আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেচে থাকার লড়াই ---- হাসপাতাল সুখে দুখে - ঘটনা: ৫

হাসপাতাল আসলে এমন একটা জায়গা যেখানে নিত্যনতুন মানুষের আসা যাওয়া। ভাল মন্দ রাগ অভিমান ভালবাসা ঘৃনা মিশ্রিত হাজার কাহিনি সেখানে। কত বলব...! কাহিনি শেষ হবার নয় আগের ঘটনা: ঘটনা-৪: ঘটনা-5: রোগীর নাম- টুশি বয়স- ২১ বছর অভিভাবক- স্বামী ( সেটাও পিচ্চি , ২১ বছর বয়স) ঘটনা: টুশি মেডিকেল এ ভর্তি হয় বিশাল পেট , ৪০ সপ্তাহের প্রেগনেনসি, কিন্তু লেবার পেইন উঠেনি এরকম সমস্যা নিয়ে। তার স্বামী ই তাকে মেডিক্যাল এ নিয়ে আসে। " সাথে মহিলা কেউ নেই? " "না কেউ এখনো আসেনি।

আমার শাশুড়ী আসতে পারে। " ছেলেটি বলল। "দেখুন আপনার স্ত্রীর লেবার পেইন তো উঠেনি। এভাবে রেখে দিলে বাচ্চার জন্য খারাপ হবে। সিজার করা লাগবে।

" " হমমম। সিজারে কেমন খরচ লাগবে?" " কম করে হলেও ৭০০০, সাথে ওষুধ আলাদা, বেড ভাড়া আলাদা, আবার বাচ্চা খারাপ হলে এন আই সি ইউ তে রাখতে হলে ওখানে আবার প্রতিদিন ৫০০০ টাকা লাগবে" সিস্টার বলল। আমি ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আহারে নিরিহ বাচ্চা ছেলে একটা। দেখলেই ছোটভাই মনে করে মাথায় হাত বুলি্যে আদর করে বলতে ইচ্ছা হয় ভাল করে লেখা পড়া কর।

কিন্তু কিসের কি! সে এখন চিন্তিত কিভাবে তার স্ত্রীর সিজার করবে। টাকা কোথায় পাবে। এত খরচ চিকিতসার! সাধারন মানুষের ধরা ছো্যার বাইরে! আর এ বাচ্চা ছেলেটা তো এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে! চিন্তিত ছেলের মুখ। "কিছু কি বলবেন আমাকে?"আমিই এগিয়ে গি্যে জিজ্ঞেস করলাম। " আপা সিস্টার যা বলল....খরচ তো অনেক বেশী।

আমার কাছে ১০ হাজার টাকা আছে। কিন্তু এন আই সি ইউ র খরচ তো আমি চালাতে পারবোনা। " আহারে মায়া লাগল ছোট ভাইটার জন্য। কি করা যায়!! আমি স্বান্তনা দিলাম " এন আই সি ইউ লাগবেই এমন কোনো কথা নেই। পরে লাগতে পারে তাই আমরা আগে থেকে পেশেন্ট পার্টিকে জানিয়ে রাখি।

" " আপা প্লিজ দেখেন যেন না লাগে। " ছেলেটি কাতর কন্ঠে অনুরোধ করে। আহারে এভাবে আমার ভাই কোনো আবদার করলে তো আমি যেভাবেই হোক পুরন করতে বাধ্য থাকিব। কিন্তু বাচ্চার অবস্থা খারাপ হওয়া না হওয়া যে আমার হাতে না ভাই আমার! আমি মনে মনে দোয়া করতে থাকি যেন এন আই সি ইউ এর মত টাকা গ্রাসকারী সিস্টেমে আমার ভাইকে যেতে না হয়। আল্লাহ তুমি দোয়াটা কবুল কর।

ম্যাডাম এর জন্য অপেক্ষা করছি। পেশেন্ট ওটি টেবিলে শোয়ানো। এনেসথেশিয়া চলে এসেছে। আমি রেডি হব। ভাবলাম যাকে মনে মনে ভাই এর মত ভাবছি তাকে একটু জেনে নেই।

জিজ্ঞেস করলাম - শুনেন আপনার বয়স অনেক কম মনে হচ্ছে। সাথে কোনো বড় অভিভাবক আসেনি। হাতে টাকা পয়সাও তেমন নেই। কোনো অভিভাবক সাথে থাকলে ভাল হত। ছেলেটি বলল- আসলে আপা আমরা ১১ মাস আগে বিয়ে করেছি।

কেউ জানতো না। ও প্রেগনেন্ট হয়ে যাওয়াতে ওর বাসায় সবাই বুঝে ফেলে। ওর বাসা রাজশাহী। আমার নাটোর। আমি ওর বোনের কাছে থেকে খবর পেয়ে রাজশাহী যাই।

ওর বাবা মা আমাকে যা তা বলে অপমান করে। ওরা এবরশন করাতে চায়। আমি এবরশন মানতে পারলামনা। আমি অপমানিত বোধ করি। পরদিন ওর বোনের সহায়তায় ও বাসা থেকে বের হয়।

