পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী জীব বৈচিত্র এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল গুলোর মধ্যে মধ্যে ইন্দোনেশিয়ান রেইনফরেস্ট অন্যতম। বিশ্বের সবচয়েয়ে বড় দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেশিয়া প্রায় ১৮০০০ দ্বীপমালা নিয়ে প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরের মাঝে বিস্তৃত। এশিয়ার সব চেয়ে বড় রেইন ফরেস্টের পাশাপাশি শত শত স্বতন্ত্র আদিম ভাষা এবং সুমাত্রান বাঘ, বামন হাতি, গন্ডার, ওরাং ওটাং সহ প্রায় ৩০০০ এর ও বেশি প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থল এই বনাঞ্চল।
১৯৬০ এর শুরুর দিকেও ইন্দোনেশিয়ার ৮০% এলাকা জুড়ে বনাঞ্চল ছিল। এর পর থেকেই যেভাবেই হোক, মন্ড, কাগজ, পাতলা কাঠ, পাম তেল এই পন্যগুলোর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সে চাহিদা পূরণের জন্য সমৃদ্ধ বনাঞ্চলের দিকে মুনাফালোভী কর্পোরেট বহুজাতিক কোম্পানী গুলোর নজর পড়ে।
ব্যাপক দূর্নীতি, দুর্বল নীতিমালা ইত্যকার সুযোগে বহুজাতিক কোম্পানী গুলো ব্যাপক হারে বনাঞ্চল দখলে মেতে ওঠে। এই মুনাফা লোভী বহুজাতিক বিনিয়োগের ধারণাটি পুরো দ্বীপ পুঞ্জ জুড়ে ব্যাবসায়ীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফল স্বরূপ ব্যাপক ভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস, ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন প্রজাতির জীবের নির্দিষ্ট আবাসস্থল ধ্বংস এবং বনের উপর নির্ভর করে জীবীকা নির্বাহকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে ব্যাবসায়ীদের দ্বন্দ্বের সূচানা হয়।
দুঃখজনকভাবে, বনাঞল কেটে ফেলার হার বিবেচনায় পৃথিবীতে ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান সবার উপরে। এখন পুরো দেশের মূল বনভূমির মাত্র অর্ধেক অবশিষ্ট আছে।
যদিও মূল্য বিচারে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে, অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় দেখা গেছে ইন্দোনেশিয়ান রেইনফরেস্টের এক মিলিয়ন হেক্টরের ও বেশি (২.৪ মিনিয়ন একর) বনাঞ্চল প্রতিবছর কেটে ফেলা হচ্ছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে ৭০% বনাঞ্চল খণিজ মাটি সমৃদ্ধ এবং ৩০% বনাঞ্চল কার্বন সমৃদ্ধ নুড়ি পাথরের মাটির বনাঞ্চল।
এই সব ববনাঞ্চল কেটে ফেলার কারণে ইন্দোনেশিয়া পরিবেশগত এবং সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। জাভা টাইগারের মত অনেক গুলো বিশেষ প্রজাতির প্রাণী ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ওরাং ওটানের মত আরো কিছু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির মহা ঝুঁকিতে আছে। রেইনফরেস্ট পরিষ্কার করে ফেলার জন্য ব্যাপক হারে বনে আগুন লাগানো হচ্ছে ।
যার ফলে সৃষ্ট ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে বিমান চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে এবং প্রায় ১০০ মাইলের ও দূরের শহরে এর প্রভাব স্বাস্থগত হুমকির সতর্কতা দিচ্ছে। কীটনাশক এবং বনভূমির মাঝে স্থাপিত কলকারখানা গুলোর নিঃসৃত তরল বর্জ্য স্থানীয় পানি চলাচলের উৎস এবং মাটিকে দূষিত করছে। সস্থানীয় সম্প্রদায় গুলোর উপর চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন এবং তাদের সাথে কোম্পানীর অবিরাম সংঘর্ষের মূলে রয়েছে দখলীকৃত বনভূমির জমির উপর বহুজাতিক কোম্পানী গুলোর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ।
