সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ক’দিন চলে গেছে; কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণে যে বেদনার্ত শোকের সৃষ্টি হয়েছিল দুই বাংলায় ভক্ত পাঠকের মনে তা এতটুকু ম্লান হয়নি। সাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুনীলের একটি বড় তাৎপর্য ছিল আমাদের কাছে যে, তিনি বাংলাদেশের একজন বড় সুহৃদ। তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল একটা আলাদা টান। সুযোগ পেলেই তিনি এখানে চলে আসতেন; বিশ্বায়নের এই প্রতিযোগিতার যুগে বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। রাজনৈতিক বিভাজন সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্য যে এক ও অভিন্ন এ কথা বার বার বলতেন।
এখন পশ্চিমবঙ্গে তাঁর মতো মানুষ বাস্তবিকই বিরল। তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্বের গুণে বাংলাদেশের প্রবীণ-নবীন অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন আর কেউ থাকল না, যাঁকে একবাক্যে আমরা সবাই ‘সুনীল দা’ বলে ডাকতে পারি; যিনি পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণকালে আমাদের যে কোন বিপদে কাছে এসে দাঁড়াবেন।
কয়েক বছর আগে মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলার ‘মাইঝপাড়া’ গ্রামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মভিটায় ‘সুনীল আকাশ’ নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে লেখকের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। জীবিত অবস্থায় একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে বড় ভাগ্য আর কী হতে পারে? মাইঝপাড়ার গ্রামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর উদ্যোগে কবির নিজ গ্রামে এই গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিবছর ‘সুনীল মেলার’ আয়োজন করা হয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে লেখকের জীবিত অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও বিশ্বের নানা স্থানে যে ভক্তচক্র গড়ে উঠেছিল; লেখক হিসেবে তা নিঃসন্দেহে তাঁর আকাশস্পর্শী সাফল্যের প্রমাণ বহন করে। তাঁর এ সাফল্য রাতারাতি আসেনি; প্রতিভা ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় তিনি তা গড়ে তুলেছিলেন। দেশ বিভাগের কারণে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া একটি অতি সাধারণ দরিদ্র উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান হিসেবে প্রায় শৈশব-কৈশোর থেকেই এক সংগ্রামী জীবন বেছে নিতে হয়েছিল সুনীলকে। মা মীরা গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের নিয়মিত পাঠক; মূলত তাঁর জন্যই পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই আনা নেয়া করতে হতো। মায়ের জন্য আনা বইগুলো সুনীলও পড়ে ফেলতেন; এর ফলে কিশোর বয়সেই তাঁর ভেতরের সাহিত্যবোধ অনেক বেশি রুচিবোধসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল।
একই সঙ্গে অভাবের সংসারে গরিব স্কুল শিক্ষক বাবাকে সহায়তার জন্য তিনি অতি তরুণ বয়স থেকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এভাবে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নানা বয়সের নানা ধরনের পরিবারের সংস্পর্শে আসেন, গড়ে উঠতে থাকে তাঁর বিচিত্র জীবন বোধ। তাঁর সৃজনশীলতাও এ ধরনের অভিজ্ঞতার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। বাবা স্কুলশিক্ষক কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় এক সময় পুত্র সুনীলকে ‘হোমটাস্ক’ হিসাবে টেনিসনের কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে দেন। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন।
কিন্তু এই কঠিন কাজ করতে গিয়েই সুনীল কবিতা লেখায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন; কবিতাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা একমাত্র লক্ষ্য ও সাধনা। লেখক তাঁর আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’-এ এসব কথা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। তাঁর জীবনকাহিনী পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূলতার কাছে তিনি যেমন পরাজিত হননি; তেমনই কোন লোভ-প্রলোভনই তাঁকে নীতিচ্যুত করতে পারেনি।
