"কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরিয়া গেছে.। "
জাগো বাংলাদেশ জাগো
জামদানি শাড়ি : জামদানি" নামটা কে না জানে? আমি জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে মাকে একটা জামদানী শাড়ি দিয়েছিলাম। প্রাচীন ঢাকাও এর আসেপাশের তাঁতিদের নিপূন হাতের বুননে তৈরি সুক্ষ্ম ও মসৃণ তাঁত বস্রের নাম ছিল ঢাকাই মসলিন। বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের পাতা কিংবা বিশ্ব বয়ন শিল্পের ইতিহাস উল্টালেই এর পরতে পরতে উঠে আসে ঢাকাই মসলিনের যশগাঁথা। প্রাচীন রাজ পরিবারের রমনীদের অত্যন্ত লোভনীয় সামগ্রী ছিল ঢাকাই মসলিন।
এই মসলিন বস্ত্রের উত্তর সংস্করণ হল ঢাকাই জামদানি যা একান্তই বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় প্রাচীন বাংলার ২০০০ বছরের পূরনো সুক্ষ্ম বস্ত্র বুনন কৌশলের ফিউশন হল জামদানি। জামদানির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের (চানক্য)অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে। এছাড়া পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বইতেও জামদানীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্যের বইতে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে।
নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তার গ্রন্থ স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে রুমি নামের রাজ্যে সূক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার বর্ণনা অনুসারে বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও এলাকাস্থিত সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। যোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ঢাকার মসলিনের প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশের ঢাকা জেলাতেই জামদানি চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।
ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। ইউরোপীয়, ইরানী, আর্মেনিয়ান, মুগল, পাঠান প্রভৃতি বণিকেরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানেরাও এই শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।
ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায় মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারীগরদের নিবন্ধন করে রাখা হত। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় একলক্ষ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মোঘল দরবারে রপ্তানি করা হত।
১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দিল্লীর বাদশাহ, বাংলার নবাব ও জগৎ শেঠের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনা হয়।
এছাড়া ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণ প্রায় নয় লাখ টাকার মসলিন কেনে। গবেষক ফোরবেস ওয়াটসন তার বিখ্যাত "Textile Manufactures and Costumes of the people of India"গ্রন্থে উল্লেখ করেন জটিল ছাপচিত্রের কারণে নকশাদার মসলিন ঢাকার বস্ত্রপন্যের মধ্যে সবচেয়ে দামী ছিল।
কাজেই এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জামদানি শাড়ি একান্তই বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সম্পদ। কালের প্রতিঘাতে কিংবা যন্ত্রশীল্পের বিকাশে নানা প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে যদিও জামদানীর সেই পূরনো জৌলুস আজ আর নেই তথাপী জামদানী একেবারে হারিয়ে যায়নি। আজো বাংলা সহ সারা বিশ্বে জামদানি লোভনীয় মূল্যবান বস্ত্র।
বাংলার তাঁতীরা আজো নিরন্তর বুনে চলছে জামদানি। ঢাকার মিরপুরে জামদানি পল্লী স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামদানির চাহিদা এখনও রয়েছে। বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশের এই শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। বাংলার তাঁতিরা জামদানির পুরনো দিন ফিরিয়ে আনার মানসে একাগ্র।
