মহাবিশ্বের বালুকণা বড় বাজারের বড় ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের একমাত্র সন্তান সুবীর সম্প্রতি প্রেমে পড়িয়াছে। যাহা তাহা প্রেম নহে, একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া। এমন পড়াই পড়িয়াছে যে উহা হইতে উঠিয়া আসিবার কোন রাস্তা খুঁজিয়া পাইতেছেনা। তাহার প্রণয়ী পাশের বাড়ির শেফালী। ঘটনা স্বাভাবিক হইলে ভাবিবার তেমন কিছুই ছিলনা, সুবীরদের পরিবার অবস্থা সম্পন্ন, অত্র অঞ্চলের যে কোন অবিবাহিতা পাত্রীর মাতা-পিতার নিকট বিবাহের প্রস্তাব লহিয়া যাইবার দ্বার তাহাদের জন্য বরাবরই উন্মুক্ত।
হুঁ, বিপত্তি ঐখানেই বাঁধিয়াছে, শেফালী বিবাহিতা, দাম্পত্য জীবনে যদিও সে সুখের লেশ মাত্র খুঁজিয়া পায় নাই। শেফালীদের পরিবারের সহিত তাহাদের রেষারেষির ইতিহাস অনেক পুরাতন, সেই প্রসঙ্গে পরবর্তীতে আসা যাইবে। বহু ব্যবহারে জীর্ণ হইলেও ইহা প্রমাণিত সত্য কথা যে প্রেম না মানে ধর্মের কথা, যুক্তির কথা। সুবীর বহু চেষ্টা করিয়াও শেফালীর প্রতি তাহার সুতীব্র প্রেমাভিলাষকে দাবাইয়া রাখিতে পারিতেছে না। আর শেফালীও ইদানীং ঠারে ঠোরে সুবীরের প্রতি তাহার আকর্ষণপ্রসূত প্রশ্রয়ের ইশারা রাখিয়া যাইতেছে।
উগ্র প্রেমের লাভায় ভাসিয়া গিয়া সুবীর মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে যে শেফালীকে ছাড়া তাহার বাঁচিবার কোন উপায় নাই। কিন্তু এই বিষয়ে কাহারো সহিত বিস্তারিত আলাপ করিবার দুঃসাহসও তাহার হইতেছেনা।
কথায় বলে বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। সুবীরের এই ঘোর ক্রান্তিকালে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করিয়া দিল তাহার খুড়তুতো ভাই এবং বাল্যবন্ধু কুবের। সে সন্ধান জানাইলো এক তন্ত্রসাধক কাপালিকের যাহার দ্বারা অসম্ভব বলিয়া কিছু নাই, সাধুবাবা একই সাথে শাস্ত্রজ্ঞ এবং ইহ-পরজাগতিক সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান তাহার নখ দর্পণে।
কুবের বলিতে গেলে বাবার দক্ষিণ হস্তের ন্যায়, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত লোকদিগকে বাবার সুকীর্তির বর্ণনা দিয়া তাঁহার পানে ধাবিত করিতেছে। সে ইহাও পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দিল যে বাবা সচরাচর কোনো দিক নির্দেশনা প্রদান করেন না, তাঁহার উচ্চারিত শব্দগুলির মধ্য হইতেই ইশারা খুঁজিয়া নিতে হয়। তবে বিষয়ের গুরুত্ব অত্যাধিক হইলে মন্ত্রপুতঃ সমাধান প্রদান করিয়া থাকেন। অবশ্যই উপযুক্ত সম্মানীর বিনিময়ে। ধনীর একমাত্র সন্তান সুবীরের নিকট অর্থকড়ি কোনো সমস্যাই নহে, শেফালীর ভালোবাসাই তাহার পরম আরাধ্য, যে কোন মূল্যে।
প্রবল প্রেমাক্রান্ত সুবীর একদা প্রত্যূষে সাধু বাবার সন্ধানে গৃহত্যাগ করিল। দ্রুত হাঁটিয়া বেলা দ্বিপ্রহরেই তাঁহার ডেরায় পৌছাইয়া গেল। ডেরা বলিতে বিশাল এক বটবৃক্ষের নিম্নে সাময়িক আটপৌরে আস্তানা । সাধু বাবা যাযাবর প্রকৃতির মানুষ। এক অঞ্চলে বেশিদিন অবস্থান করিবার অভ্যাস নাই।
