আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দরকার জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা

জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করার বিষয়টি স্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। বাস্তবায়ন করার কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে হলে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটিরও বেশি। নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর ছাড়া জনঘনত্ব পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি বাংলাদেশে।

বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৯৩ জন মানুষ বাস করে। প্রাক্কলনে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালে দেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩০ লাখে ও ২০৫০ সালে ২২ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়াবে। জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাফল্যও অর্জন করেছে। স্বাধীনতার সময় মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) ছিল ৭। সেই হার কমে এখন হয়েছে ২.৭।

ওই সময় গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর, এখন ৬৯ বছর। স্বাধীনতার পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি পুনর্গঠন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসে বিশেষ কর্মসূচি, ১৯৭৬ সালের জাতীয় জনসংখ্যা নীতি, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচি (১৯৯৮-২০০৩) এবং ২০০১ সালের মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র অন্যতম।

এখন ‘জনসংখ্যাভিত্তিক মুনাফা’ বা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর কথাও শোনা যাচ্ছে। সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন বলছে, দেশে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী উপার্জনক্ষম মানুষের হার ৫৮ শতাংশ।

অন্যদিকে, শিশু ও বয়স্কদের হার ৪২ শতাংশ। জনসংখ্যার এই বয়সকাঠামো আগামী তিন দশক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বিচক্ষণতার সঙ্গে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে দেশ বিপুল জনসংখ্যা থেকে লাভবান হবে।

তার পরও জনসংখ্যা গুরুতর সমস্যা হয়েই আছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা এর বিপুল জনসংখ্যা।

মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে কৃষিজমি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।

অন্য বাস্তবতাটি বেকারত্বের।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) ২০০৯-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দুই কোটি ৪৪ লাখ বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ সম্পূর্ণ কর্মক্ষম।

তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১০) প্রতিবেদন বলছে, দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ (দেশের অর্থনীতিবিদ ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা এই সংখ্যাকে অবাস্তব বলে আখ্যায়িত করেছেন)। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রতিবছর ১৮ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে। ফলে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। ২০০৫-২০০৬ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়।

পারিবারিক কাজে ১৫ ঘণ্টার কম সময় দেয়, এমন জনগোষ্ঠীকে হিসাবে নিলে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।

পোশাকশিল্পের পর অন্য কোনো খাতে বড় আকারে শ্রম নিয়োগের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বেকার ও আধা বেকার হয়ে আছে। এই বোঝা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য জানা খুব জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের এ-দেশীয় প্রতিনিধি ওবায়দুর রব প্রথম আলোকে জানান, প্রতিবছর এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন জানা। অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কারগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। যারা কোথাও ভর্তি হয় না, তাদের জন্য কী করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের অনেকই বেকার।

এ দেশের বেকারত্বের বোঝা অনেকটাই কমিয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা।

ওবায়দুর রব জানান, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা বেশি বেতন পান। যাঁদের কারিগরি দক্ষতা আছে, তাঁরা বেশি বেতন পান। এখানেই ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চলে আসে। বিদেশগামী শ্রমিকদের ভাষা ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ তাই জোরদার করা দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যাকে এখন আর নিয়ন্ত্রণের বিষয় হিসেবে দেখলে চলবে না।

দেখতে হবে ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে। সঠিক ব্যবস্থাপনাই জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করবে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যবস্থাপনাকে দেখা হচ্ছে।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক (গবেষণা) আহম্মেদ-আল-সাবির বলেন, প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। নতুন বাসস্থান গড়ে ওঠা এর অন্যতম কারণ।

সরকারকে শহর ও গ্রামের বাসস্থানকে এমন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে, যেন কৃষিজমি আর নষ্ট না হয়। অন্যদিকে, শহরের বহুতল ভবন নির্মাণ বাধ্যতামূলক করলে জমির ওপর চাপ কমবে।

শহরে জনসংখ্যার সমস্যা সহজে চোখে পড়ে। শহরগুলোয় এখন ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ বাস করে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, শহরে তা ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নগরায়ণে পরিকল্পনার ছাপ নেই। ছোট, মাঝারি ও বড় শহরের ব্যবস্থাপনায় নানা সুপারিশ আছে নগরবিদদের।

শহরের, কৃষি জমির বা বেকারত্ব সমস্যার সমাধান বিশেষজ্ঞরা দেখছেন ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ কেউ জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের কথাও বলেন।

সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এম এ মাবুদ আপাতত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন কমিশন’-এর প্রস্তাব করেছেন (এ বিষয়ে ট্রান্সফরমিং পপুলেশন ইনটু হিউম্যান রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ শিরোনামে তাঁর একটি প্রবন্ধ আছে)। প্রথম আলোকে তিনি জানান, একাধিক মন্ত্রণালয় যুবকদের কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব শিক্ষা এক রকম নয়, মানেরও তারতম্য আছে। প্রস্তাবিত কমিশনের কাজ হবে মান ঠিক রেখে একই ধরনের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নজরদারি করা।

এম এ মাবুদ জানান, কমিশন জনসংখ্যার বিষয়ে প্রাক্কলন করবে।

কোন খাতে কোন ধরনের জনশক্তি দরকার, তা জরিপ করবে। একইভাবে বিভিন্ন দেশে কোন ধরনের জনশক্তি দরকার, তাও জরিপ করবে। এসব জরিপের ভিত্তিতেই কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে সরকার। তিনি আরও জানান, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

 



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.