উৎসর্গঃআমার ফেলে আসা সোনালী দিনের অনেক প্রিয় গানের গীতিকার প্রিয় নিয়াজ আহমেদ অংশু ভাইকে । ।
বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের মাঝে কত যে মধু লুকীয়ে আছে তা হয়তো যুগের হাওয়ায় অতি আধুনিক মানুষদের জানা নেই। বাংলা গানের কথার মতো এতো বৈচিত্রময় হাজার হাজার অসাধারণ গান বিশ্বের আর কোন ভাষার গানে পাওয়া যাবেনা। মানুষের আবেগ নিয়ে কতভাবে কতরূপে অসাধারনভাবে খেলা করা যায় তা বাংলার লালন, হাসন, রমেশ শীল, দূরবীন শাহ, শাহ আব্দুল করিম থেকে শুরু করে স্বাধীনপরবর্তী বাংলাদেশের বহু গুণী গীতিকাররা বারবার, লক্ষবার প্রমাণ করে গেছেন ।
তাদের বহুজনকে আমরা পারিনি দিতে যোগ্য সম্মান, পারিনি তাদের মনে রাখতে। কতটা অকৃতজ্ঞ আমরা তা ভাবতেও লজ্জা লাগে। অথচ এই আমরাই ফেইসবুক, ব্লগে সারাদিন বিদেশী গান, ছবি ,শিল্পী ,গীতিকারদের গান , ছবি নির্লজ্জের মতো শেয়ার করে বেড়াই যেন ওরা আমাদের চাচাতো, মামাতো ভাইবোন নতুবা এই বাংলার কোন গুণীজন !!! খুব কষ্ট পাই ঐসব বিদেশী চাটুকারদের কাজ দেখে। মনে হয় যেন আমাদের দেশে কেউই নাই, কিছুই নাই । বিদেশী গান, ছবি আমারও ভালো লাগে , আমারও প্রিয় কিন্তু তাই বলে তা দেখিয়ে বেড়ানো না তাদের তুলে ধরতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগে না।
আমি আমার দেশের সেরাটাই অবিরত খুঁজে বেড়াই। তার মাঝেই সব সুখ খুঁজে পাই। মনটা ভীষণ ক্ষিপ্ত তাই হয়তো একটু বেশি বলে ফেললাম !! দুঃখিত। যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম এখন তা বলি ।
বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড এর গানের স্বর্ণযুগ আমরা ফেলে এসেছি গত শতাব্দীর শেষ দশকে।
যা পুরোটা দেখার ও উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল । সেই স্বর্ণযুগ পেয়েছি বলেই এখনও নিজের মনের ভেতরে কিছু শুদ্ধটা রয়ে গেছে। সেই শুদ্ধটা আমাকে পথ চলতে প্রেরণা দেয়।
সেই স্বর্ণযুগে আমরা যেমন পেয়েছিলাম আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ, নকীব খান, পিলু খান, নীলয়, আশিকুজ্জামান টুলু, শাফিন, টিপু, নাসিম আলী খান , সাঞ্জয়, চন্দন, ফজল, হাসান, সঞ্জীব, বাপ্পা,জুয়েল , আগুন এর মতো অসাধারণ দুর্দান্ত কণ্ঠ যারা সেই দশক জুড়ে আলো ছড়িয়ে গেছেন তাদের কণ্ঠের গান দিয়ে। তেমনি পেয়েছিলাম তাদের সেই গানগুলোর স্রস্টা লতিফুল ইসলাম শিবলি, বাপ্পি খান, নিয়াজ আহমেদ অংশু, শহিদ মোহাম্মদ জঙ্গী, প্রিন্স মাহমুদ দেহলভি, রানা, মাহমুদ খুরশিদ, জায়েদ আমিন, এঞ্জেল শফিক, তরুণ এর মতো অসাধারণ সব গীতিকারদের।
তাঁরা কত যে অসাধারণ সব কথার গান আমাদের একটির পর একটি উপহার দিয়ে গেছেন তা বলতে গেলে এই প্রজন্মের কাছে তা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র গল্পের মতো মনে হবে। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন স্বকীয় ও স্বতন্ত্র ধারার। তাঁরা আজ গান লিখেন না। অনেকে গান থেকে রয়েছেন দূরে। কিন্তু তাদের সেই গানগুলো রয়ে গেছে আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মনের মণিকোঠায় ।
গান থেকে দূরে থাকা তেমনি একজন অসাধারণ গীতিকার নিয়াজ আহমেদ অংশু যিনি আমাদের প্রজন্মের কাছে প্রিয় ‘অংশু’ ভাই হয়ে আছেন। অংশু ভাই অনেকদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সেই থেকে আর প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু , জুয়েল, বাপ্পা কারো কণ্ঠেই অংশু ভাইয়ের লিখা নতুন কোন গান পাইনা। সেই পুরনো গানগুলো শুনে শুনেই প্রিয় অংশু ভাইয়ের কথা মনে করি। ভীষণ মিস করি তাঁকে বর্তমান বাংলা গানের এই অস্থির সময়ে।
