আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনীলের প্রস্থান পুরনো স্মৃতি

আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। লেখক হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যেমন তুলনা মেলা ভার তেমনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল তার নাম। সেই সুনীলের হঠাৎ মৃত্যু পাঠক মাত্রকেই করেছে বিচলিত। গত জুলাই মাসে তার বন্ধু ও বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ইন্তেকাল করেন।

এ দুই লেখকের মৃত্যু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা শিল্পে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। বহুমাত্রিক প্রতিভা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গত মঙ্গলবার মারা যান। গত বৃহস্পতিবার কলকাতায় সুনীলের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ফরিদপুরে তার জন্ম। ’৪৭-পরবর্তীতে কলকতায় থিতু হন সুনীল।

নয়া দিগন্তকে দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। সুনীলের জবানিতে উঠে এসেছে তার অনেক স্মৃতি। অন্তরঙ্গ আলাপন। সুনীলের সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো : কবি হয়ে ওঠা : সুনীলের বাবা তাকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে। তিনি তাই করতেন।

এটা করা হয়েছিল তিনি যাতে দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। তার কথায়Ñ ‘আমার বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত আমি তখন দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতাম। এটা বিরক্তির কারণ হয়ে গেল। তাই মাঝে মধ্যে কবিতার হেড লাইন ও প্রথম দিকের এক-দু’লাইন ঠিক রেখে নিজের মত লিখে ফেলতাম। দেখলাম বাবা কবিতা পড়েন না।

তিনি না পড়েই টিক মার্ক মেরে দেন। তাই এটা চালিয়ে গেলাম। পরে আমি মেয়েটাকে (যাকে পছন্দ করতেন) উদ্দেশ্য করে একটা কবিতা লিখি। সেটা পাঠাই কেমনে। পোস্টে পাঠালে দাদাশ্রেণীর কেউ পড়ে ফেলবেন।

সে সময় কলকাতায় এমন হতো। মেয়েদের নামে চিঠি এলে আগে দাদাশ্রেণীর কেউ পড়ে তারপর দেয়ার মতো হলে মেয়েটিকে দিতেন। তাই সেটা করা হলো না। ’ সুনীল বলেছেন, ‘আমরা সে সময় কলকাতায় রিফিউজি। কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় নেই।

কী করতে হয় তাও জানি না। পরে কবিতা দেশ পত্রিকায় পাঠালাম। মেয়েটা বিশ্বাস করল না এটা আমার কবিতা। বলল দেখেছ তোমার নামে নাম মিলে গেছে!’ সুনীল বলেন, ‘এখনো অনেকে আমাকে বলেন, কবিতা লিখতে হলে কী করতে হবে? আমি বলি, প্রেমে পড়ো। পড়ে ব্যর্থ হও।

সে জ্বালা থেকে কবিতা আসতে পারে। তা লিখে ফেলো। আমি ৫০-এর দশকের মানুষ। সে সময় ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা হতো না। কেবল বন্ধুর বোনের সাথে রোমাঞ্চ করার সুযোগ ছিল।

তাও আবার বন্ধুর বোনোর কাছে যাওয়া যেত না। যেতে হতো বন্ধুর কাছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে তার সাথে দুউ-চার কথা হতো। মেয়েটা খুব কবিতা মুখস্থ করত। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলত।

মেয়েটিকে খুশি করবার জন্য কবিতা মুখস্থ করা শুরু করলাম। তার পর লেখা। ’ মা চাইতেন আমি শিক্ষক ছাড়া অন্য কিছু হই : ‘সংসারে অভাব-অনটন ছিল বলে বাবা বলত, তাড়াতাড়ি পড়। চাকরি দরকার। তাই আমার ধারণা ছিল কেরানিগিরি করব।

নইলে আর কী? স্কুলের মাস্টার হবো। বড়জোর গ্রামের কোনো কলেজে পড়াব। কিন্তু দশ চক্রে ভগবান ভূত। আমার হয়েছে সে দশা। স্কুল-কলেজের চাকরি আমি করিনি।

আমার মা চাননি আমি শিক্ষক হই। আমার মা শিক্ষকতার বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। কারণ আমার বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। সে সময় ব্যাংকের পিয়নের চেয়ে মাস্টারের মাইনে কম ছিল। ’ সুনীল এভাবেই জানান তার মায়ের স্কুল শিক্ষকতা পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।

বলেন, ‘মা বলতেন দরকার হলে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাশে জুতো রেখে দু’চার টাকা দেয়Ñ ও কাজ করবে তবুও যেন শিক্ষকতা না করি। ’ তাই আমার শিক্ষকতা করা হয়নি। কেরানিগিরি করেছি কিছু দিন। আলু খেয়ে …. : সুনীল জানিয়েছেন, ‘বিশ্বযুদ্ধের সময় এক বছর স্কুল বন্ধ। সে সময় না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়।

