আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যবসা

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। ব্যবসা মোহাম্মদ ইসহাক খান মুদি দোকান। রতন স্টোর।

বড় বড় করে লেখা আছে, এখানে চাল, ডাল, আটা-ময়দা, তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। একজন অল্পবয়স্ক তরুণ দোকানে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বড় একটা দোকানে-টোকানে যায় না, অনভিজ্ঞ। আমতা আমতা করে চারিদিকে তাকিয়ে সে বলল, এই যে চাচা, এক কেজি ডিম দিন তো। দোকানদার হা হা করে হেসে ফেললেন।

ঐ মফিজ, শুনছস, এক কেজি ডিম চায়। ভাতিজা, ডিম তো কেজিতে বিক্রি হয় না, হালিতে। এক হালি মানে চাইরটা। তিন হালিতে এক ডজন। ছেলেটি লজ্জায় গাল লাল করে ফেলে।

ঠিক আছে, এক ডজন ডিম দিন। বড় দেখে দিয়েন। ঐ মফিজ, খাড়াইয়া দেখস কী, ভাতিজারে এক ডজন ডিম দে। দোকানের ছেলেটি দ্রুত একটা ঠোঙায় বারোটি ডিম ভরে দেয়। এবার দশ হালি আলু দিন, তরুণটি এবার বলে।

দোকানদার এবার বললেন, ভাতিজা, আলু তো হালিতে না, কেজিতে বিক্রি হয়। ছেলেটি লজ্জায় আবারো লাল হয়ে বলল, কী যন্ত্রণা! ঠিক আছে, দুই কেজি আলু দিন। বড় দেখে দিয়েন। ছেলেটি সহজ হতে পারছে না, কিন্তু নিজের অনভিজ্ঞতা যতটা পারে ঢেকেঢুকে রাখার চেষ্টা করছে, যেটা চোখ এড়ায় না। দোকানদার মনে মনে ভাবলেন, বোধহয় বাসা থেকে ছেলেটা একটা কথাই শিখে এসেছে, বড় দেখে দিয়েন।

লবণ, চা-পাতা, গুঁড়োদুধ কিংবা চিনি কিনতে গেলেও হয়তো বলবে, বড় দেখে দিয়েন। কত হয়েছে? ছেলেটা বলে। একশো ষাইট ট্যাকা দ্যান। ছেলেটা টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে মাথা নিচু করে তীরবেগে চলে যায়। দোকানদার তার সহকারী ছোকরাটিকে বললেন, আইজকালকার পুলাপানের যে কী অবস্থা, বাজারঘাট কিচ্ছু বুঝে না।

দোকানে আইসা বলে এক কেজি ডিম দ্যান, হে হে। বড় আচানক জামানা আইসা গেছে, বুঝছস ভাইগনা? সহকারী ছেলেটিও হাসে। এবারের ক্রেতা একজন বয়স্ক লোক। মিনিকেট চাল আছে? আছে। মিয়াভাইয়ের শরীর ভাল? হুঁ, ভাল।

দেখি চালটা কেমন? দোকানদার হাতের তালুতে করে খানিকটা চাল এগিয়ে দেন। ক্রেতাটি নিবিষ্ট মনে প্রতিটি চাল (!) পরীক্ষা করে দেখেন। দোকানদার বললেন, অত কী দ্যাহেন মিয়াভাই? এক নাম্বার চাইল, কোন পোকা ধরব না। কি চিকন "সোন্দর" চাউল দেখছেন? আমি নিজে খাই। ফুলের মতোন ঝরঝরা ভাত হয়।

ও। দেখে ভালোই তো মনে হয়। কত করে কেজি? জে, তেপ্পান্ন ট্যাকা। ক্রেতার চোখ কপালে উঠে যায়। তে-প্পা-ন্ন? এত বেশি কেন? বেশি কই দেখলেন মিয়াভাই? অহন বাজারে সাপ্লাই নাই, তাই দাম বাড়তি।

নাজিরশাইল দোকানে রাখতেই পারি না, দাম এত বাইড়া গ্যাছে, খালি মিনিকেট আর মোটা পাইজাম চাউল। তয় দাম একটু বেশি হইলেও চাউলটা ভালা, দেইখা লন। কাঁকর নেই তো? দোকানদার জিভ কেটে বলেন, ছি ছি, কী কন মিয়াভাই? বস্তার লেখা দেখিয়ে বলেন, অটো মেশিনে তৈয়ার হইয়া আসে, কোন ধানাইপানাইয়ের চান্স নাই। "পাত্থর" থাকলে আইসা আমার দুই গালে দুইডা চটকানা মাইরা যাইয়েন। পাঁচ কেজি দিয়ে দিন তাহলে।

পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে তিনি বলেন, কী যে দিনকাল পড়লো, চালেরই যদি এই দাম হয় তাহলে মানুষ খাবে কী? ঐ মফিজ, মিয়াভাইরে পাঁচ কেজি চাইল দে। দেরী করস ক্যান? চাল নিয়ে ক্রেতা বিদায় হলেন। খানিকক্ষণ দোকান খালি। এই সুযোগে দোকানদার ভদ্রলোক এখন তাঁর লাল টালিখাতায় লিখে রাখছেন হিসাব, আর দেখে নিচ্ছেন কে কত বাকি রেখেছে। পরিচিত কাস্টমারের এই একটা বদভ্যাস, কথায় কথায় বাকি রাখে।

মাস কাবার হয়ে যায়, শোধ দেওয়ার খবর নেই। এরেই কয় বাঙ্গালি, বুঝছস মফিজ। একটু আদর দিবি, মাথায় উইঠা বইয়া থাকবো। একটু "ইস্কুরু" (স্ক্রু) টাইট দিয়া দিবি, বাঁশের লাহান সোজা হইয়া থাকবো। বাঙ্গালির দরকার খালি লাডির বাড়ি, ফৌজি কায়দার মাইর, তাইলে এ্যারা বদলাইবো।

ফৌজি মাইর বুঝস? চামড়ায় কোন দাগ পড়বো না, শইল্যের ভিতরে হাড্ডি-মাংস সব এক হইয়া যাইবো। মফিজ নামের ছেলেটির দিকে না তাকিয়েই তিনি সব কথা বলে যান। মফিজও সায় দিয়ে যায়। মফিজ ছেলেটির মধ্যে কৌতূহল নামক কোন বস্তু নেই, সে জিজ্ঞেস করলো না কী করে চামড়ায় দাগ না ফেলেও "শইল্যের" হাড্ডি-মাংস এক করে ফেলা যায়। দুই হাতে করে ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে আরেকজন উপস্থিত হলেন।

এক হাতে দড়ি দিয়ে ঝোলানো বোতলটা ঠক করে রেখে বললেন, সরিষার তেল দিন দেখি। সেদিন তো দিলেন, বাসায় নিয়ে দেখি কালচে হয়ে গেছে। এবার ভালোটা দেবেন। দোকানদার বিগলিত হাসি হেসে বললেন, আমি আপনেরে "কাইল্লা" "ত্যাল" দিছি? ঐ মফিজ, হুনছস, মিয়াভাই কী কয়? হোনেন মিয়াভাই, আমার দোকানে কোন দুই নাম্বার জিনিস পাইবেন না। এই দ্যাহেন, কি "ফেরেশ" ত্যাল, তিনি তেলের ভাঁড় উঁচু করে দেখান।

বলেন, আমি নিজে খাই, থুক্কু, মাথায় দেই। তয় এই ত্যাল দিয়া রান্নাও করতে পারবেন মিয়াভাই, হাছা কথা। আলুভর্তা জবর হইবো। ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি দিন, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

কথা থামিয়ে বোতলে তেল ভরে দেন দোকানী। একজন মহিলা আসেন। আচ্ছা, ভাল গাওয়া ঘি আছে? বাঘাবাড়ি ঘি না কী যেন বলে? বাঘাবাড়ি ঘি তো অহন আর পাওয়া যায় না আফা। বাজার থেইকা উইঠা গ্যাছে গা। এখন কোনটা আছে? হাতিমার্কা ঘি নিতে পারেন।

দেশী জিনিস, পিরমিয়াম (প্রিমিয়াম) ঘি, একদম খাঁটি। গন্ধটা শুঁইকা দ্যাহেন আফা, আমি নিজে খাই। তিনি কৌটা খুলে ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দেন। তিনি শুঁকে দেখলেন। গন্ধ খারাপ না, নেয়া যায়।

কত করে? আড়াইশো গেরাম পড়বো আপনের দুইশ ট্যাকা। বলেন কী? কেজি আটশো? এক কেজি নিলে পঞ্চাশ ট্যাকা কম পড়বো আফা। একটু কমে দেয়া যায় না? দোকানী হেসে বললেন, এইগুলান তো "ফিক্স" দাম আফা। কোন কম নাই। আপনে আশেপাশে ঘুইরা দ্যাহেন, কেউ যদি আমার চেয়ে এক পয়সাও কম লয় তাইলে আপনেরে "ফিরি" দিয়া দিমু, দাম লাগবো না।