আমরা ঢাকা চলে আসি। সুতরাং কোনো অভিভাবক আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমার বাবা মা নেই। আমি ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। গত বছর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আমরা একটা.কলেজে অনার্স এ ভর্তি হয়েছি।

পরিচয়ের ২ মাস পরেই বিয়ে করি। বিয়ের পর পরই ও প্রেগন্যানট হয়ে যায়। ওর বড় ২ বোনের বিয়ে বাকি। এসবের জন্য আমাকেই দায়ী করা হয়। যাইহোক।

ঢাকা এসে কিছুদিন আমার এক আপার বাড়িতে ওকে রাখি । তারপর একটা বাসা নেই। আমি টিউশন করতাম আগে থেকে। এখন টিউশন বাড়িয়ে দি্যেছি। কিন্তু তারপরও দেখেন খরচ চলেনা।

মাসে সাত হাজার টাকা আমি সব মিলিয়ে পাই। এবার টিউশনের জায়গাতে আগে থেকে বলে কয়ে টাকা নিয়ে রেখেছি। আমার এক বন্ধু আসবে ও কিছু টাকা ম্যানেজ করেছে। এটাই আমার সম্বল। " হমমম তবু ভাল.... কিছু সম্বল আছে হাতে।

তবে ছেলেটির জন্য গর্ব হল আমার। হয়ত চিন্তা না করে অসময়ে বিয়ে করে ফেলেছে। বাচ্চাও হচ্ছে একটু দুরাবস্থার মধ্যে। কিন্তু দ্বায়িত্ব নেয়ার যে মানসিক সাহস এবং ভালবাসাকে সন্মান জানানোর দৃঢ়তা তা আমাকে মুগ্ধ করল। এরাই প্রকৃত মানুষ।

প্রকৃত পুরুষ। যাই হয়ে যাক না কেন আমি দ্বায়িত্ব নিব..তোমাকে ছেড়ে যাবনা। একসাথে লড়াই করব। ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করব। তুমি পাশে থাকলে হারবনা।

ওর প্রতি সন্মানে আমার মাথা নিচু হয়ে আসল। আসলে দ্বায়িত্ব নেয়ার জন্য বিত্ত নয়....মানসিক শক্তি ও ইচ্ছা জরুরী। ডেলিভারী হল। ছেলে বাবু একটা। সুস্থ বাচ্চা।

এন আই সি ইু লাগবেনা। ওফ আল্লাহ! বাচালে। আমি নিজেই কেন যেন এন আই সি ইউ টাকার কুয়ার কথা ভাবলে অসহ্য হয়ে যাই। আমার প্রথাম ঘটনাতেও দেখবেন, ওখানে লেখা আছে। বাচ্চা নিয়ে একজন খালা বাবার কাছে গেল।

আমি দেখলাম ছেলেটার মুখে কি তৃপ্তির হাসি। ছেলেটির বন্ধু এর মধ্যে চলে এসেছে। সেও হাসছে। " চাচু চাচু আমাকে দেখ" । খালা বলল "নেন আপনার বাচ্চাকে কোলে নেন"।

ছেলেটা বলে " এইটুকু একে কেমনে কোলে নিতে হ্য় ..। আমি কোনোদিন এত পিচ্চি কাউকে কোলে নেই নি। আমার ভয় করে। " আমার শুনে এমন হাসি পেল। আমি এগিয়ে গেলাম।

খালার কাছে থেকে বাচ্চা আমি কোলে নিলাম। বললাম এভাবে কোলে নিবেন। ছেলেটা এদিক ঘুরে ওদিক ঘুরে অনেক চেষ্টা করে কিন্তু বাচ্চা সাইজ করে কোলে নিতেই পারেনা। হা হা !এমন হাসি পেল আমার। সাথের বন্ধু টিও হাসছে।

বলে " দোস্ত বেশী পাকনা হলে এরকমই হয়। অকাল পাকনা" কিযে আশ্চর্য এই সুখ তাই না! দোয়া করি ভাই তোমার বাচ্চাটা যেন অনেক ভাল থাকে। অনেক বড় হোক। প্রধানমন্ত্রী হোক, নাহলে প্রেসিডেন্ট হোক, নাহলে বিজ্ঞানী হোক, নাহলে পাইলট হোক, নাহলে ইনজিনিয়ার হোক, ডাক্তার হোক, শিক্ষক হোক, প্রফেসর হোক......অনেক বড় হোক ভাই তোমার সন্তান, অনেক বড় হোক। সন্তানকে মায়ের পাশে দেয়া হল।

সদ্য বাবাও ভিতরে ঢুকল। বাবা হাত ধরল মায়ের। মাঝে বাচ্চা। আহ! বেহেশত যেন! বেহেসতে এ দৃশ্য থাকবে। এই দৃশ্য সহ্য করা যায়না।

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!! বিধাতা এত সুখ কেমনে সহ্য করেন কে জানে! বাইরে আসলাম...ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে!! বিধাতা ঘরে ঘরে এই সুখ দাও যাতে মেঘ গর্জন করে বৃষ্টি নামে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরে। বৃষ্টির জলে ভেসে যাক, বৃষ্টির শব্দে ম্লান হয়ে যাক পুরোনো কান্না। পৃথিবী আসলে অনেক সুন্দর!!! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.