাতাড়ি পেটায় নাহিদ।
পরে তার হাতে একটি ধারাল অস্ত্রও দেখা যায়।
ইমদাদুল হক ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। বিশ্বজিতের ওপর হামলায় তাকেও দেখা যায় অংশ নিতে। ইমদাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের এক ছাত্রীর মোবাইল ছিনতাইসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধেও ‘শিবির’ অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া হত্যা মিশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম ব্যাচের নাঈম ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের শাওন ও আজিজ, ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের সাইফুল ইসলাম, রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের রাজন, বাংলা বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের বাবু, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আল আমিনও অংশ নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।