সেই চিরবিদ্রো.... যে লড়াই , কখনো শেষ হয়না.... @বহুলকথিত ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর মতোই একটি ‘শাইনিং বাংলাদেশের’ গল্প ফাঁদা এ কথিত শ্রেণির জন্য বেশ লাভজনক
@মানবেতর জীবনযাপন করা অগণিত মানুষকে অঙ্ক কষে হাইপোথেটিকালি টেনেহিঁচড়ে দারিদ্রসীমা নামক একটি প্রতারণামূলক দড়ির উপর উঠিয়ে, ‘গরিব আসলে আগের চেয়ে ভালো আছে’ জাতীয় মোহ তৈরি করা এক ধরনের অপরাধ।
@যাদের ঘামের বদলে আসে বৈদেশিক ডলার, সে হতভাগা শ্রমিকের দল কয়েক দশক ধরেই পোভার্টি লাইন নামক দড়িটি ধরে ঝুলে আছেন। আমরা কখনও তাদের ভাতে মারছি, কখনও পিষে মারছি, কখনও পুড়িয়ে মারছি আবার কখনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে মারছি। আর এ সবকিছুই ঘটছে এমন এক সময় যখন রাষ্ট্র ও মিডিয়া একাট্টা হয়ে আমাদের ৮ পার্সেন্ট জিডিপি আর মধ্যআয়ের খোয়াব দেখিয়ে চলেছে। যখন যুদ্ধজাহাজ, রাশিয়ান মিগ ও বিমানবিধ্বংসী মিসাইলের ভিড়ে ফায়ার ব্রিগেডের করাত ও ক্রেইনগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
@প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর একটি গানের লাইন মনে পড়ে যায়। ‘…রেডিওতে খবর দিছে, দেশে কোনো অভাব নাই, লাইল্লার ঘরে কাইল্লার ঘরে আনন্দের আর সীমা নাই!’!!!!!
কদিন আগে একটি পত্রিকার প্রথম পাতার লিড নিউজ ছিল: দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কমছে। রিপোর্টটি বিভ্রান্তিমূলক ও চালাকিপূর্ণ। যদিও বিশ্বব্যাংকের এ বছরের সমীক্ষা প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করেই রিপোর্টটি করা হয়েছে, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের মূল প্রতিবেদনটি পড়লে বোঝা যায়, সেখানে আহ্লাদের চেয়ে আশঙ্কার কথাই বেশি। তা সত্ত্বেও সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে তথাকথিত ‘গরিবি কমার’ খবরটিকে হেডলাইন করেছে পত্রিকাটি।
কেন?
গরিবি যখন এপিডেমিক, গরিব যখন পানিতে ডোবে, আগুনে পোড়ে, গার্ডার ভেঙে, ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে, কনক্রিটে পিষে, মাথা থেতলে, হাড় গুড়ো হয়ে প্রতি ঘণ্টায় মরে- গরিব যখন ‘দুইডা ভাতের লাগি’ অর্ধেক হেলেপড়া মৃত্যুকূপে মেশিন চালায়, ঠিক তখন এ অযাচিত, অবাস্তব, অসত্য হেডলাইন কেন? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এ লেখার অবতারণা।
লিড নিউজটি ছিল এ রকম, গত এক দশকে প্রায় দেড় কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছে। প্রথম প্রশ্ন, দারিদ্রসীমা বস্তুটি কী? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, উপরে ওঠার মানেটাই-বা কী? দারিদ্রসীমা ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া ফর্মুলা নয়। বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত দারিদ্রসীমা বা পোভার্টি লাইনটি গরিবির হালত মাপজোখের একটি বিতর্কিত পদ্ধতি। এটি আপেক্ষিক এবং আলোচনাসাপেক্ষ।
