অহন থিক্কা সব শয়তানরে দৌরের উপর রাখুম। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঘন ঘন হরতালের কারণে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ’ ঘন ঘন হরতালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক সঙ্কট যার প্রভাব পড়ছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। আবার শিল্প, কলকারখানায় উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে ‘হরতাল’। সার্বিকভাবে হরতালের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতিতে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে এ ধরনের স্থবিরতা নেমে আসায় দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা ভর করেছে দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহলে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা জায়গা-জমি ও সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করি। ঘন ঘন হরতালের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের পথে। একদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে না অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ বাড়ছে। ’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে আসবে।
দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ‘হরতাল’সহ নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মাহবুবুল আলম রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে হরতালের কর্মসূচি পরিহার করে বিকল্প শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেয়ার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম বলেন, হরতালের কারণে ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
হরতালের নামে ‘হরতাল’ সমর্থকরা গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে আগুনসহ বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেন। ‘হরতাল’ ও রাজনৈতিক সঙ্কটে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। আবার অনেক খাতে বিনিয়োগ করলেও হরতালের কারণে মূলধন রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। মুরাদ ইব্রাহিম বলেন, দেশের মানুষ এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়।
এজন্য দেশের প্রধান দু’দলকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, হরতালের পর হরতালে দেশের পোশাক শিল্পখাত সঙ্কটাপন্ন। বৈশ্বিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে এ খাতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যা চলছে। বর্তমানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘হরতাল’। বিজিএমইএ’র এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘হরতাল’ শুধু অর্থনীতির ক্ষতি করে ও সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ায়।
তিনি বলেন, হরতালের কারণে নির্ধারিত সময়ে রফতানি করতে না পেয়ে আমরা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার অর্থ যোগাড় করতে পারছি না। তিনি হরতালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির উপর জোর দেন।
অন্যদিকে, বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দীন চৌধুরী বলেন, টানা হরতালের কারণে তৈরি পোশাক কারখানায় উৎপাদন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমরা বিদেশি ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছেন।
এতে তৈরি পোশাক শিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, শ্বাসরুদ্ধকর এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন একমাত্র রাজনৈতিক নেতারাই। বড় দু’দলের দায়িত্বশীল ভূমিকা বাঁচাতে পারে দেশের অর্থনীতিকে। দেশের অর্থনীতির গতি সচল রাখতে রাজনৈতিক নেতাদের ‘হরতাল’ পরিহার করে বিকল্প কর্মসূচি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
‘হরতাল’ একটি বিদেশি শব্দ, কিন্তু বিদেশে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।
‘হরতাল’ কী জিনিস, অন্য দেশ খুব একটা না জানলেও, না বুঝলেও সবাইকে ভালোমতো জানিয়ে-বুঝিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ; দেখিয়ে দিচ্ছে ‘হরতাল’ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী? ‘হরতাল’ শব্দটি গুজরাটি ভাষার। কিন্তু গুজরাট তথা ভারতও ‘হরতাল’ পালনের দিক থেকে বাংলাদেশের কাছে নস্যি। জানা গেছে, ভারতে হরতালের মতো কর্মসূচিকে বলা হয় বন্ধ। সে দেশে বড় বড় ইস্যুতে কদাচিৎ ডাকা হতো বন্ধ। পরে দেশের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আদালত রায় দিয়ে বন্ধ ডাকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
