কোন কিছু এমনি এমনি ঠিক হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ প্রতিবাদ করে। একটা উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে আমাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে খুব দ্রুত উন্নতির দিকে ধাবিত হওয়া। এজন্য আমরা সাধারণ জনগণ এবং আমাদের সরকার সবসময় চেষ্টা করছি নিজেদের উন্নতির রাস্তাটা মসৃণ করার জন্য। কিন্তু আসলে আমাদের কাজগুলো কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে ?? আসলেই কি আমরা আশা করতে পারি ??
বলা হয়ে থাকে- “শিক্ষা” জাতির মেরুদন্ড।
অর্থাৎ একটি জাতির উন্নতির অন্যতম পুর্বশর্ত হচ্ছে একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা। এটা ব্যতীত উন্নতির স্বপ্ন দেখাটা আসলে অনেকটা “দিবাস্বপ্নের” পর্যায়ে পরে। যেহেতু আমরা বলি আমরা উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি, তারমানে এটাই দাঁড়ায় যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত এবং একটা শক্ত প্ল্যাটফরমের উপর দাঁড়িয়ে আছে। দেখা যাক, আসলে কতটুকু শক্তিশালী এই শিক্ষাব্যবস্থা। প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
১)বিভক্তিঃ
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা বেশ কয়েকভাগে বিভক্ত। যেমন- সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্ডেন এবং মাদ্রাসা। এর মাঝে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের শিশুকাল কেটেছে এই বিদ্যালয়গুলোতে। এর কারণ অবশ্যই হচ্ছে,এর সহজলভ্যতা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রভাব।
অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনগুলো হচ্ছে অনেকটা শহরকেন্দ্রিক বিদ্যালয়। তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় একমাত্র স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানেরাই পারে এখানে পড়তে। আবার, মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা অনেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মতই। তবে এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য থাকে মুলত শিশুদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এবং ধর্মীয় শিক্ষার ধরন অনুসারে এই পর্যায়ে মাদ্রাসাগুলোর দুটো ভাগ থাকে- ১)হাফেজীয়া মাদ্রাসা এবং ২)সাধারণ মাদ্রাসা।
হাফেজীয়া মাদ্রাসায় শিশুদেরকে পবিত্র আল কুরআন হিফজ (মুখস্থ) করানো হয়। আর সাধারণ মাদ্রাসায় মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
২) সিলেবাসঃ
সিলেবাসের দিক থেকেও এই তিন মাধ্যমের আছে অনেক পার্থক্য। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মুলত জাতীয় শিক্ষাবোর্ডের কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। এই কারিকুলামের মুল বিশেষত্বই হচ্ছে শিশুদেরকে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করা।
এবং সাথে সাথে শিশুদেরকে ইংরেজী,গণিত, সমাজ, বিজ্ঞান এবং ধর্ম সম্পর্কে বেসিক শিক্ষা দেওয়া হয়। এসময়কালে শিশুমনে গেথে যাওয়া কোন বাংলা ছড়ার শ্লোক অনেকটা ফ্যান্টাসির মতই প্রাপ্তবয়ঃকালে মনে আনন্দ যোগায়। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনগুলোতে বাংলা অনেকটা অপাংক্তেয় অবস্থায় থাকে। ব্রিটিশ কারিকুলামের প্রতি বিশেষ প্রীতির কারণেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণে, কিন্ডারগার্ডেনগুলোতে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুদের মনে বাংলা কোন ছড়ার শ্লোকের চাইতে ইংরেজী কোন রাইমের প্রভাব থাকে বেশি।