১৯৫৩ সালে সমবয়সী তরুণ কবিদের সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ করেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’। প্রথমদিকে বন্ধুদের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করলেও পরবর্তীকালে প্রায় সুদীর্ঘ চল্লিশ পঞ্চাশ বছর একাই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথম দিকে ‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশের বিষয়ে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন সিগনেট প্রেসের দিলীপ রায়। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে তরুণ সুনীল এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছিলেন, যার তাৎপর্য পরবর্তীকালে অনেক সুদূরপ্রসারী বলে বিবেচিত হয়েছে। এই সম্পাদকীয় তিনি তৎকালীন ‘পাকিস্তানের তরুণ বাঙালী কবিদের’ সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। তিনি এখানকার এসব কবিদের ‘আশ্চর্য সম্ভাবনাময়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। উল্লেখ্য, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় তরুণদের সাহিত্য আন্দোলন জোরদার হয়েছিল।
সে সময় ঢাকায় শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুর রশিদ খান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আল-মাহমুদ প্রমুখ প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবির আবির্ভাব হয়েছিল; পরবর্তীকালে এঁরা সবাই বাংলাদেশের সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁদের কেউ কেউ বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। যাই হোক, প্রথম থেকে সুনীলের মধ্যে পূর্ববঙ্গের প্রতি এক ধরনের টান পরিলক্ষিত হয়েছে। দু’দেশের রাজনৈতিক পার্থক্য সত্ত্বেও সর্বদাই এক ধরনের ‘নাড়ির টান’ তিনি অনুভব করেছেন বাংলাদেশের প্রতি।
পরবর্তীকালে সুনীল যখন কবিতা ও গদ্যচর্চার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে নিজেই রীতিমতো একটি ‘প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত হয়েছেন, তখনও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর টানে এতটুকু ভাটার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় নানাভাবে আমাদের সংগ্রামের সহায়তা করেছেন; একজন কলমযোদ্ধা হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এ সহযোগিতা ছিল খুবই আন্তরিক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা উপলক্ষে কিংবা শুধু বেড়াতে বাংলাদেশে নিয়মিত এসেছেন। তিনি যে বিদেশী তা আমাদের একবারও মনে হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে এক ও অভিন্ন এ কথা তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন।
সেই ১৯৮৪ সালে ঢাকার ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে প্রথম দেখেছিলাম সস্ত্রীক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে; তখন পঞ্চাশ বছর বয়সের সুনীলের মাথাভর্তি কালো চুল-দু’গালে সাদা জুলফি।
ধীরস্থির কিছুটা স্থূলকায় সুনীলের মধ্যে সেদিন এক গভীর আত্মবিশ্বাসী লেখককে আবিষ্কার করেছিলাম শুধুমাত্র লেখার জন্যই যেন তাঁর জন্ম হয়েছে। গত প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি অবিরত লিখে গেছেন নানা ধরনের কবিতা ও গদ্য। তাঁর লেখা ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা। সুনীলের উপন্যাস ‘সেই সময়’ কিংবা ‘পূর্ব-পশ্চিম’ নিঃসন্দেহে বাঙালী জীবনে কালজয়ী উপন্যাসের মর্যাদা পাবে। পৃথিবীর অনেক মহৎ সাহিত্যিকের মতো সব্যসাচী লেখক সুনীলের প্রকৃত মূল্যায়ন শুরু হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে।
মূল্যায়নের এ ধারা বজায় থাকবে বহুকাল।
মৃত্যুর কিছুকাল আগে সুনীল গঙ্গোপধ্যায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘কবি শামসুর রাহমান ছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। ’ এখন মনে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ইংরেজী ভাষার লেখক ও পশ্চিমা দেশের বাসিন্দা হলে অনেক আগেই তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য ‘নোবেল’ পেতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সুনীলের, দুর্ভাগ্য আমাদের। তবে সারাবিশ্বের পাঠক তাঁকে আগামী দিনে নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন।
বাঙালীর সম্প্রীতির লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতি অমর হোক।
Source: জনকন্ঠ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।