জাতিসংঘ শান্তি মিশন হঠাত করে বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের সোমালিয়া থেকে পালিয়ে আসতে হচ্ছিল। পালিয়ে আসার কথা বলছি এ কারণে যে মিশন শেষ হবার খবর চাউর হতেই বিদ্রোহীরা এয়ার পোর্ট এবং আশে পাশের এলাকা দখল করে নিয়ে ছিল। আমাদের উপর সোমালীদের পূর্ণ আস্থা থাকলেও তারা ঘৃণা করত মার্কিনীদের। ১৯৯৫'র ফেব্রুয়ারিতে US Marine ২য় বারের মত মোগাদিসু বন্দরে নোঙর ফেলার সপ্তা’ দুয়েকার মধ্যেই বহুজাতিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এয়ারপোর্ট। বিমানের বদলে আমরা US Marine এর নিরাপত্তা প্রহরায় একটি ছোট্ট জাহাজে মোগাদিসু ত্যাগ করি।
সোমালিয়ায় পরদিন ঈদ। তার মানে বাংলাদেশে ঈদ হতে আরও দু’দিন বাকী। বিদ্রোহিদের বৈরিতা, জীবনের প্রথম সমূদ্র যাত্রার সম্ভাব্য বিপদ, সাঁতার না জানার ভয় সব ছাপিয়ে দেশে ফিরে আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করাটাই মুখ্য হয়ে ঊঠেছে। আমাদের সমূদ্র যাত্রা শেষ হবে তাঞ্জানিয়ার দার এস সালামে। সেখান থেকে আকাশ পথে ঢাকা।
সূর্য ওঠার আগেই নোঙ্গর তুললো আমাদের জাহাজ। দার এস সালাম তাঞ্জানিয়ার রাজধানি আর পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর। যাত্রা পথে আমাদের ছুঁয়ে যেতে হবে মোম্বাসা, জাঞ্জিবারের মত সব ট্যুরিস্ট স্পট। মোগাদিসুর দক্ষিনে প্রায় দেড়দিনের দূরত্বে (১২০০ কিঃ মিঃ) দার এস সালাম। কাজেই যাত্রা পথে সাগরের বুকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার বিরল সুযোগ পাওয়া গেল, সেই সাথে রইলো স্বজনদের সাথে ঈদ করার সম্ভাবনা।
সব মিলিয়ে হঠাত করেই দারুন এক সমুদ্র যাত্রা শুরু হল আমাদের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্র যাত্রার ভীতি কেটে গেল। কক্সবাজারে দেখা বঙ্গোপসাগরের ঢেঊএর তুলনায় ভারত মহা সাগরকে প্রায় নিস্তরঙ্গ লাগছিল (এই অনুভূতি আমার পরবরতীতে আটলান্টিকের পাড়ে গিয়েও হয়েছে)। নিচের দিকের কেবিনে আমাদের বেশ কয়েকজন সহযাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেও অন্যদের চোখে মুখে ছিল আনন্দের ছাপ। সেদিন আমাদের ৩০ রোজা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তাঞ্জানিয়া পৌছাতে পৌছাতে পরদিন সন্ধ্যা। হিসাব অনুযায়ী জাহাজেই আমাদের ঈদ শুরু হবার কথা। অনেকেই চিন্তায় পড়ে গেলেন ঈদের জামাত নিয়ে। জাহাজে ঈদের জামাত হয় কীনা সে বিষয়েও বিস্তর আলোচনা শোনা গেল। আর আমদের অনেকি ভাবছিলাম পর পর দুই দিনে দুই দেশে ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতাও মন্দ হবে না।
মাঝরাতে জাহাজ ভিড়লো মোম্বাসায়। রি ফুয়েলিং কিম্বা অন্য কোন বিষয়। যাত্রীদের নামতে দেওয়া হল না। নেমে খুব একটা লাভও হত না। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এত রাতে নাইট ক্লাব ছাড়া অন্য কিছু খোলা থাকে না।
মোম্বাসার সাফারি পার্ক কিম্বা কুমিরের খামার মাম্বা ভ্যালি তো খলা থাকার প্রশ্নই আসেনা। দুই আড়াই ঘন্টা পর আবার যাত্রা শুরু হল। চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে কাটালাম বাকী রাত।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। দেশে না গেলেও সত্যিকার অর্থেই আজ আমাদের ঈদ।
একটা মাস রোজা রেখেছি ঈদের কথা ভেবে, হোক না সে অন্য দেশে অন্য কোথাও। তাই বলে জাহাজে !