নকশী কাঁথা : আমি যখন সৌদি আরব যাই তখন মা তার পরনের পূরাতন কাপড় দিয়ে বুনা একটি নকশী কাঁথা সঙ্গে দিয়েছিলেন। সেই নকশী কাঁথা আমার রুমে যে বিদেশী এসেছে তারই নজর কেড়েছে। আর যখনই সে শুনেছে যে এই অনন্য সুন্দর কর্মটি কোন যন্ত্র ছাড়া বাংলার মেয়েদের হাতে সাধিত হয়েছে তখনই সে অবাক হয়েছে এবং বাংলার মেয়েদের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়েছে। এসব বিদেশীদের মধ্যে পাশের দেশ ভারতের মুম্বাই, দিল্লি সহ নানা অঞ্চলের লোকও ছিল।
সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের পর এর উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুঁটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন নঁকশা যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি।
নকশি কাঁথা বাংলাদেশের সংস্কৃতির তথা সমৃদ্ধ লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতীদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে সেই সুতা দিয়ে নকশী কাথা সেলাই ও নকশার কাজ করা হয়। সাধারণত গ্রামের মহিলারা তাদের অবসর সময় নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময়, এমনকি ১ বছর সময়ও লেগে যায়। নতুন জামাইকে বা নাত বউকে উপহার দেয়ার জন্য নানী-দাদীরা নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন।
এক একটি কাঁথা সেলাইয়ের পিছনে অনেক হাসি-কান্নার কাহিনী থাকে। বিকেল বেলা বা রাতের খাবারের পর মহিলারা একসাথে বসে গল্প করতে করতে এক একটি কাঁথা সেলাই করেন। তাই বলা হয় নকশি কাঁথা এক একজনের মনের কথা বলে। নকশী কাঁথা বাংলার গ্রামীন মানুষের একান্ত নিজস্ব সৃজনশীলতা এবং ঘনিষ্ট অনুসঙ্গ। পল্লী কবি জসীম উদ্দিন তাঁর ১৯২৯ সালে প্রকাশিত " নকশী কাঁথার মাঠ" কাব্য গ্রন্থের মাধ্যমে শহুরে জীবন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নকশী কাঁথার পরিচয় তুলে ধরেন।
কালক্রমে দেশে বিদেশে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশী কাঁথার কদর বাড়ে এবং এটি একটি বানিজ্যিক পন্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ফজলি আম: আমি সৌদি থাকাকালীন সময় একবার ইকামা ( রেসিডেন্সিয়াল পাস) সংক্রান্ত জটিলতার পড়েছিলাম। তখন ফায়েয নামের জনৈক সৌদি আমাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করে। তখ আমি ফায়েয কে টাকা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফায়েয টাকা নিলনা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম তাহলে তোকে কিভাবে আমি সন্মানীত করব? তখন সে বল্ল ঠিক আছে তুই যখন দেশে যাবি তখন আমার জন্য তোদের দেশের ভাল ও ঐতিহ্যবাহী কোন কিছু নিয়ে আসিস। আমি তার কথা রেখেছিলাম। ছুটি কাটিয়ে ফেরার সময় আমি ফায়েজের জন্য গোটা চারেক ইয়া বড় ফজলি আম নিয়ে গিয়েছিলাম। এত বড় বড় আর সুস্বাদু আম পেয়ে ফায়েয বাংলার প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়েছিল সেদিন। সেদিন সে তার ভাষায় বাংলাদেশ কে জান্নাহ ( বেহেশত)বলে অভিহিত করেছিল।
এই ফজলি আম বাংলার আরেক ঐতিহ্য। রাজশাহীর ফজলি আম নিজ দেশের সীমা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত।
কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যার আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা। বাংলাদেশের এই তিন ঐতিহ্যমন্ডিত পণ্যের মালিকনা আজ হাত ছাড়া হয়ে যেতে বসেছে। বিশ্ব বাজারে এগুলি এখন পরিচিত হতে যাচ্ছে ভারতীয় পন্য হিসেবে।
কারণ আন্তর্জাতিক এক চুক্তির আওতায় ভৌগলিক নির্দেশক (জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস) আইন করে ভারত পন্য তিনটির পেটেন্ট বা স্বত্ব নিজেদের হিসেবে নিবন্ধন করে নিয়েছে। যাকে বলা যায় ঐতিহ্যগত আগ্রাসন। এতে করে পন্য তিনটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দর কষাকষি ও মেধা স্বত্ব লাভ করার অধিকার শুধুই ভারতের হয়ে গেল।
