আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবদমন

"জীবনবোধ মানুষকে তার রূপ-রস-রঙে ভরে তোলে কানায় কানায়, জীবনকে দেখবার প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৃথিবীটাকে মোচড় দিয়ে বদলে দিতে চায়" আমার ফেসবুক বন্ধুতালিকায় কিছু মেয়ে আছেন যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর লেখালিখি করে থাকেন। তাদের সবার লেখা যে আমার ভালো লাগে, কিংবা তাদের চিন্তাকাঠামো-উদ্ভূত বক্তব্যের সাথে আমি একমত হই এমন নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ ভালো লেখেন অনেকেই এবং অনলাইনে তাদের চিন্তার চর্চার ইতিবাচক দিক আছে। এটা ভালো যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ ধরনের একটা চর্চা এখন চালু হয়েছে- যদিও খুব সীমিত আকারে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীকাঠামোয়। মেয়েরা এখনো এদিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে।

তারপরও অনেকেই আছেন যারা সক্রিয়ভাবে তাদের চিন্তাভাবনার লিখিত রূপ আমাদের সামনে উপস্থাপন করছেন। যারা এভাবে লেখালিখির চর্চাকে 'অনলাইন-বিপ্লব' হিসেবে অভিহিত করে ব্যঙ্গ করতে চান তাদের মনে রাখা উচিত অনলাইন মাধ্যম আসার আগে এতোটুকু সুযোগও ছিল না। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছাড়া উঠতি তরুণ-তরুণীদের জন্য কাগজে ছাপা মাধ্যমে প্রবেশাধিকার দুঃসাধ্য-প্রায়। সেদিক থেকে অনলাইনে চিন্তাচর্চার একটা সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু এই লেখালিখি কিংবা চিন্তাচর্চায় সক্রিয় মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মধ্যে অভিযোগ করে থাকেন যে কোনো কোনো পুরুষ তাদের ছবি অথবা যেকোনো লেখায় অশ্লীল মন্তব্য করছে।

খোঁজ নিলে দেখা যায় যে এই মন্তব্যসমূহের মধ্যে অধিকাংশই কুরুচিপূর্ণ এবং তার মধ্যে খুব গাঢ় মাত্রায় প্রকাশিত লৈঙ্গিক বৈষম্যের ইঙ্গিত। অনেক সময় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই হয়তো ঐ মেয়েটির লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে সেটি নিয়ে রুচিবিগর্হিত মন্তব্য করা হয়। আমরা যারা নিজেদেরকে 'আধুনিক' অথবা 'প্রগতিমনা' বলে দাবি করি তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐ কুরুচিবানের উদ্দেশ্যে কিছু গালাগালি ছুড়ে দিয়ে নিজেদেরকে আরো বেশি আধুনিক কিংবা নারী-অধিকারের সপক্ষে সোচ্চার বলে প্রমাণের চেষ্টা চালাই। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ জাতীয় প্রচেষ্টার মধ্যেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত থাকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা- যেই একই মানসিকতার বশবর্তী হয়ে আরেকজন ব্যক্তি অশ্লীল ইঙ্গিত ছুড়ে দ্যায় সেই একই চিন্তাকাঠামোর করতলগত হয়ে আরেকজন 'প্রগতিবাদী' হয়তো ঐ মেয়েটির পাশে দাঁড়ানোর অভিনয় করে, নিজেকে মেয়েটির কাছে বীরপুরুষ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা থাকে তার মধ্যে। পার্থক্য হচ্ছে যে ব্যক্তি অশিক্ষিত অথবা স্থূল চিন্তার অধিকারী তার ক্ষেত্রে সেটার প্রকাশ ঘটে উৎকট পথে, অন্যদিকে যে কিছুটা পড়াশোনা করে এবং অন্য নানাভাবে নিজেকে 'আধুনিক মানুষ' হিসাবে 'প্রতিষ্ঠা' করেছে তার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটে মূল ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে।

একটা বল দেয়ালের দিকে ছুড়ে দেয়া আর সেটা সেখানে বাড়ি খেয়ে আবার ফিরে আসা একই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। কিন্তু একটি হচ্ছে দেয়ালের দিকে যাওয়া, আরেকটা সেখানে ধাক্কা খেয়ে উল্টো পথ পরিভ্রমণ। যে হাতের কারসাজিতে এই বিষয়টা ঘটে সেটা যদি দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে যায় তাহলে শুধু এই ক্রিয়া এবং তার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে বিভ্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা একটা বদ্ধ সমাজে বাস করি। এই বদ্ধতার পরমতম প্রকাশ ঘটে আমাদের মননে।