ঈদের সকালের যে আলাদা একটা মজা থাকে, তার কোন কিছুই নেই এখানে। ছোট বেলার ঈদের কথা আমি ভুলতে পারি না। প্রতি ঈদের দিনই আমার ছেলে বেলার কথা মনে হয়। আমাদের ৯ জনের সংসার।
ছেলেরা সবাই কল পাড়ে ভিড় করছে । আব্বার হাতে মোড়ক খোলা নতুন সাবান, নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য ছুঁয়ে যাচ্ছে যশোর শহরে আমাদের বাসার উঠোন, কল পাড়। আমরা ছোটরা শীত উপেক্ষা করে ধোয়া ওঠা গরম পানির হাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। কে, কার আগে গোসল করবে সেই প্রতিযোগিতা। ( আমার শৈশবে বেশির ভাগ ঈদই হত শীত কালে।
১৯৭১ এ ঈদ হয়ে ছিল ২১ এ নভেম্বর, তার মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি ৮ বছরের হলাম) ।
মন খারাপ করা সকালটা হঠাত করেই বদলে যেতে লাগল একটু একটু করে। ভারত মহা সাগরে একটা চমতকার সূর্যোদয় দেখে মন ভাল হয়ে গেল অনেকটাই। আকাশে মেঘ আর সাগরে কুয়াশা না থাকায় সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ। ব্রেক ফাস্টের সময় জাহাজের কয়াপ্টেন এলেন ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে।
ভদ্রলোক তাঞ্জানীয় মুসলমান। জাহাজে জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে দেশে ঈদ করতে পারেন নি গত দুই বছর। এবার যদিও দেশে ফিরছেন ঈদের দিন, তবে বৌ বাচ্চার কাছে কাছে পৌছাতে পৌছাতে মাঝ রাত হয়ে যাবে।
আমরা যখন জাঞ্জিবার পার হচ্ছি সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আফ্রিকার ট্যুরিস্ট স্পট গুলির অন্যতম জাঞ্জিবার আইল্যান্ড।
জাহাজ থেকে অপরূপ লাগছিল দ্বীপ দেশটিকে। । পেছনে কিলিমাঞ্জারো পাহাড় দ্বীপের সবুজ বনানী আর সামনের নীল সমুদ্র এই দ্বীপটিকে করে তুলেছে অনন্য। যারা পাহাড়, সমুদ্র, সাফারি পার্ক পছন্দ করেন। সারফিং করে কিম্বা মাছ ধরে অবসাদ কাটাতে চান তাদের জন্য আদর্শ হলিডে স্পট জাঞ্জিবার।
দার এস সালাম পৌছাতে পৌছাতে তাঞ্জানিয়ায় ঈদের উৎসব প্রায় শেষ। রাত বেজে গিয়েছে ৯টা। আমাদের দুর্ভোগেরও শুরু তখন থেকেই। তাঞ্জানিয়া আমাদের মতই উন্নয়নশীল দেশ। বিদ্যুৎ এর যাওয়া আসা তাদের নিত্যকার সমস্যা।
লোডশেডিং এর কারণে প্রায় কিছু না দেখেই সমুদ্র বন্দর থেকে বাসে চরে এয়ারপোর্ট এলাম। এয়ারপোর্টে নিয়মিত যাত্রীর ভীড়, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি কারণে আমাদেরকে সারারাত এয়ারপোর্টে কাটাতে হল। লাঊঞ্জে নয়। এয়ারপোর্ট বিল্ডিং এর লাগোয়া দুটি ছোট্ট ঘরে শ’দেড়েক লোক কিভাবে কাটিয়েছিলাম এত দিন পর মনে করতে পারছি না। তবে খুব একটা গায়ে লাগেনি একটি কারণে।
ভোর ৬টায় ছাড়বে আমাদের প্লেন তার পরে ৬ ঘন্টায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে তখন বিকেল ৩টা। ঈদের অর্ধেকটাই বাকী। তাড়া হুড়োয় যদিও উপহার কেনা হয়নি কারো জন্যেই, তবুওতো ঈদের দিন ঘরে ফেরা! এয়ারপোর্টে প্রিয়জনের মুখই বা উপহার হিসাবে কম কী?
এসব চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটলো আমাদের। সকাল ৫টায় খবর এল প্লেন ছাড়তে দেরি হবে।
একটু দমে গেলেও হতাশ হলামনা আমরা। প্রবাস জীবনে দীর্ঘ দিন অভ্যস্ত হবার আগ পর্যন্ত বাঙালিরা ছোট খাটো সময়ের হেরফেরে বিচলিত হয় না। ৭টা বেজে গেল, প্লেন এলো না। এ সংক্রান্ত খবরও পাওয়া গেলনা। ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করতে থাকলো আমাদের কে।
উতকন্ঠিত হয়ে পড়লাম আমরা সবাই। ৮টার সময় জানাগেল চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলে পড়েছে আমাদের ফ্লাইট স্কেজ্যুল। আমাদের ফেরার কথা জাতিসংঘের ভাড়া করা বিমানে। চুক্তি অনুযায়ী লেবাননের বিমান এসেছিল আমাদের জন্যে। সন্ত্রাসবাদীদের সাথে লেবানন সরকারের আঁতাতের অজুহাতে বিমানটিকে অবতঅরণ করতে দেওয়া হয়নি।
আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়তে লাগলাম। সোমালিয়া ছাড়ার আগে শেষবারের মত ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। Zia International Airport এ অপেক্ষা করছে আমার স্ত্রী দীপা। আমার মত অবস্থা আরও অনেকেরই। বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা করা হচ্ছিল পরিস্থিতি অনুকুলে আনার।
সমস্যার সমাধান হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ল বিকেল সাড়ে তিনটায়। বাংলাদেশে ততক্ষ্ণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।
আমরা ঢাকায় পৌছলাম রাত একটায়। ঢাকা শহরে তখন ঈদ বুড়িয়ে গেছে।
দীপার মত অনেকেঈ এয়ারপোর্ট থেকে ফিরেছে চোখের পানি মুছতে মুছতে। দেড়টার দিকে বাসায় পৌছে দেখি বাতি জ্বলছে আমাদের ঘরে। আমাকে দেখার পর দীপার কান্না ভেজা চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও বিষাদ থেকে ধীরে ধীরে ফুটে ঊঠলো আনন্দ উচ্ছাস। এতদিন পরও হাসি কান্নায় মাখামাখি সেই মুখতাকেই মনে হয় ঈদের সেরা উপহার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।