আমি সত্য জানতে চাই
উপমহাদেশে যে কয়জন গুণী রাজনীতিবিদ ও জননেতার জন্ম, তাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব শেরেবাংলা। যিনি গণমানুষের প্রিয় হক সাহেব। এক নামে বিখ্যাত জননেতা ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। বাংলার বাঘের ৫১তম মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বাকেরগঞ্জ জেলায় (বর্তমান ঝালকাঠি) সাতুরিয়ার নানার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশাল শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে বানারীপাড়ার চাখার গ্রামে। তার পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ ওয়াজেদ এবং মায়ের নাম সৈয়দন্নেসা খাতুন। তার পিতা ছিলেন বরিশাল বারের একজন সুখ্যাত আইনজ্ঞ।
(একে ফজলুল হকের বসত বাড়ি)
এ. কে. ফজলুক হকের পূর্বপুরুষ আঠার শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
এ. কে. ফজলুক হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। মক্তবের পাট চুকিয়ে ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন।
ফজলুল হক তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নহভাজন ছিলেন।
প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি নেন। ইউনিভার্সিটি ল কলেজ কলকাতা থেকে ১৮৯৭ সালে বিএল ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার আশুতোষ মুখার্জির অধীনে আইনচর্চা শুরু করেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি বরিশালে আইন ব্যবসায় চালিয়ে যান।
তিনি (১৯০৩-১৯০৪) রাজচন্দ্র কলেজে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেন। ১৯০৬ সালে প্রশাসনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় ৩০ ডিসেম্বর ১৯০৬ সালে যোগ দেন রাজনীতিতে। ফজলুল হক নবাব সলিমুল্লাহ ও নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।
তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত। এর আগে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
(নিজ বাড়িতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক)
এ. কে. ফজলুক হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই.-এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুক হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে পত্নীত্বে বরণ করেন। তাঁদের সন্তান ফাইজুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে মারা যান।
এ প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ ১৯১৮-১৯১৮ সেশনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন ১৯১৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ দিল্লি সেশনে সভাপতিত্ব করেন।
তিনি ১৯২৯ সালে স্যার আবদুর রহিমকে সাথে নিয়ে ‘প্রজা পার্টি’ নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ (কেপিপি) নামে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এর নেতৃত্বে জমিদারি প্রথা ও রেয়াতব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন জনসমর্থন লাভ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে। ১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে সম্মিলিত মুসলিম পার্টির ব্যানারে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৯টি সিট লাভ করেন।
পরের বছর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত।
(নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের ওয়ার্কিং কমিটির অনান্য সদস সহ এ. কে. ফজলুক হক)
২৩ মার্চ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা লাহোর রেজুলেশন উপস্থাপন করেন। এই তত্ত্বই মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৫১-৫৩ সালে ছিলেন অ্যাডভোকেট জেনারেল।
’৫৩ সালের ২৭ জুলাই তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরে গভর্নর নিযুক্ত হন। শারীরিক অক্ষমতার কারণে ১৯৫৮ সালে তিঁনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি রচনা করেন Understanding The Muslim Mind. তিনি মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান হিসেবে অনেক শিাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
তার মধ্যে আছে ইডেন কলেজ, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, আদিনা ফজলুল হক কলেজ, তেজগাঁও এগ্রিকালচার কলেজ (বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভৃতি। বাংলা একাডেমী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অপরিসীম। এর সময় থেকেই ১ বৈশাখ সরকারি ছুটির স্বীকৃতি পায়।
এই মহান নেতা ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ৮৯ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। হাইকোর্টের পশ্চিম পাশে তার মাজার অবস্থিত।
গণমানুষের প্রিয় হক সাহেব এর ৫১তম মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।