তখন আমরা দিনের পর দিন আলু খেয়ে থাকতাম। বাজারে চালও ছিল না। যুদ্ধের সময় জাপানিরা ভারতের কাছে এসে পড়েছে। তারা মিয়ানমার হয়ে ভারতে এসে যাবে। জাপানিরা যেহেতু ভাত খায় তাই তারা বাজার থেকে সব চাল তুলে নিলো।

নদী থেকে নৌকা উঠিয়ে নিলো। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল এতে করে জাপানিরা ভাত পাবে না। কিন্তু আমরা কী খাব? সে চিন্তা করল না। গুদামে সে সময় লাখ লাখ টন চাল পচে গেল। দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে ভারতে।

অনেকেরই সেটা মনে আছে। তবে সে সময়ের অভিজ্ঞাতা আমাকে অনেক কাজ দিয়েছে। ’ খ্যাতিমান হয়ে ওঠার গল্প : তরুণ লেখক হিসেবে তেমন কোনো খ্যাতি ছিল না সুনীলের। কেবল লিখছেন। এমন সময় কলকাতায় এলেন পলেন।

বললেন ‘আমি তরুণ লেখকদের সাথে ভাব করতে চাই। ’ পলেনের আগে কলকাতায় এসেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি অন্য রকম সাহেব। চটি জুতো পরেন। ছেঁড়া জামা গায়ে দেন।

’ পলেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের হেড ছিলেন। তিনি তখন ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ঘুরছিলেন। যাদের সাথে কথা বলছিলেন। তাদের থেকে অনেককে তার গবেষণার কাজে লাগাচ্ছিলেন। সুনীল জানান, ‘সে সময় পলেন এলে তার সাথে কফি হাউজে আড্ডা হয়।

সবার সাথে মিশে তিনি ভারত থেকে চলে গেলেন। যখন তিনি ফিলিপাইন গেলেনÑ সেখান থেকে আমাকে চিঠি লিখেন। জানান আমি যাব কি না তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজি হয়ে গেলাম। স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেলাম আমেরিকায়।

আমার পিছু টান বলতে তেমন কিছু ছিল না। বিয়ে করিনি। আমার মা ছিলেন। ভাই বোন ছিল। সেখানে গেলাম।

আমার বিভিন্ন রকমের অভ্যাস হয়ে গেল। মদ খেতাম। মেয়ে মানুষের সাথে মেশার আগ্রহী ছিলাম। মিশতাম। একটা বিদেশী মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো।

মেয়েটি ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে জানত। ’ এক বছর পর পলেন সুনীলকে বললেন, তুমি দেশে কী করবে। আমাকে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিকের একটা চাকরি জোগাড় করে দিলো। ‘এখন আমার সবই আছে। সুরা আছে।

মেয়ে মানুষ আছে। বান্ধবী আছে। আমি থাকলাম। ’ পরে অবশ্য ফিরে এলেন সুনীল। তার কারণ, ‘ওই দেশে সবই আছে।

কিন্তু আমার মনে হলো সেখানে বসে বাংলাসাহিত্য হবে না। ’ ‘তাই চলে আসতে চাইলাম। আমার বিদেশী বন্ধু আমার সাথে আসতে চাইল। বললাম, আমি মেম বিয়ে করতে পারব না। পরে গরিবের ঘোড়া রোগ হবে।

মেয়েটি বলেছিল আমি কিন্তু ক্যাথলিক। হিন্দু বিয়ে করতে পারব না। এতে আমার বাবা-মা খুব কষ্ট পাবেন। তাই আমাদের বিয়ে নিয়ে এগোয়নি। ’ গদ্যকার … : সুনীল বলেছিলেন, অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাকে একটা বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে গেছেন চাকরি বাকরি করবে না।

কবি হলো ২৪ ঘণ্টার কবি। ওদের দেশে কবিতা পড়লে টাকা পায়। সম্মেলনে গেলে টাকা দেয়। আমাদের দেশে কবি সম্মেলনে গেলে একটা ঠাণ্ডা সিঙ্গাড়া আর এক কাপ চা ছাড়া কিছুই পায় না। ‘পরে গদ্য লেখা শুরু করলাম।

প্রতিদিন একটি করে গদ্য লিখতে চাই আমি। তা হয় না। একই নামে প্রতিদিন লেখা চলে না। তাই চারটি নামে লিখতাম। নীল লোহিত, সনাতন পাঠক, নীলপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

তখন গল্প লিখলে ১০-১৫ টাকা পাওয়া যেত। এসব লিখে মোটামুটি চলে যেত। ’ উপন্যাসিক হয়ে ওঠা : গল্প ও কবিতা লিখে বেশ কাটছিল সুনীলের দিনকাল। এর মধ্যে এক দিন দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাকে ডেকে বললেন, শারদীয় সংখ্যায় তোমাকে একটা উপন্যাস লিখতে হবে। ‘আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