কেননা বিশ্বায়নের এই যুগে উন্মুক্ততা এবং উন্মত্ততার সব রকম উপাদান আমাদের চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো। আমরা গত শতাব্দের শেষ ভাগে 'টাইটানিক' চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী রোজের (কেট উইনস্লেট) চিত্রশিল্পী জ্যাকের (লিওনার্দো দিক্যাপ্রিও) সম্মুখে মডেল হিসেবে অবলীলায় বিবস্ত্র হবার দৃশ্য দেখে মনে মনে পুলক অনুভব করেছি। আবার সারবস্তু নাই জেনেও সাম্প্রতিক বলিউডি চলচ্চিত্র 'জিসম-২' দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছি পর্নো অভিনেত্রী সানি লিওনের শারীরিক কারুকার্যের প্রদশর্নী দেখবার আশায়। সিনেমা হলে ভেঙে পড়েছি 'ঘেঁটুপুত্র কমলা'য় জোতদারের বিকারগ্রস্থ যৌনলিপ্সা চরিতার্থকরণের ভেতর 'নির্মল' বিনোদন খুঁজবার প্রত্যাশায়। অথচ রাজপথে প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরে হেঁটে চলার দৃশ্যে আমাদের জিভে দুই পাটি দাঁতের গাঢ় কামড় পড়ে।

আর চুম্বনের ঘটনা হলে তো কথাই নাই। নৈতিকতার বোধ পুরোদমে মাথায় ওঠে। ''কেয়ামতের আর দেরি নাই'' বলে মস্তক নেড়ে হেঁটে যেতে যেতে পত্রিকা স্ট্যান্ডের সামনে 'অপরাধ চিত্রে'র প্রচ্ছদে চোখ বোলাবার বাসনায় কয়েক মুহূর্ত দণ্ডায়মান হই। এই বিষয়গুলো কেন ঘটে সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে। ওপরে যে কয়েকটা উদাহরণ দিলাম তার মধ্যে কারণ-নির্ণয়ের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্নভাবে লুকায়িত রয়েছে।

আমরা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের যৌন অবদমনের শিকার। এখানে 'আমরা' বলতে বোঝাচ্ছি আমাদের 'শিক্ষিত' পুরুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আমি নিজে এই শ্রেণীর একজন প্রতিনিধি। সুতরাং বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত। আমাদের সমাজে বহুবিধ প্রথা এবং সংস্কার আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।

একই সাথে তা প্রভাব ফ্যালে মানসকাঠামোয়। আমরা যখন দেশি-বিদেশি সাহিত্যে-শিল্পে-নাটকে-সঙ্গীতে-চটিতে-পর্নোগ্রাফিতে যৌনতার পরোক্ষ আস্বাদন লাভ করি তখন তার রক্তমাংসের অভিজ্ঞতা লাভের বাসনা অন্তর্লীনভাবে আমাদের মানসলোকে কাজ করে যায়। এই আকাঙ্ক্ষা সক্রিয় থাকে জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থায়- যার অধিকাংশ পরিণতি লাভ করে হস্তমৈথুন এবং স্বপ্নদোষে। কিন্তু সমাজ-নিয়ন্ত্রণকারী প্রথা, আচার, সংস্কার, বিশ্বাস, বদ্ধমূল ধারণা আমাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে এর অধিক অগ্রসর হতে বাধা দ্যায়। নীতি-নৈতিকতার দোহাই দিয়ে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক বন্ধুত্বের ধারণার ওপর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়া হয়।

সমাজের মুরুব্বি শ্রেণীর ব্যক্তিগণ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সরল মৈত্রীর চিত্র দেখতে পেলে বিরুদ্ধ-বাক্য উচ্চারণ করে থাকে। এর পরিণতিও অনেকাংশে ঘটে রসনা-নিয়ন্ত্রিত অপ্রত্যক্ষ যৌনচর্চার মাধ্যমে। ধার্মিক হিসেবে নিজেকে পরিচয়দানকারী বহু মানুষকে দেখেছি আমাদের দেশে তরুণীদের পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাক-আশাক পরিধান নিয়ে কথাবার্তা বলতে। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা যে বক্তব্য প্রদান শুরু করে তা শেষ অবধি পৌঁছায় মৌখিক ধর্ষণের পর্যায়ে। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে মানসিক অবদমনের এটাও আরেকটা রূপ।