যদিও বন্ধ ডাকা বন্ধ হয়নি, তবুও জোর করে বন্ধ পালন করলে আইনের আশ্রয় নিতে পারছে সে দেশের মানুষ। ভারতের একটি রাজনৈতিক দল ও একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বন্ধ পালন করার অপরাধে ২০ লাখ রুপি করে জরিমানাও গুনতে হয়েছে। ইদানীং কিছু বন্ধ কর্মসূচি দেখা যায় নেপালে, তবে বাংলাদেশের মতো এত ঘন ঘন নয়। এমনকি পাকিস্তানে রাজনৈতিক হানাহানি থাকলেও কথায় কথায় হরতালের মতো কর্মসূচি ডাকা হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও ‘হরতাল’ জাতীয় কিছু পালন হওয়ার খবর পাওয়া যায় না।
আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ অন্যান্য উন্নত দেশে কোনো মহলের কোনো দাবি-দাওয়া উঠলে বড়জোর শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট করা হয়।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে 'তমুদ্দিন মজলিস' প্রথম ‘হরতাল’ ডাকে বাংলার মাটিতে। এর পর থেকে এ দেশের রাজনীতিতে আন্দোলনের জনপ্রিয় কর্মসূচি হিসেবে ‘হরতাল’ চালু হয়ে ধীরে ধীরে রূপ নেয় সর্বনাশা কর্মসূচিতে। এ দেশের মানুষ জ্বালানি তেলের দাম কমাতে ‘হরতাল’ দেখেছে, পছন্দের নির্বাচনব্যবস্থার দাবিতে ‘হরতাল’ দেখেছে, বিচার বাতিলের দাবিতেও ‘হরতাল’ দেখেছে। এমনকি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি থেকে অবসরের দাবিতেও ‘হরতাল’ ডাকতে দেখা গেছে।
১৯৯৯ সালে ‘হরতাল’ নিয়ে একটি রায় দিয়েছিলেন আদালত। ওই বছর ১৩ মে হাইকোর্ট হরতালের পক্ষের ও হরতালের বিপক্ষের তৎপরতাকে ‘ধর্তব্য অপরাধ’ বলে ঘোষণা করেছিল।
বছরে গড়ে ৪৬টি ‘হরতাল’ : স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থার চেয়ে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ‘হরতাল’ অনেক বেশি হচ্ছে বলে গবেষণায় করে বের করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে তিন দিন, ১৯৭১ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত বছরে গড়ে সাত দিন, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রতিবছর ১৭ দিন ও ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সালের এ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৪৬ দিন করে ‘হরতাল’ হয়েছে।
চলতি বছর হরতালে বিপুল প্রাণহানি হয়েছে উল্লেখ করে সিপিডি জানায়, ২০১০ সালে হরতালে ৭৬ জন, ২০১১ সালে ৫৮ জন, ২০১২ সালে ৮৪ জন আর ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসেই ১১০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৯৩ শতাংশ হরতালের কারণ ছিল রাজনৈতিক। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৬ শতাংশ হরতালের কারণ ছিল রাজনৈতিক। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ৯৪ শতাংশ হরতালের কারণও রাজনৈতিক। সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ‘হরতাল’ ডাকার নজির খুবই কম।
যুক্তরাষ্ট্রে হরতালের মতো কর্মসূচি বলতে কিছু নেই।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো সেখানে ডেমোক্রেটিক আর রিপাবলিকানরা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সারা দেশে ধর্মঘট বা ‘হরতাল’ ডেকেছে- এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে যেসব ধর্মঘট আহবান করা হয়, তা সাধারণত শ্রমিকরা করে। তবে সেখানকার কিছু আইনে শ্রমিকদের এ ধরনের ধর্মঘট ডাকার অধিকার খর্ব করা আছে। কী কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ধর্মঘট আহবান করা যাবে- তা আইনেই বলা আছে।
যুক্তরাজ্যের অবস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো।
সেখানও দেশজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলো হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে সম্প্রতি সেখানে সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট করার ঘটনা ঘটছে। পেনশন, বেতন বাড়ানো, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিবাদে এমন ধর্মঘট গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের কর্মীদের পাশাপাশি অবসরের পথে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা এসব ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন- এমন নজিরও আছে। গত মাসে যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মচারীরা ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করেন।
কিন্তু দেশটির লেবার পার্টি অথবা কনজারভেটিভ পার্টি দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা ‘হরতাল’ ডেকেছে- এমন নজির নেই।
পুরো ভারতজুড়ে বন্ধ পালনের ঘটনা বছরে দু-একবার ছাড়া ঘটে না। নেপালেও ‘হরতাল’ ডাকার হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
পাকিস্তানে প্রতিনিয়ত বোমা হামলায় মানুষ মারা যায়, তবে অহরহ ‘হরতাল’ ডাকার নজির নেই।
বাংলাদেশের প্রায় সমপর্যায়ের দেশ ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও হরতালের এমন সংস্কৃতি নেই।
ভিয়েতনামে সরকারবিরোধী ও সমর্থকরা মাসভর বিক্ষোভ করেছে কিন্তু দেশজুড়ে লাগাতার ‘হরতাল’ ডাকার ঘটনা ঘটায়নি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।