একাডেমিক বোঝাপড়ার জন্য এ পদ্ধতির উদ্ভব হলেও এর রাজনৈতিক ব্যবহারটি হতে পারে মারাত্মক। সে কারণেই দারিদ্রসীমা নামক এ প্রতারণা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সময়ে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০০৮ সালের নতুন হিসেব অনুযায়ী, দৈনিক ১ ডলার ২৫ সেন্ট বা প্রায় ১০০ টাকার নিচে আয়রোজগার হলে ওই ব্যক্তি দরিদ্র বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু আমরা জানি, দারিদ্রসীমার সামান্য নিচে বা সামান্য উপরে যারা বসবাস করেন, তারা সবাই এক অর্থে মানবেতর জীবনযাপন করেন। দশ, পনের বা পঞ্চাশ টাকার বাড়তি আয়, এ দেশে বিশুদ্ধ খাবার পানি, সুস্থ টয়লেট, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা, অথবা কর্মক্ষেত্রে একটি নিরাপদ এমারজেন্সি এক্সিটের নিশ্চয়তা দেয় না।
জ্যৈষ্ঠের ভয়াবহ দাবদাহে মাটি কাটে যে নারী, গেল বছরের তুলনায় দৈনিক কুড়ি টাকা বেশি আয় করলেই এ দুর্মূল্যের বাজারে তার দারিদ্র বিনাশ হয় না। দৈনিক একশ টাকার সামান্য উপরে নেট আয় যে গার্মেন্টস শ্রমিকের, তিনি কোন ভাগাড়ে রাত কাটান, কোন দুর্গন্ধময় ড্রেনের পাড়ে টয়লেটের কাজ সারেন, কোন টেপের পানি খান, চালের সঙ্গে আলুটা, বেগুনটা কিনে খেতে পারেন কি না, সন্তানের ডায়রিয়া, জ্বর, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, ঘা-পাঁচড়া, জন্ডিস ইত্যাদি অসুখ হলে কোন ডাক্তারের কাছে যান, কিডনির অসুখ, হাঁপানি, শাসকষ্ট, পিত্তথলির পাথর ইত্যাদি সমস্যায় আক্রান্ত হলে কোন চুলোয় যান তিনি, এসব খবর নিতে গেলেই বোঝা যাবে দারিদ্রের মতো একটি বহুমাত্রিক ও জটিল সামাজিক অবস্থান শুধুমাত্র টাকার অংকে বুঝতে চাওয়ার প্রয়াসের নির্বুদ্ধিতা ও অসারতা!
এ দেশে কাঠামোগত গাফিলতির কারণে কৃষক বছরের পর বছর উৎপাদিত ফসলের দাম পান না। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে নির্মাণশ্রমিকের একটি বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু এটি ক্ষণস্থায়ী। এ শিল্প দারিদ্র থেকে উত্তরণের কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। যে গার্মেন্টস শিল্প থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর দাঁড়িয়ে এত আস্ফালন আমাদের- সে শিল্পের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক মাসিক মাত্র তিন হাজার টাকা মজুরিতে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত সংগ্রাম চালান।
তাদেরই একাংশ আবার আগুনে পুড়ে কয়লা হন, দালান ধসে চিড়েচ্যাপ্টা হন, হাত-পা-আঙুল কাটা পড়ে গোঙাতে গোঙাতে মরেন।
বাকি আরেক গোষ্ঠী যারা নিয়মিত রেমিটেন্স পাঠিয়ে মধ্যবিত্তের বিদেশি পণ্য, বিদেশি গাড়ির খায়েশ পূরণ করেন, তাদের একাংশ কফিনে করে বাড়ি ফেরেন, স্ট্রবেরি খামারে ন্যায্য মজুরি চাইতে গিয়ে গুলি খান, বছরের পর বছর নিজেরা ইতরের জীবনযাপন করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরান।
এ যখন দেশের মানুষের প্রকৃত অবস্থা, তখন দেশে গরিবি কমছে এমন লিড নিউজের পিছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিটা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি!