আবার, মাদ্রাসায় পুরো ভিন্ন চিত্র। এখানে বাংলা কিংবা ইংরেজী- দুটোই অপাংক্তেয় অবস্থায় থাকে। শিশুদেরকে কোন আরবি/উর্দু/ফার্সি শ্লোক শিখানো হয় অনেক গুরুত্ব সহকারে। শিশুরা সুর করে শায়েরী পড়ে। ছড়া বা রাইম সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা থাকে না।
৩)শিক্ষকঃ
এই তিনশ্রেণীর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেও অনেক তফাত থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণত সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বড় হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। তাদের মানসিকতাও হয় আর আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতই। তাই তারা শিশুদেরকেও সেভাবেই বড় করতে সচেষ্ট হয়। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষকরা (এখানে পড়া উচিত “শিক্ষিকারা”।
কারণ কিন্ডারগার্ডেনে ৯৮%ই থাকে শিক্ষিকা) কিছুটা উচ্চশিক্ষিত এবং কারিকুলামের কারণেই তাদেরকে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি ইংরেজী সাহিত্যেও পারদর্শী হতে হয়। তাই এক্ষেত্রে শিশুরা কিছুটা জগাখিচুড়ি মার্কা শিক্ষা লাভ করে। আবার, মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগে সাধারণত ধর্মীয় বিষয়ে দক্ষতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতা শিক্ষাদানই এই মাধ্যমের মুল উদ্দেশ্য।
৪)অবকাঠামোঃ
অবকাঠামোগত দিক দিয়েও এই তিন মাধ্যমে আছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একটা বিশাল মাঠ এবং একটা বিদ্যালয় ভবনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এখানে শিশুরা বড় হয় বিশাল খোলা মাঠে দুরন্তপনা করতে করতে। অবশ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোলা মাঠ থাকলেও সেখানে বিদ্যালয় ভবন অনেক বিরল। অন্যদিকে, অধিকাংশ কিন্ডারগার্ডেনে মাঠ থাকে না। একটা বিন্ডিংয়ের নিচতলা কিংবা দোতলা নিয়েই একটা বিদ্যালয় হয়ে যায়।
শিশুরা আনন্দের জন্য প্রযুক্তির দিকেই ঝুকে বেশি। কিছু ক্যাডেট বা কিন্ডারগার্ডেন টাইপ মাদ্রাসা ছাড়া অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই খোলা মাঠের ব্যবস্থা থাকে।
৫) শিক্ষাদান পদ্ধতিঃ
শিক্ষকদের মানসিকতার পার্থক্যের কারণেই মুলত এই তিন মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও পার্থক্য থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি অনেকটা মুক্ত শিক্ষাদান পদ্ধতি। শিশুদের উপর শিক্ষকদের কর্তৃত্ব বলতে থাকে শুধু পরীক্ষার রেজাল্টের কারণে বা দুষ্টুমির কারণে দেওয়া কিছু বেত্রাঘাত।
বছরে মাত্র ২ বার (ক্ষেত্রবিশেষে ৩ বার) পরীক্ষা থাকায় শিশুদের উপরও চাপ থাকে অনেক কম। শিক্ষকদের সাথে শিশুদের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলেও বেশ সহজ- স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনগুলো যেন পরীক্ষার পসরা সাজিয়ে বসে। বছরে ৩ বার ফাইনাল পরীক্ষার সাথে সাথে ৬ বার মাসিক পরীক্ষাও থাকে। আর সাথে সাথে নিত্যদিনের হাজারো হোমওয়ার্কের ঝামেলাতো আছেই।
শিশুরা আসলে এখানে দম ফেলার সময়ই পায় না। চাপে পিষ্ট শিশুদের মাঝে স্বাভাবিক চঞ্চলতাও উধাও হয়ে যায়। বেত্রাঘাত কিংবা কোন ধরনের শারীরিক শাস্তি এসব বিদ্যালয়ে অনেকটাই নিষিদ্ধ। মাসে মাসে অভিভাবক সভার মাধ্যমে এরা সবসময় অভিভাবকদেরকে শিশুদের সম্পর্কে অবগত রাখে। এখানে শিশুদেরকে অনেকটা রেসের ঘোড়া হিসেবেই দেখা হয়।
তবে ভালো দিক হচ্ছে এই বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের সাথে তাদের শিক্ষকদের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। আবার, মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা অনেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতই। তবে পার্থক্য হচ্ছে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপের নামে মাঝে মাঝে এখানে শিশুদের উপর শারীরিক নির্যাতনের পরিমাণটা একটু বেশিই থাকে। তাই দেখা যায় যে, মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রতি শিশুদের শ্রদ্ধা আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে ভয়ের সম্পর্কই থাকে বেশি।