যে ছেলে কোনোদিন সমবয়সী একটি মেয়েকে বন্ধু হিসাবে পাশে পায় নি, আরেকটা ছেলের মতোই তাকে তার কাজকর্মের সাথী কিংবা চিন্তাভাবনা বিনিময় করার উপযুক্ত সঙ্গী হিসেবে পাবার সুযোগ লাভ করে নি- সে যে মেয়েদেরকে যৌন মাংসপিণ্ড ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। একটা বয়স পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েদের একসাথে চলাফেরা ও খেলাধুলা সমাজের মুরুব্বিরা অনুমোদন করে। তবে সে বিষয়ে সীমারেখার দিকটিতে তারা তীক্ষ্ণ নজরদারি করে। অর্থাৎ শারীরিকভাবে পরিবর্তন কিংবা মনের মধ্যে যৌনচেতনার উন্মেষ ঘটতে পারে এমন সন্দেহের বয়সে তারা পরস্পরের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করিয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। অথচ ঐ সময়টা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরস্পরের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য বিষয়ে সুষ্ঠুভাবে জানার এবং পুরো ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিক ও উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার।

কিন্তু মুরুব্বিদের রক্তচক্ষুর শাসনে সে পথ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং ঐ বয়সের একটা ছেলে পরবর্তীতে তার অভ্যন্তরীণ তাগিদে দ্বারস্থ হয় সমবয়সী ইঁচড়েপাকা বন্ধুর; সেই সাথে পর্নো পত্রিকা ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার আগ্রহের জায়গাটিতে শূন্যস্থান পূরণের প্রয়াস চলতে থাকে। এক্ষেত্রে শারীরিক চাহিদার দাবিটিকে পূরণ করা হয় স্বমেহনের মাধ্যমে, নিজস্ব অভ্যন্তরে মাধুর্য আহরণের অদম্য আকাঙ্ক্ষার কাছে পরাভব মানে তথাকথিত নীতি-নৈতিকতা। পুরো বিষয়টিকে নেতিবাচক অর্থে পরিবেশনের জন্য একথাগুলো এভাবে বলছি না। বাস্তব চিত্রটিকে সামনে তুলে ধরাই এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য।

যদিও এটা নতুন অথবা অভিনব কোনো বিষয় না। সামাজিক অবদমনের পরিস্থিতি বজায় থাকার কারণে আমাদের সমাজে সমবয়সী একটি ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে যখন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তখনও তাদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব থেকে যায় অনেকাংশে। সীমিত হাসি-ঠাট্টায় দুয়েকটি কথাবার্তা উঠে এলেও যৌন-বিষয়ে সিরিয়াস কোনো আলোচনা তাদের মধ্যে হয় না বললেই চলে। এর মধ্যে কার্যকর থাকে অবদমন আর অপরাধবোধ। পুরো বিষয়টিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরিবর্তে প্রথা-নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিভঙ্গিই কাজ করে যায় প্রায় ক্ষেত্রে।

এটা ঘটে শুধু যে অর্ধশিক্ষিত চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত ছেলেদের বেলায় তা-ই নয়, শিক্ষিত ও উন্নতমনা বলে যারা পরিচিত তাদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে- যার পশ্চাতে আছে সামাজিক অবদমনের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ শ্রেণী ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ভেদে ভিন্নরূপ ধারণ করে। যে ব্যক্তি নিম্নসংস্কৃতির পরিচয় বহন করে তার চিন্তার প্রকাশ ঘটে মেয়েদের প্রতি স্থূল মন্তব্যের মাধ্যমে- যার একটা পরিচয় আমরা অনলাইনে দেখতে পাই মেয়েদের বিভিন্ন ছবি ও লেখার নিচের মন্তব্যে। অন্যদিকে যে নিজেকে রুচিবান হিসাবে দাবি করে সে তখন এর প্রতিবাদে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বাক্য উদগীরণের মাধ্যমে নারীবন্ধুটির কাছে নিজেকে বীর ও উদারনৈতিক হিসেবে প্রতিভাত করার চেষ্টা চালায়। উভয়ের চোখেই নারী পুরুষের চাইতে আলাদা জাত, তাকে সমপর্যায়ের কিংবা সমযোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গ্রহণ করে নিতে মনের ভেতর থেকে বাধা আসে।

নারী-পুরুষ পৃথিবীতে পদার্পণ করে মানবশিশু হিসাবে, যৌনাঙ্গ ব্যতিত অন্য কোনো প্রকার ব্যবধান না নিয়ে- কিন্তু লিঙ্গ-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, সমাজ, মন, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরবর্তীতে উভয়ের মধ্যে গড়ে দ্যায় পার্থক্য। এই পার্থক্যের বোধ জন্মানোর পেছনে কাজ করে আর্থ-সামজ-রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিকতায় আধিপত্যকামী স্বার্থ; যা হাসিলের অন্যতম হাতিয়ার পুরুষতান্ত্রিক আদর্শ- যা কিনা নীতি-নৈতিকতা, প্রথা, ধর্ম, আচার-সংস্কৃতির নামে সমাজের ওপর আরোপ করে অবদমনের অভেদ্য প্রাচীর। এই অবদমন মেয়েদের ভেতরে কীভাবে কাজ করে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার মেয়েরাই ভালো বলতে পারেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।