আজ আমি অংশু ভাইয়ের বিস্তারিত কিছু বলবো না , আজ শুধু উনার লিখা গানগুলোর মধ্য থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটি নিয়ে আমার অনুভূতির কথাগুলো বলবো।
৯০ দশকের শেষ প্রান্তে ৯৮/৯৯ এর দিকে প্রকাশিত হয় আইয়ুব বাচ্চুর সুর ও সঙ্গীতে ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘ময়ূরী’। যেখানে শিল্পী ছিলেন বাচ্চু, নকীব খান, নাসিম আলী খান, জুয়েল, টুটুল, ঝলক ও রঞ্জন। সেই অ্যালবাম এর তিন নম্বর গান প্রিয় কণ্ঠ জুয়েল এর ‘ছোট একটা ঢেউ’ গানটি প্রথমবার শুনেই অবাক হয়ে গেলাম গানটির কথাগুলো শুনেই ‘ বুকের ভেতর কাঁদে
অনেক চেনা কেউ
শ্যাওলা পুকুর জলে
ছোট্ট একটা ঢেউ
ভীষণ বিষাদে বুকের ভেতর কাঁদে
অনেক চেনা কেউ
ছোট্ট একটা ঢেউ’। ।
গানের কথাগুলো যেমন অদ্ভুত সুন্দর তেমনি গুণী আইয়ুব বাচ্চু সুরটাও করেছিলেন অসাধারণ আর জুয়েল এর কণ্ঠে গানটি অদ্ভুত অসাধারণ সুন্দর হয়ে পরিপূর্ণতা পায় ঠিক যেন কাচ কাটা হিরার মতো একটি নিখুঁত হীরা। অংশু, বাচ্চু ও জুয়েল তিন গুণী মিলে যে গানটি উপহার দিয়েছিলেন তার প্রশংসা করার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু একজন গানপিপাসু মানুষ হিসেবে বলতে পারি এমন একটি গান সারাজীবন শুনতে মন চাইবেই। সেই প্রথম যেদিন গানটি শুনি সেদিন গানটি কতবার যে ফিতা ঘুরিয়ে শুনেছি তার হিসাব নেই। এই গানটির মাঝে এসে বাকি গানগুলো শুনার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।
সেই থেকে গানটি প্রিয় হয়ে আছে। গানটির কথাগুলো নিয়ে কতরাত, কতদিন যে ভেবেছি তার হিসাব নেই। ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পাইনা। গানটির মাঝের অন্তরা ছিল –
সকাল দুপুর রাতে
আজ সুখের অসুখ
দুঃখ প্রিয় হাতে
ঢেকেছে কার মুখ
মনের বিবাদে মলিন ভুলের ফাঁদে
অনেক চেনা কেউ
ছোট্ট একটা ঢেউ । ।
মানুষ এতো সুন্দর করে নিজের ভেতরের কষ্টের কথা লিখতে পারে তা আমার জানা ছিলনা। পুরো গানটিই কোন এক নস্টালজিক মানুষের অসাধারণ অনুভূতি যার বুকের ভেতরে খুব চেনা, খুব কাছের কেউ ঘুরে বেড়ায় যাকে ভাবে সেই মানুষটির বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা ঢেউ এর সৃষ্টি করেছে। গানটির শুরুতে , মাঝে বারবার বাঁশির সুরটা গানটিকে অন্য একটা মাত্রায় নিয়ে গেছে। যা এক কথায় অসাধারণ, অসাধারণ ও অসাধারণ। গানের কথার সাথে বাঁশির সুরটা মিলেমিশে একাকার করে নিজের বুকের ভেতরে কেমন যেন নাড়া দিয়ে যায়।
পুরো গানটির কথা জুড়েই বারবার আপন , চেনা , কাছের মানুষকে না পাওয়ার এক হাহাকার ভেসে উঠেছে অন্যরকম এক সুন্দর অনুভূতিতে যার নাম ‘ছোট্ট একটা ঢেউ’। গানটির বয়স আজ ১ যুগেরও বেশি তবুও গানটি এখনও এতটুকু পুরনো হয়নি বরং আজকের প্রকাশিত যে কোন সেরা গানকে অনায়াসে পরাজিত করতে পারবে। এই গানের মাধুর্যের ধারে কাছে বর্তমান এর কোন গান নেই। সারাজীবন অংশু, বাচ্চু ও জুয়েল ত্রয়ীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকলাম এমন অসাধারণ একটি গান উপহার দেয়ার জন্য। আজো শুনি আর খুব মিস করি অংশু, বাচ্চু ও জুয়েল ত্রয়ীকে।
শুনুন প্রিয় সেই গানটি ঃ ছোট্ট একটা ঢেউ - জুয়েল
বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেরা গান ও ছবি পেতে ক্লিক করুন - বাংলার যাদুঘর
কবি কাব্য – ০১/১১/২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।