বিশ্বব্যাংক দারিদ্র মাপামাপিতে যে প্র্যাকটিসগুলো করে আসছে তার গোড়াতেই রয়েছে মারাত্মক সব গলদ। যেমন, মাথাপিছু আয় ১ ডলার ২৫ সেন্টে দারিদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে ২০০৮ সালের অগাস্টে। আমরা জানি, এ পাঁচ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে বহুগুণ।
এ সময়ের মধ্যে দেশে চাল, ডাল, আলু, পটলের দাম আসমান ছুঁলেও বিশ্বব্যাংকের গরিবি মাপা দড়িটির কিন্তু নড়নচড়ন নেই। বর্ধিত মূল্যস্ফীতিকে কানাকড়ি দাম না দিয়ে দারিদ্রের যে লাইন, তা কতটুকু বাস্তব?
আবার পরিবারের একাধিক সদস্যের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকেই বাংলাদেশে দারিদ্র কমার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। এর অর্থ পরিবারের ১৪ বছরের কিশোর ছেলেটি স্কুল থেকে ঝরে পড়ে যে কোনো মুহূর্তে ধ্বসে পড়বে এমন একটি কারখানায় কাজ নিলে পরিবারের রোজগারি বাড়ে এবং গরিবি কমে। কিন্তু এটা কী ধরনের গরিবি দূরীকরণ?
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন দরিদ্র মানুষের উপার্জনের বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে ধারণা থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে অবশ্যই। দেশের শতকরা কতভাগ নরনারী দৈনিক ৫০ টাকা আয় করেন এবং কতভাগ দৈনিক ১৫০ টাকা আয় করেন, এসব তথ্য দরিদ্র মানুষের উপার্জনের ক্যাটাগরি বুঝতে যথেষ্ট কার্যকরী।
কিন্তু দৈনিক ৭০ টাকা আয় করা ইটভাঙা নারী দৈনিক ১০০ টাকায় তাজরীন ফ্যাশনসের খাতায় নাম লেখানোর মানে এ নয় যে দেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমছে! দারিদ্র মাপুন ভালো কথা। কিন্তু দারিদ্রসীমা নামের একটি হাইপোথেটিকাল লাইন টেনে দিয়ে নড়াইলের মাটিকাটা সখিনা গরিব আর আশুলিয়ায় জীবনবাজি রেখে মেশিন চালানো রহিমা গরিব নয়- এমন বিচার অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক।
পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকার ষাট ও সত্তরের দশকে ভূমিবণ্টনের মাধ্যমে গ্রামবাংলার প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল। মাথাপিছু আয়-রোজগারের সংকীর্ণ গাণিতিকতার উর্ধ্বে উঠে ভূমিহীনের জমির অধিকার, কৃষকবান্ধব নীতিমালা, স্বল্পমূল্যে সেচের পানি সরবরাহ ও লোকাল পঞ্চায়েত সরকার তৈরির মাধ্যমে তারা গ্রামীণ সমাজে এনেছিল গুণগত পরিবর্তন। সে কারণেই শেষপর্যন্ত আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলেও টানা ৩৪ বছর ধরে সিপিএম টিকে ছিল ওই কৃষকের ভোটেই।
অন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসেবার দৈন্যদশা, বিপজ্জনক কর্মস্থল, ঋণে নিমজ্জন, বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের অভাব, এমনই আরও অনেক কাঠামোগত ও নিয়মতান্ত্রিক শোষণ ও বঞ্চনাই এ সমাজে একটি ভদ্রসম্মত জীবনযাপনের ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা। দারিদ্রের এ বিবিধ জটিল ডাইমেনশন আমলে না নিয়ে কেবল আয়রোজগারের উপর ভিত্তি করে দারিদ্রের যে দড়ি টাঙিয়েছে বিশ্বব্যাংক- তার উপরে-নিচে বা মধ্যখানে অবস্থানরত শতকোটি নরনারীর সবাই একটি আপাদমস্তক শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার ঘানিটানা কলুর বলদ মাত্র।