৬) শিশুমনে প্রভাবঃ
সম্পুর্ণ ভিন্ন তিন মাধ্যমে শিশুদের মানসিক বিকাশও হয় ভিন্নভাবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বড় হওয়া শিশুদের মাঝে সাধারণত বাংলাদেশী কোন কীর্তিমানকে নিয়ে ফ্যান্টাসি গড়ে ওঠে। তারা মনে মনে সেই কীর্তিমানের সমকক্ষ হতে চায়। তাদের মাঝে বাংলা গল্প-সাহিত্যের প্রতি একটা আবেদন গড়ে ওঠে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে থাকায় শিশুদের প্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতি সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষাব্যবস্থাটাই একটু জগাখিচুড়ি মার্কা।
শিশুদের আসলে পরীক্ষার চাপে নিজেদের মত ভাবার সময়ই হয়ে ওঠে না। তবে তারা প্রযুক্তির হাল-হকিকত সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত থাকে। বিদ্যালয় থেকেতো এ ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়া হয়ই, পাশাপাশি এক্ষেত্রে অভিভাবকেরাও সচ্ছল হওয়ায় শিশুরা সবসময় প্রযুক্তির স্পর্শেই থাকে। তবে অতিরিক্ত প্রযুক্তি নির্ভরতা তাদেরকে বাইরের জগত সম্পর্কে উদাসীন হিসেবে গড়ে তোলে। মাঝে মাঝে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা প্রকৃতিই তাদের একমাত্র ভরসা।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা অনেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতই বড় হয়। তবে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দিক দিয়ে তাদের অবস্থান খুবই নিচে। তাদের ফ্যান্টাসির জায়গায় অবশ্য থাকে কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব।
৭) অভিভাবকের মানসিকতাঃ
এই তিন মাধ্যমে শিশুদের ভর্তি করা নিয়েও অভিভাবকদের ভিন্ন মানসিকতা কাজ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিশুর ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা সাধারণত শিশুদের পড়ালেখার ব্যাপারে তেমন ওয়াকিবহাল থাকেন না।
শহরের বিদ্যালয়গুলোর কথা অবশ্য আলাদা। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্ডেনের শিশুদের মায়েরা পড়ালেখার ব্যাপারে থাকেন অতিরিক্ত সতর্ক। তারা সবসময়ই নিজেদের শিশুকে সেরা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকেন। ফলে শিশুদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন বেশি। আমাদের দেশে একটা খুব প্রচলিত রেওয়াজ হচ্ছে, পরিবারের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে/মেয়েকে মাদ্রাসায় পাঠানো।
এক্ষেত্রে মা-বাবার মাঝে এই মানসিকতা কাজ করে যে, মাদ্রাসায় ভর্তি হলেই দুষ্টু শিশুটি ভালো হয়ে যাবে। তাই তারা তাদের দায়িত্ব ভর্তির কাজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখে।
শিশুদের পৃথিবী অনেক সহজ-সরল। তাই শিক্ষার্জনে এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের চিন্তাধারার মাঝে খুব একটা পার্থক্য থাকে না। তবে এই বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাই তাদের মনে ভবিষ্যত বিভক্তির বীজ বুনে দেয়।
আমি এখানে শুধুমাত্র বাস্তব অবস্থাটাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কোন মাধ্যমের পক্ষে/বিপক্ষে বলাটা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এত বৈষম্যমুলক শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই।
চলবে.......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।