এবার জানা যাক কিভাবে জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস আইনের আওতায় পন্য স্বত্ব স্থির হয়:
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩টি চুক্তির একটি হচ্ছে বানিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা টিপস । এই চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ -প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার উপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে।
এই চুক্তিতে বিশ্বের ভিবিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক, মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্যে দীর্ঘকাল ধরে উতপাদিত হয়ে আসছে তার উপর সংস্লিষ্ট দেশের মালিকানা আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে। ভারত ১৯৯৯ সালে আইনটি করে এবং বাংলাদেশের এই তিনটি নিজস্ব পণ্যের নিবন্ধন নিজেদের নামে করে ফেলে।
এবার জানা যাক পেটেন্ট ভারতের হওয়াতে কি সমস্য হবে:
এই পন্য গুলোর পেটেন্ট ভারতের হাতে চলে গেলে অভ্যন্তরীন বাজারে বেচা কেনায় মেজর কোন সমস্যা না হলেও এই পন্য গুলোর আন্তর্জাতিক বানিজ্য বাধাগ্রস্থ হবে। ভবিষ্যতে এই পন্যগুলো বানিজ্যিক ভিত্তিতে উতপাদন ও বাজারজাত করতে গেলেই ভারতকে রয়ালিটি দিতে হবে এবং পণ্য গুলো ভারতীয় পন্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
এবার জানা যাক আমাদের সরকারের ভূমিকা :
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের সরকার এখনো এই বিষয়ে উদাসীন।
ভৌগলিক নির্দেশক আইনের খসড়া ২০০৮ সাল থেকে এখনো ঝুলে আছে কুম্ভকর্নের ঘুম ভাঙ্গার আশায়। এই মুহুর্তে সরকারের উচিৎ অনতিবিলম্বে ভৌগলিক নির্দেশক আইন চুড়ান্ত করা এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য সমুহের তালিকা প্রস্তুত করে পেটেন্ত নিবন্ধন করা। আর যদি তা না হয় তাহলে পদ্মার ইলিশ, রয়েল বেংগল টাইগার, রাজশাহী সিল্ক, কুমিল্লার খাদি, রসমলাই ইত্যাদি ভারতীয় পন্য হয়ে উঠতে খুব বেশী সময় লাগবেনা।
অন্য দিকে ভারতের অন্যয় নিবন্ধনের বিরুদ্ধে অতিস্বত্তর মামলা করতে হবে। কেননা সেই সুযোগ আইনে বলবত রয়েছে।
উল্লেখ্য বাসমতি চাল যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের নামে নিবন্ধন করার পর ভারত ও পাকিস্তান মামলা করে বাসমতি চালের স্বত্ব পূনরায় নিজেরা লাভ করে। আর যদি একান্ত ভাবে তা নয় তাহলে বাংলাদেশ " ঢাকাই জামদানি" নামেও জামদানি শাড়ীর নিবন্ধন করতে পারে।
এবার আমাদের করনীয়:
ভারত বন্ধুর বেশ ধরে আমাদের উপর একের পর এক অন্যায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। যার আরেক নমুনা এই পন্য স্বত্ব নিবন্ধন। কিন্তু এটা কি মেনে নেওয়া যায় ? বায়ান্ন- ঊণসত্তর কিংবা একাত্তের অপরাজেয় বাংলার তারণ্য কি এই দূর্দিনে ঘরে বসে থাকতে পারে? আগামী দিনে জামদানি শাড়ি কে বিশ্ব বলবে ভারতীয় জামদানি ! এই লজ্জা কি আমরা মাথা পেতে নেব?
না এসব মেনে নেওয়া যায়না।
আমাদের ঐতিহ্য - আমাদের অহংকার আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদীনি। জেগে উঠার সময় এখুনি। আমাদের সরকার কে মন্ত্রণা দেওয়া ও সহযোগিতা করার এখনি সময়।
আসুন দল মত নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশী জেগে উঠি আমাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে।
দেশের স্বার্থে একাত্ম হোন...
আগামী ১৯ অক্টোবর ২০১২, শুক্রবার বিকাল ৩.৩০ মিনিটে এর প্রতিবাদে মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।
দলে দলে যোগ দিন এই বিশাল মানব বন্ধনে।
আমরা আমাদের সরকারের প্রতিপক্ষ নয় বরং আমরা আমাদের সরকারের শক্তি
তথ্য সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো। উইকিপিডিয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।