উন্মুক্ত বাজারের কষাঘাতে দরিদ্র যখন টালমাটাল, তখন গরিবের প্রকৃত সংখ্যা লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখতে কোনো পত্রিকা যখন লিড নিউজ ছাপায় ‘দেশে দরিদ্রের সংখা কমছে’, সেটা নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
গত দু দশকে আমরা দেখেছি বাজার অর্থনীতির প্রথম থাপ্পড়টি পড়ে গরিবের গালে। প্রতিযোগিতার নামে অবাধ পণ্যের আমদানিতে প্রথম ধাক্কাটি খায় ক্ষুদ্র কৃষক ও ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা।
একদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে বন্ধ হয় চালু কলকারখানা। আরেকদিকে মুনাফা লোটার অভয়ারণ্যে সস্তাশ্রম পুঁজি করে গড়ে ওঠে ভয়ঙ্কর রকমের বিপজ্জনক সব পোশাক কারখানা। তথাকথিত লিবারালাইজেশন আমলে তাই বাজার অর্থনীতির অপকর্ম ধামাচাপা দিতে দারিদ্রসীমা নিয়ে ‘পলিটিক্স’ নতুন কিছু নয়। আর এ কাজটি মিলেমিশে করেন দুই শ্রেণির লোক। বাজারপন্থী অর্থনীতিবিদ এবং মেট্রোপলিটনভিত্তিক এ পণ্যসর্বস্ব বাজারব্যবস্থার সরাসরি ভাগীদাররা।
দারিদ্রসীমা নিয়ে ভারতে বহুবছর তুমুল বিতর্ক চলেছে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে অজিত সেনগুপ্তের রিপোর্ট। এ রিপোর্ট অনুযায়ী খাদ্যের ‘কনজাম্পশন’ দৈনিক বিশ রুপির নিচে ধরলে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮০ কোটি ৩৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৭ ভাগ। ২০০৯ সালে পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের মাত্রাকে ছকে ফেলে সাক্সেনা কমিটির রিপোর্ট বলেছে, ভারতের শতকরা ৫০ শতাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। একই বছর তেন্ডুলকার কমিটির রিপোর্ট বলছে, ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা মোট জনসংখার প্রায় ৩৭ ভাগ।
লক্ষ্যণীয় যে, ভারতের প্ল্যানিং কমিশন গ্রহণ করেছে তেন্ডুলকার কমিটির রিপোর্ট। সেখানেই সবচেয়ে কম গরিব! মাত্র ৩৭ ভাগ। দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা কম করে দেখাতে পারলেই সরকারের জন্য ভালো বৈকি। ভারতীয় গবেষক উত্সা পাটনায়েক অবশ্য গরিবের সংখ্যা কম দেখানোর এ প্রয়াসকে এক কথায় বলেছেন ‘একাডেমিক সন্ত্রাস’ বা তথ্যসন্ত্রাস।
এ তথ্যসন্ত্রাসের কাজটি ভালো করতেন প্রয়াত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার।
আশির দশকে তার ঢালাও বেসরকারিকরণের ফর্মুলায় পড়ে বেকারত্বের হার যখন সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে, বেকারের হার কম করে দেখাতে খোদ বেকারত্বের সংজ্ঞাই তাকে পরিবর্তন করতে হয়েছিল একাধিকবার। যেমনটি করতে হয়েছিল ভারতের প্ল্যানিং কমিশনার মন্টেক সিংকেও। উন্মুক্ত বাজারের তাণ্ডবে ভারতে যখন গরিবের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে, ঠিক সে সময় মন্টেক সিং দারিদ্রসীমাকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনলেন দৈনিক ২৫ রুপিতে! গরিবি লুকানোর এমন হীন প্রচেষ্টায় বিতর্কের ঝড় উঠেছিল ভারতে।
আমরা ভুলে যাইনি, মাসখানেক আগেই নিজদেশে তুমুল বিতর্কিত, দরিদ্র মানুষের প্রতি ভয়ঙ্কর ইনসেনসিটিভ এ ভারতীয় টেকনোক্রেটের বিশাল সাক্ষাৎকার ছেপেছিল আজকের আলোচ্য পত্রিকাটি। প্রথম পাতায় প্রকাশিত সে সাক্ষাৎকারে মন্টেক সিং এ হতভাগা জাতিকে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার সবক দিয়েছিলেন!
