আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-যাঁর কবিতা উচ্চারিত হয়েছে সকল প্রেমিকের কণ্ঠে। কুর্নিশ তোমায়!!

পৃথিবীর বাধা-এই দেহের ব্যাঘাতে/ হৃদয়ে বেদনা জমে;-স্বপনের হাতে/ আমি তাই/ আমারে তুলিয়া দিতে চাই। একে একে ঝরে পড়ছে বাংলা সাহিত্যাকাশের নক্ষত্রগুলো। চলে গেলেন তেত্রিশ বছরের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালি এমন কোন প্রেমিকপুরুষ নেই যে তাঁর অবিসংবাদী কবিতা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেনি। ২৩ অক্টোবর রাত ২টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

মাত্র ৭৮ বছর বয়সে জননন্দিত এই সাহিত্যিকের মহাপ্রয়াণ হয়। পাঠকের হৃদয়ে তাঁর আসন চিরকাল রয়ে যাবে মধ্যগগনের মার্তন্ডের ন্যায় দেদীপ্যমান। জন্ম ও শিক্ষা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে। তাঁর পিতা কালিপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষক। তাঁর মায়ের নাম মীরা গাঙ্গুলী।

তিনি অর্থনীতি স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে। জীবনকর্ম: রবীন্দ্র-জীবনানন্দ উত্তর বাংলা কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক অসামান্য প্রতিভা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা কবিতায় চলছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব ও নব কাব্যভূমি অন্বেষণ। এক্ষেত্রে ‘কৃত্তিবাস’ সাময়িক পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন এই ‘কৃত্তিবাস’ লিটল ম্যাগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ।

‘কৃত্তিবাস’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। নতুর প্রজন্মের কবিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠেছিল পত্রিকাটি। কাব্যের আঙ্গিক, বিষয়, ছন্দ-শৈলী ও শব্দের নিরীক্ষায় সুনীল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা কবিতায় নব প্রেষণা উন্মাদনা। ষাটের মলয় রায় চৌধুরীদের বিখ্যাত ‘হাংরি জেনারেশনের’ সমর্থনও দিয়েছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিট কবি এলেন গিন্সবার্গের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশী শরণার্থীদের করুণ দুর্দশা দেখে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামক যে বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন তাতে তাঁর কথা উল্লেখ আছে। সুনীল ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। পুরস্কার ও সম্মান: 1972: আনন্দ পুরস্কার 1985: সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার 1989: আনন্দ পুরস্কার 2002: কলকাতার শেরিফ 2004: সরস্বতী সম্মান 2011: হিন্দু সাহিত্য পুরস্কার 2012: শেরে বাংলা লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার। ব্যক্তিগত জীবন: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সালে। তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে বোস্টনে বসবাস করছেন।

তাঁর সাহিত্যকর্ম: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বিরলপ্রজ সব্যসাচী লেখক। তিনি তাঁর সাহিত্যিক জীবনে প্রায় ২০০ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক ও কবি। কিন্তু তাঁর প্রথম ভালবাসা ছিল কবিতা। তাঁর ‘নিখিলেশ’ ও ‘নীরা’ কবিতার সিরিজ বাংলা কবিতায় অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সুনীলের ‘তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি রোম্যান্টিক কবি হিসেবে তাকেঁ বাঙালি পাঠক হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র গদ্যশৈলী নিয়ে আবির্ভূত হন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ (১৯৬৫) বের হওয়ার সাথে সাথেই তিনি সমালোচকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তবে এ উপন্যাসের ব্যাপারে ব্যাপক বিরুদ্ধ মতবাদও তৈরি হয়। উপন্যাসটি অশ্লীলতায় পূর্ণ দাবি করে কতিপয় প্রতিক্রিয়াশীল সুনীলকে হুমকি পর্যন্ত দেয়।

প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের ভয়ে লেখককে তাই কিছুদিন কলকাতার বাইরে অবস্থান করতে হয়েছিল। সুনীলের বেশকিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপ লাভ করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ সত্যজিৎ রায় এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সুনীলের ‘অর্জুন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বি’ ও ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে ছবি নির্মাণ করেন। সাম্প্রতিককালে সুনীলের উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ।

তাঁর অসাধারণ কবিতা ‘স্মৃতির শহর’ গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘ইতি মৃণালিনী’(২০১১) চলচ্চিত্রে। সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সেই সময়’ ১৯৮৫ সালে ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করে। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই দশকের অধিক সময় পর্যন্ত সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় ছিল। একই সত্য তাঁর ‘প্রথম আলো’ ও পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসদ্বয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাঙ্গন ও তৎপরিণতিতে মানব হৃদয়ের দহন প্রস্ফুটিত হয়েছে।

‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিশ শতকের প্রথম দিকের সময় থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত কাহিনী বিস্তৃত হয়েছে। ‘প্রথম আলো’ (২ পর্ব) একটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। এতে বাংলার নবজাগরণে প্রধান দুটি চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব ওঠে এসেছে। ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে বাউল সাধক লালন ফকিরের জীবন ও দর্শনের শিল্পভাষ্য। কিশোরদের জন্য লিখতে গিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র নির্মাণ করেন।

‘কাকাবাবু’ চরিত্রটি সমগ্র বাংলা কিশোর রচনা সম্ভারে সুনীলের প্রাতিস্বিকতার এক ভিন্নরূপ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিভিন্ন ছদ্মনামেও লিখতেন। নীললোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপfধ্যায় ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রচনাসম্ভার: উপন্যাস: তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। ১৯৬৫ সালে দেশ পত্রিকায় প্রথম এটি প্রকাশ হয়।

তাঁর অন্যান্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে: ২. অরণ্যের দিনরাত্রি ৩. সেই সময় ৪. রক্ত ৫. অর্জুন ৬. পুরুষ ৭. অগ্নিপুত্র ৮. সরল সত্য ৯. ব্যক্তিগত ১০. প্রতিদ্বন্দ্বি ১১. মহাপৃথিবী ১২. রক্তমাংস ১৩. পূর্ব-পশ্চিম (দুই পর্ব) ১৪. জীবন যে রকম ১৫. একা এবং কয়েকজন ১৬. অর্ধেক মানবী ১৭. প্রথম আলো (দুই পর্ব) ১৮. নিঃসঙ্গ সম্রাট ১৯. রানু ও ভানু ২০. মনের মানুষ-বাউল সাধক লারন ফকিরের জীবন ও দর্শন নিয়ে এ উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। কাকাবাবু সিরিজ : কাকাবাবুকে নিয়ে সুনীল প্রায় ২৩টি সিরিজ গ্রন্থ রচনা করেছেন। কবিতাগ্রন্থ: ১. হঠাৎ নীরার জন্য ২. ভোরবেলার উপহার ৩. শাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে ৪. সেই মুহূর্তে নীরা ৫. কায়দাটা শিখে নেবে আজ বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ৮৩তম জন্মদিন। এইদিনে চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের বিদগ্ধ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্রদ্ধা ও কুর্নিশ দুই কান্ডারীকে! তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন জার্নাল।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।