মহিলাটি বলেন, ছোট কৌটাটাই দিন, কয়েকদিন একটু দেখে নিই। পরে লাগলে আরও নেয়া যাবে। ঘিয়ের টাকা বাকি টাকা বুঝিয়ে দিয়ে দোকানী বলেন, আইসেন আফা। সালাম। এখন দুপুর।

কোন ক্রেতা দোকানে নেই। দোকানের কর্তা লোকটি আবার তাঁর টালিখাতা খুলে বসেছেন। মফিজ তাঁর পেছনে ঝিম ধরে বসে আছে। হঠাৎ মুখ খুলল সে। মামা, একটা কথা ছিল।

কী? খাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই তিনি বলেন। আপনের কাজকর্ম আমার মোটেই ভালা ঠ্যাকে না। ক্যান? আবার কী হইলো? আপনে আইজ কম কইরা হইলেও দশটা মিছা কথা কইছেন মামা। কই? কহন? মিছা কথা? আমি? কী কস? আকাশ থেকে পড়েন তিনি। আপনে তো এই দোকানের চাইল খান না মামা, বাসায় রাহেন ঐ ইউসুফের দোকানের নাজিরশাইল।

এই চাইলে খুঁজলেই পাত্থর পাওয়া যাইব। আর গতবার ঐ ব্যাডার সরিষার ত্যালে আসলেও তো কাইল্লা গাদ আছিল। শ্যাষে যেই মহিলা আইল, হ্যারে হাতিমার্কা ঘি দিলেন, কইলেন আপনে নিজে খান। আপনে তো খান অন্য ঘি। হাতিমার্কা ঘি খাইয়া তো গেলোবার আপনের প্যাট নাইমা গেছিল, হেরপর থেইকাই বন্ধ করছেন।

দোকানদার ঘুরে বসলেন, মফিজের দিকে তাকালেন। মফিজ ঢোক গেলে। মামা রেগে গেলেন না তো? একটা চড় না আবার বসিয়ে দেন। দোকানদার তা করলেন না। বললেন, এইগুলানরে তুই মিছা কথা কইলি? এইগুলান না কইলে ব্যবসা চলত ক্যামতে? আমি যদি কই আমার দোকানের চাইলে পাত্থর আছে, তাইলে কেউ কিনবো? সবাই তো যাইবো ঐ ইউসুফের দোকানে।

যদি কইতাম গতবার আমি আপনেরে গাদওয়ালা ত্যাল দিছি, তাইলে হে আবার আইবো আমার দোকানে? আর ঐ মহিলারে যদি কইতাম যে এই ঘি খাইয়া আমার প্যাট নাইমা গেছিল, তাইলে বুঝি হ্যায় দাঁতগুলান বাইর কইরা কইত, আমারে দুই কেজি ঘি দ্যান? সব মাল তাইলে দোকানে থাইকা থাইকা ডেট "ওবার" হইয়া যাইবো, বিক্রি আর হইবো না। মফিজ মাথা নিচু করে আছে। কিছু বলছে না। দোকানদার নরম স্বরে বললেন, হুন মফিজ, এইগুলান মিছা কথা না। এরে কয় ব্যবসা।

তুই বড় হইলে তো আমার মতোই দোকানদার হবি, তরে দুইটা কায়দা শিখাইয়া দেই। এক নাম্বার কায়দা, কাস্টমারের কাছে সবসময় নিজের জিনিসের গুণগান করবি, যদি দুই ট্যাকার জিনিসও হয়। দুই নাম্বার কায়দা, হগ্‌গল সময় হাসিমুখ কইরা থাকবি, ঐ বাংলা পাঁচের মতো চেহারা কইরা থাকবি না। কাস্টমারেরা দাঁত বাইর করইন্না দোকানদার পছন্দ করে। পরিচিত কাস্টমারের শরীল-সাস্থ্যের খোঁজখবর লবি।

বুঝছস বেকুব পোলা? মফিজ মাথা নিচু করে থেকেই জবাব দেয়, হ। দোকানদার আবার তাঁর টালিখাতার হিসেবে মন দেন। [এটি নিছক একটি গল্প। অসৎ ব্যবসায়ী যেমন আছে, তেমনি সৎ ব্যবসায়ীও আছেন। কাজেই কোন পাঠক যেন ভুল না বোঝেন।

কোন বিশেষ পেশাজীবীকে অসম্মান করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না, সেই অধিকারও আমার নেই। - মোহাম্মদ ইসহাক খান] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.