দারিদ্রসীমা প্রশ্নে ভারতের অর্থনীতিবিদরা একে অপরকে তা-ও ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করে চলেছেন।
বিশ্বব্যাংকের উপার্জনসর্বস্ব দারিদ্রের হিসেবটি গ্রহণ না করে তারা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করেছেন দারিদ্রসীমার হিসেব-নিকেশে দারিদ্রের বহুমাত্রিকতার প্রতিফলন ঘটাতে। আমরা কিন্তু সে প্রভুদের বেঁধে দেওয়া দারিদ্রসীমাকেই গ্রহণ করেছি। দেড় কোটি লোকের কুড়ি কি পঁচিশ টাকা রোজগার বেড়েছে এ ঘোষণায় ঢোল পিটাচ্ছি।
গরিব মানুষ কি আসলেই ভালো আছে? কিছু টাকা আয়রোজগার বাড়লেই কি এ ভীষণ রকমের অসম সমাজব্যবস্থায়, এ উৎপীড়নের যাঁতাকলে, এ এমারজেন্সি এক্সিটবিহীন মৃত্যুকূপে ভালো থাকা সম্ভব? দেশি-বিদেশি পরিসংখ্যান কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আসল চিত্র। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০-১১ গবেষণায় বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষুধা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দুই-ই বেড়েছে।
২০১১ সালে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪১ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির। প্রায় ৫০ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ ক্ষুধা ও অপুষ্টি। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, বাংলাদেশের তিন কোটি সাত লাখ মানুষ ‘ক্রনিকালি আন্ডারফেড’, যার অর্থ একটাই- দিনের পর দিন কম খেয়ে থাকা। গবেষণা আরও বলছে, আফ্রিকার কিছু দেশের চেয়েও বাংলাদেশের শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে বেশি!
আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এ দেশে জনস্বাস্থ্যে মাথাপিছু রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমতে কমতে ঠেকেছে মাত্র ২১ ডলারে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ন্যূনতম জনস্বাস্থ্যব্যয়ের তুলনায় প্রায় ২০ ডলার নিচে।
সরকারি হিসেবেই দেশে গরিবের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ! যাদের ঘামের বদলে আসে বৈদেশিক ডলার, সে হতভাগা শ্রমিকের দল কয়েক দশক ধরেই পোভার্টি লাইন নামক দড়িটি ধরে ঝুলে আছেন।
আমরা কখনও তাদের ভাতে মারছি, কখনও পিষে মারছি, কখনও পুড়িয়ে মারছি আবার কখনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে মারছি। আর এ সবকিছুই ঘটছে এমন এক সময় যখন রাষ্ট্র ও মিডিয়া একাট্টা হয়ে আমাদের ৮ পার্সেন্ট জিডিপি আর মধ্যআয়ের খোয়াব দেখিয়ে চলেছে। যখন যুদ্ধজাহাজ, রাশিয়ান মিগ ও বিমানবিধ্বংসী মিসাইলের ভিড়ে ফায়ার ব্রিগেডের করাত ও ক্রেইনগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নব্বইয়ের পর লাগামছাড়া বাজারব্যবস্থার মধ্যে যারা ফুলেছেন, ফেঁপেছেন, মুনাফার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করেছেন- এ ভারসাম্যহীন ও বৈষম্যপয়দাকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে বহাল তবিয়তে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব বহুলকথিত ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর মতোই একটি ‘শাইনিং বাংলাদেশের’ গল্প ফাঁদা এ কথিত শ্রেণির জন্য বেশ লাভজনক।
