বারবার শুধু ছিটকে পড়ি অশ্লীল কারাগারে
ষাটের দশক থেকে বাংলা পদ্য রচনায় পশ্চিমা রীতি মোটামুটি একটা জায়গা করে নিলেও তার আগে অন্ত্যমিলই ছিল বাংলা কবিতার প্রধান নিয়ামক। দুই বা চার ছত্রে চমতকার অন্ত্যমিলই ছিল কবিতার নান্দনিক সৌন্দর্য। অন্ত্যমিল ছাড়া কবিতাকে তো কবিতাই বলে গণ্য করা হতোনা বরং একপ্রকার পাপের শামিলও বলেও ধরা হতো। অন্ত্যমিল সর্বস্ব এই কবিতার প্রভাব বাঙালীর আর্থ-সামাজিক অন্য কোন বলয়কে প্রভাবিত করেছিল কিনা জানিনা তবে বাঙালীর বংশবৃদ্ধিতে কবিতার প্রভাবকে একেবাড়ে উড়িয়ে দেয়া যায়না।
কারো প্রথম পুত্র সন্তানের নাম যদি রাখা হয় কামাল তবে অবধারিতভাবেই পিতাকে আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।
কেননা কামালের পর জামাল নামে আর একটি পুত্র সন্তান যদি না থাকে তাহলে কেমন যেন খাপছাড়া লাগে। নামের অন্ত্যমিলের কারনেই যে বাঙালীর অধিক সন্তান গ্রহণে মহা উৎসাহী ছিলেন তা অনেকে ফু মেরে উড়িয়ে দিলেও আদতে কিন্তু বিস্তর প্রমান আছে - আলালের পর দুলাল, হেলালের সাথে বেলাল, রফিকের সাথে সফিক, আবুলের সাথে বাবুল, সেলিমের সাথে কলিম, সিধুর পর নিধু, অরুনের পর বরুণ - এরকম ঢের প্রমান দেয়া যাবে বৈকি। লাবলুর ছোট ভাই এর নাম যে ডাবলু হবে সেটাই নিয়ম, তার বদলে মনির হলেই আত্নীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে এরকম অমিল নিয়ে মৃদ্যু উত্তেজনার সৃষ্টি যে হতোই তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। অন্ত্যমিলই হলো আসল কথা পরের ইতিহাস পরে। এ কারণে লাবলু -ডাবলুর পরবর্তী সংখ্যার হাবলু নামকরণেও তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যেতনা অথবা বাবুর পর হাবু।
কিন্তু কামালের পর যদি কন্যাসন্তান হয় তাহলে? - সেক্ষেত্রেতো অন্ত্যমিলের খেলা আরেকটু লম্বা হয়ে বেশ জমে ওঠে - কামালের পর কন্যাসন্তান হলে ধরা যাক তার নাম রাখা হল রিনা, তারপর একটি পুত্র সন্তান হলে না হয় জামাল নাম রেখে কামালের সাথে অন্ত্যমিলের ঘাটতিটা পূরন হলো। কিন্তু ওদিকে যে রিনা একাকী পড়ে আছে, অতএব এখন একটি কন্যাসন্তান বড়ই আবশ্যক যার নাম রাখা যায় মিনা। অতপর এইখেলা চলতে থাকে নিরন্তর। রিনার পর মিনা, তারপর বিনা, তারপর হেনা এরপর যদি মিল খুজে না পেয়ে যদি শিমুল চলে আসে তাহলে তো অবধারিত ভাবে আবার পারুলের জন্য অপেক্ষা। পিতৃকুল নাম রাখার এই ছন্দে বছর বছর আন্দোলিত হলেও মাতৃকুল প্রত্যেক বছর সন্তান ধারণ করতে গিয়ে যে অসীম ভোগান্তির শিকার হন সে বিষয়ে আর নাই বললাম।
কেননা খাদ্য প্রসেসিং আর সন্তান ধারনের মহান কাজটার জন্যই তো নারী জাতীর আগমন। যার কাজ তাকে তো তা করতেই হবে।
কিন্তু এই খেলা স্টার প্লাসের সিরিয়ালের চেয়েও ধারাবাহিক আকার ধারণ করলে জীবন যে কত দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে তা আমাদের পাড়ার ওভারশিয়ার কাকুই ভাল বলতে পারবেন। ওভারশিয়ার কাকার প্রথম সন্তান পিন্টু। তারপর ধারাবাহিকভাবে নান্টু, মন্টু, সেন্টু, রিন্টু।