রেইনফরেস্টের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
অন্যান্য ক্ষতির মত ক্রমাগত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং পিটল্যান্ডের মাঝখানে বয়েচলা ড্রেনেজ সিস্টেম গুলোর ধ্বংস মারাত্নক অর্থনৈতিক ক্ষতির সৃষ্টি করছে। ইন্দোনেশিয়ার রেইনফরেস্ট যেটুকু এখনো অবশিষ্ট আছে তা অগুনিত সেবা দিয়ে যাচ্ছে যার অধিকাংশ অর্থনৈতিক দৃষ্টকোণ থেকে খুবই দুর্বলভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিকালে স্বল্প পরিসরে এর গুরুত্ব বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
বাস্তুসংস্থান গত অর্থনীতি এবং জীববৈচিত্র বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ান কর্তৃপক্ষের শুরু করা জরিপ অনুসারে ৯৯ মিলিয়ন ইন্দোনেশিয়ান তাদের জীবিকার জন্য প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান থেকে পাওয়া সেবার উপর নির্ভরশীল এবং তা ইন্দোনেশিয়ার জি.ডি.পির ২১%। ইন্দোনেশিয়ার গ্রাম্য গরীব লোকদের জি.ডি.পির ৭৫% প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান গত সেবা সমূহ থেকে আসে। স্থানীয় সম্প্রদায়রা এই বনাঞ্চলের উপর নির্ভর করেই শতাব্দীর পর শতাব্দী নিজেরা টিকে আছে এবং বনাঞ্চলকেও টিকিয়ে রেখেছে। এখন তারা এক প্রজন্মেরও কম সময়ের মধ্যে এই বনাঞ্চল ধ্বংসের চাক্ষুস সাক্ষী হয়ে দিনাতিপাত করছে।
রেইন ফরেস্ট ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনঃ
ইন্দোনেশিয়ার রেইনফরেস্ট ধ্বংসের মাত্রাটা এতই বেশি যা এখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে তাৎপর্যময় প্রভাব রাখছে।
রেইনফরেস্ট এবং পিটল্যান্ডের বাস্তুসংস্থান প্রক্রিয়াটা বায়ুমন্ডল থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন টন কার্বন গ্রহণ করে জমা রাখে এবং এসব কার্বন ধ্বংস করে বায়ু মন্ডলে প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরই ইন্দোনেশিয়া এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রীণহাউস নিঃসরণকারী দেশ। এই নিঃসৃত গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর ৮৫%ই আসছে রেইন ফরেস্ট এবং পিটল্যান্ডের অবক্ষয় জনিত ক্ষতি থেকে। পুরো পৃথিবীতে গ্রীণহাউস নিঃসরণ হারের ৫% ই নিঃসৃত হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে যা পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক বছরের মিলিয়ন মিলিয়ন কার, ট্রাক, রেলগাড়ি এবং বাস থেকে মোট নিঃসরণের মাত্রার চেয়েও বেশি।
মাইলের পর মাইল রেইনফরেস্ট ধ্বংস করে বানানো পাম প্লানটেশন।
ইন্দোনেশিয়ান সরকার এবং শিল্পমালিকগণ আগামী দশ বছরের মধ্যেই দশ মিলিয়ন একর রেইনফরেস্টকে পাম তেল এবং পাল্প বাগানে (এক ধরণের সরু গাছ যা কাগজ তৈরির মন্ড বানাতে ব্যবহার করা হয়) রূপান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন যেটি বিশ্বে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস মোকাবেলায় আজ ইন্দোনেশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে তৈরি করছে।
আশার কথা অনেক বেসরকারী আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থা ও ই অঞ্চলে কাজ করছে। যারা মূলত কার্বন নিঃসরণের হারকে কমিয়ে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে রেইনফরেস্ট কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।