গদ্য তো লিখেছি। উপন্যাস লিখতে হবে। দেশ পত্রিকায় লিখে নাম করতে পারলে ভালো। নইলে নির্বাসন। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম।

পরে জ্যাক নামে এক লোকের কথা মনে পড়ল। জ্যাকের অন দ্য রোড নামে একটা উপন্যাস ছিল। জনপ্রিয়। ’ ‘সে বলেছিল উপন্যাস লেখা খুবই সহজ। বলল তুমি একটা তারিখ ঠিক করে শুরু করলেই হলো।

তার কথা মনে রেখে আমি শুরু করলাম। গত রাতে কি কি করলাম তা দিয়েই শুরু করলাম। আমি লিখছি আর সাগরময় ঘোষ পিয়ন পাঠিয়ে দুই পাতা করে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার ভাগ্য এমনÑ পুরো উপন্যাসটা পড়ে কাটছাঁট করার সুযোগও হয়নি। পুরোটা না পড়ে শেষ করলাম।

আমার মনে হয়েছে উপন্যাসটা পড়ে সবাই বলবে ছি ছি। তুমি দেশ পত্রিকার এতগুলো পাতা নষ্ট করলে। সে সময় দেশে শারদীয় সংখ্যায় মাত্র একটি উপন্যাস বের হতো। ’ সুনীল জানান, ‘আমি ভয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেছি। পরে ফিরে এসে দেখি মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

তরুণ সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। পুরনোরা বলেছে ছি ছি এটা কী লিখেছে। তরুণদের নষ্ট করবে। ’ অতঃপর বিয়ে : সুনীলরা সে সময় একটা কবিতার কাগজ বের করতেন। নাম কৃত্তিবাস।

‘সে কাগজ বের করা হতো বিভিন্ন প্রেস থেকে। কারণ যে প্রেসে একবার যাওয়া হতো সে প্রেসে দ্বিতীয়বার যাওয়া যেত না। তার কাছে টাকা বাকি পড়ত বলে। শুধু তাই নয়, ওই সব প্রেস মালিকের সামনেও পড়তাম না। টাকা চাইবেন বলে।

একবার হলো কি নিউমার্কেটের সামনে এক প্রেস মালিকের সাথে দেখা। বললেন আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আপনি আমাদের সিনেমার পত্রিকার জন্য একটা উপন্যাস লিখে দেবেন। আমি ভাবলাম টাকা যেহেতু শোধ হবেÑ তাই এটা করে দিই। একটা উপন্যাস লিখে দিলাম।

দেয়ার জন্য দেয়া। সেটা সত্যজিত রায়ের চোখে পড়ে গেল। তিনি ফিল্ম করতে চাইলেন। ফিল্ম করলেন। তখন সবাই বললেন ছেলেটা কে?’ সুনীল বলেন, ‘তখন আমি আরেকটা প্রণয়ে পড়েছি।

বিয়ে করতে পারছিলাম না। সে সময় সত্যজিত রায় আমাকে চার হাজার টাকা দিলেন। সে টাকা দিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। কপালে যা থাকে। ’ বেড়াতে ভালোবাসতেন সুনীল : নাবিক হতে চেয়েছিলেন সুনীল।

জানান, ‘আমি নাবিক হওয়ার জন্য খোঁজখবরও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আমার খুব বেড়ানোর নেশা। পৃথিবীতে জন্মেছি বিশ্বটা দেখার জন্য। অথচ তা হবে না? এটা ভাবা যায় না।

এটা আমার সব সময় মনে হয়েছে। আমি আগেও ৫-১০ টাকা পকেটে এলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়তাম। আমার খুব নেশা ছিল। যখন আমি আমেরিকা যাওয়ার জন্য স্কলারশিপ পেলাম তখন খুব খুশি হয়েছি কারণ এত বড় একটা দেশ দেখতে পাব। আমেরিকা থেকে ফেরার সময় আমি গ্লোবাল টিকিট কিনেছিলাম।

সে টিকিট দিয়ে আমি ব্রিটেন, ফ্রান্স, প্যারিস ও মিসর গেলাম। কেবল বিশ্ব ঘুরে দেখার জন্যই আমি নাবিক হতে চেয়েছিলাম। এখন তো ঘুরছি। লেখক হয়েও ঘোরা যায়!’ ঘুরতে ঘুরতে জীবনের ৭৮টি বর্ষা চলে গেল। শেষ পর্যন্ত অক্টোবরের এক রাতে মহাকালের গর্ভে ঝরে পড়াল সুনীল নামের দীপ্ত এ নক্ষত্রটি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.