প্রথম সন্তান পিন্টুর নামেই তাদের বাড়িটা পিন্টুদের বাড়ি বা কাকা পিন্টুর বাপ হিসেবে পরিচিত ছিলেন অনেকদিন। কিন্তু যত ঝামেলার কারণ হলো আর একটি পুত্র সন্তানের আগমনে। সন্তান যেহেতু তাই নাম একটা রাখতেই হবে আবার মিল না থাকলে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। বিরাট সঙ্কটে ওভারশিয়ার কাকু যখন হাস ফাস করছেন তখন তার ৪ বছর বয়সী সর্বশেষ পুত্র আব্দার করল তার ছোটভাই এর নাম হবে ঘেন্টু- অতএব তাই সই। ছোট ছেলের আব্দারও রক্ষা হল আবার অন্ত্যমিলও পাওয়া গেল।
এ যাবত ভালই ছিল কিন্তু গোল বাধল ঘেন্টুর স্কুলে প্রবেশ করার পর। সহপাঠী বা শিক্ষক যাকেই গর্ব ভরে তার ডাক নাম ঘেন্টু বলতে যায় তখন সকলেই ফিক করে একটু হাসি খেলে যায়। অচিরেই ঘেন্টু বুঝতে পারল নামের কারণেই সে স্কুলে হাসির খোরাক। তবে গাট্টাগোট্টা শরীরের কারণে প্রাইমারী স্কুলে হাসির প্রতিত্তোরে গদাম দিয়ে পার পেলেও যতই উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল ততই স্কুলে আর পাড়ায় ঘেন্টু নামটা চরম বিনোদনের বস্তু হয়ে উঠল। কেউ যখন ঠোটে এক চিলতে হাসি সহযোগে ঘেন্টু বলে ডাকে তখন প্রথম দিকে ক্ষেপে গেলেও পরে নিজের ভেতরেই ঘোত ঘোত করে মেজাজটা সামাল দিতে হত।
তবে ঘেন্টুর সবচে রাগ তার জন্মদাতার পিতার ওপর। সরাসরি কিছু বলতে পারেনা তবে বাপ ভাল কথা বললেও ঘেন্টু সবকিছু ঘোত শব্দযোগে গ্রহণ করে। বিধাতা অনেক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বিধায় নামজনিত এই ছোট্ট কারণ নিয়ে মাথা ঘামাবার মোটেও সময় পাননা, তবে ঘেন্টুর এই অবমাননাকর বিষয়টি কি করে যেন তার নজরে আসায় ঘেন্টুর পিতার প্রতি তিনি বেজায় রুষ্ট হলেন।
তারই ফলশ্রুতিতে অচিরেই পিন্টুদের বাড়ি ঘেন্টুদের বাড়ি হিসেবে পাড়ায় ব্যপক পরিচিতি অর্জন করলো। শুধু সেটা হলেই রক্ষে ছিল।
ইয়ার দোস্ত প্রতিবেশিগণও ওভারশিয়ার কাকাকে ঘেন্টুর বাপ বলে সম্বোধন শুরু করলো। কেউ যখন ’ ঘেন্টুর বাপ বাসায় আছেন নাকি’ বলে হাক পাড়ে- তখন ঘেন্টুর বাপ দরজার আড়ালে যথাযথভাবে দাতি খিচানি আর খিস্তি ঝেড়ে তারপর হাসিমুলে দরজা খুলে জানান দেন তিনি আছেন। যদিও এই খিস্তির কারণে মাঝে মাঝে নিজেই একটু লজ্জিত হন। শতহলেও তিনি ঘেন্টুর জন্মদাতা, তার কাছে পিন্টুও যা ঘেন্টুও তা। কিন্তু প্রতিবেশিরা এত সহজ পাত্র নয়, তাদেরই কিছু উঠতি বংশধরগণ কাচা হাতে রঙ দিয়ে পিন্টু ভিলাকে যখন ঘেন্টু ভিলা বানিয়ে দিল তখন ওভারশিয়ার কাকুর তেজের বহিঃপ্রকাশে পাড়ায় বেশ ভাল একটা উত্তেজনা বয়ে গেল।
অবশ্য তাতে হীতে বিপরীতটাই বেশি হল। ছেলে ছোকড়ারা এখন দেয়ালের আড়ালে চিকন সুরে ঘেন্টুর বাপ বলেই কেটে পড়ার একটা মজাদার খেলা আবিষ্কার করে ফেলেছে । মাঝে মাঝে তাদের খেলাটা বেশ জমে ওঠে যখন কাকা খেপা ষাড়ের মতো ছেলেপুলেকে তাড়া করেন।
অন্ত্যমিলের এই নান্দনিক ছন্দে বাঙালীর উতসুক্য অনেক আগেই উবে গেছে, তবে সেটা কি কবিতায় অন্ত্যমিল বিলুপ্তির কারণে না আর্থসামাজিক পেক্ষাপটের কারণে- তা ব্যপক গবেষণা ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। তবে আশার কথা নতুন এক ধরনের পদ্যরীতি হয়তো অচিরেই আবিষ্কৃত হতে যাচ্ছে যা বাঙালীর প্রজনন ক্ষমতা সমুলে বিনাশ করে দিবে।
নইলে অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত (পরম শ্রদ্ধাসহকারে উচ্চারণ করতে হবে) ২০২৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শুন্যের কোটায় নিয়ে আসতে বলেছেন- তা কিভাবে সম্ভব হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।