এ শ্রেণিরই একটি বড় অংশ আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকপক্ষ।
গত এক দশকে মিডিয়ার মালিকানায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। করপোরেট পুঁজির এজেন্ডা চেপেছে জার্নালিজমের ঘাড়ে। অর্থনীতির সঙ্গে মিডিয়ার চমকপ্রদ যোগসাজশের সম্পর্কটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক পি সাইনাথ তার অসংখ্য লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন। স্টক মার্কেট, ফটকা ব্যবসা বা স্পেকুলেশনের অর্থনীতিতে রিসিশন বা মন্দার মতো শব্দগুলো অচ্ছুত বটে।
২০০৮ সালের মন্দার সময় ঘন ঘন মন্দাবিষয়ক রিপোর্ট করার কারণে হিন্দুস্থান টাইমসের সাংবাদিকদের চাকরি যাওয়ার মতো ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে তার লেখায়।
ভারতের পূর্বাঞ্চলে যখন নিরব দুর্ভিক্ষ চলছে, হাজারে হাজারে কৃষক যখন দেনার দায়ে আত্বহত্যা করছেন, শতকরা ৪২ ভাগ ভারতীয় শিশু যখন ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, ৮০ কোটি মানুষ যখন দৈনিক ২০ রুপির নিচে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, আন্তর্জাতিক পুঁজি ও মেট্রোপলিটান অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ‘স্টেকহোল্ডার’ হিসেবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই ভারতীয় মিডিয়া তখন ব্যস্ত থেকেছে এক গরিবিমুক্ত ফাইন ইন্ডিয়ার গল্প শোনাতে। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড আর মেট্রোপলিটানের আলোর ঝলকানির নিচে চাপা পড়ে গেছে গড়ে প্রতিদিন ৪৮ জন কৃষকের আত্বাহুতির খবর।
অবশ্য এ দেশের করপোরেট মালিকানাধীন মিডিয়া স্রোতের বিপরীতে গিয়ে গরিবি-হটাও জার্নালিজম করবে এমন ভাবার খুব বেশি কারণ নেই। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই আমাদের।
শত্রুতা ‘ইলুশ্যনের’ সঙ্গে। মানবেতর জীবনযাপন করা অগণিত মানুষকে অঙ্ক কষে হাইপোথেটিকালি টেনেহিঁচড়ে দারিদ্রসীমা নামক একটি প্রতারণামূলক দড়ির উপর উঠিয়ে, ‘গরিব আসলে আগের চেয়ে ভালো আছে’ জাতীয় মোহ তৈরি করা এক ধরনের অপরাধ। দারিদ্র এ সমাজের একটি ভয়াবহ অসুখ। যে কোনো দায়িত্ববোধসম্পন্ন মিডিয়ার উচিত দারিদ্র দূরীকরণে যে নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন সে প্রশ্নে প্রতিটি সরকারের উপর চাপ বলবৎ রাখা।
প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর একটি গানের লাইন মনে পড়ে যায়।
‘…রেডিওতে খবর দিছে, দেশে কোনো অভাব নাই, লাইল্লার ঘরে কাইল্লার ঘরে আনন্দের আর সীমা নাই!’
এখন প্রশ্ন, কতটুকু গরিব হলে, তথাকথিত দারিদ্রসীমার উপর বাস করা হাজারখানেক লাইল্লা-কাইল্লা কেবল এক মাসের বেতন হারানোর ভয়ে, পিলার-ভাঙা, ফাটল-ধরা মৃত্যুকূপে মেশিন চালাতে ঢোকেন? আর কতটুকু ধান্দাবাজ হলে এ ভয়াবহ গরিবির দেশে ‘গরিবি কমার’ বানোয়াট কাহিনি হেডলাইন হয়?
মাহা মির্জা : গবেষক, সমাজকর্মী
মিডিয়ার শাইনিং বাংলাদেশ প্রকল্প
মে ২, ২০১৩
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।