মাসতিনেক হইলো অত্র অঞ্চলে ঠাঁই গাঁড়িয়াছেন, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাহার বিস্তর ভক্ত জুটিয়া গিয়াছে। এই বেলায় অবশ্য আস্তানার চারপাশে কাহাকেও ভিড় করিতে দেখা গেলনা—সুবীর বাবাকে একাকী পাইয়া মনে মনে আনন্দিত বোধ করিতে লাগিল।
বাবা ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, সুবীর নিকটবর্তী হইতেই চোখ বন্ধ রাখিয়াই পদযুগল প্রসারিত করিয়া দিলেন। সে নতজানু হইয়া পদধূলি গ্রহণ করিল। সাধুবাবা তাহাকে ইশারায় বসিতে বলিয়া আবার ভাবের জগতে ডুবিয়া গেলেন।
সাধু বাবার পরিধাণে গেরুয়া, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে রক্তবর্ণ তিলক, হস্তে আনন্দবাজার পত্রিকার একখানা পুরাতন সংখ্যা। সুবীর মনে মনে কথা সাজাইতেছিল, বাবার নিকট তাহার হৃদয়ের আকুলতা প্রকাশ করিয়া তাহার বর্তমান হুলস্থূল পরিস্থিতির একটা মধুরণ সমাপয়েত নিশ্চিত করা ব্যতিরেকে তাহার শান্তি মিলিবেনা। কিন্তু বাবা তাহাকে চমকাইয়া দিয়া চক্ষুমুদিত অবস্থাতেই গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘মনুর বিধান অনুসারে বিবাহ আট প্রকারঃ ব্রাহ্ম্, দৈব, আর্য, প্রাজাপাত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস এবং পৈশাচ। সামাজিক দৃষ্টিতে তাহার মধ্যে সর্বোত্তম যদি হয় গান্ধর্ব তবে অতি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য রাক্ষস ও পৈশাচ বিবাহ। রাক্ষস বিবাহে কন্যাপক্ষীয়দের হত্যা করিয়া বলপূর্বক কন্যাকে বিবাহ করা হয় আর পৈশাচ বিবাহে নিদ্রিত অবস্থায় অথবা মদ্যপানে বিকলচিত্ত বা উন্মত্ত কন্যাকে অপহরণ করিয়া নির্জন স্থানে লইয়া গিয়া বিবাহ করা হয়।
’
বিনা মেঘে হঠাৎ করিয়া এমন গুরুতর আলোচনার অবতারণায় সুবীর হতবিহবল হইয়া পড়িল। বুঝিতে পারিল, বাবা অন্তর্যামী , সে মুখ খুলিবার আগেই তাহার আসিবার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্যক অবগত হইয়া বসিয়া আছেন। যদিও রাক্ষস বা পৈশাচ বিবাহের কোনটাই তাহার মনে ধরিল না, কিন্তু সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে তাহাদের মধ্যে অন্য কোন প্রকারের বিবাহের উপায়ই আর অবশিষ্ট যে নাই তাহা সে ভালো করিয়াই জানে। দুরু দুরু বক্ষে সে একটা প্রশ্ন করিতে যাইবে এমতাবস্থায় বাবা নাসিকা গর্জনের সহিত গভীর ঘুমে তলাইয়া গেলেন। প্রবীর আর মুখ খুলিতে সাহস পাইলনা, ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় ফ্যালফ্যালাইয়া শূন্য দৃষ্টিতে মহাজ্ঞানী মহাজনের জাগিবার অপেক্ষা করিতে লাগিল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইলোনা, বাবা চক্ষু উন্মোচন করিয়া পত্রিকার পাতায় চোখ রাখিয়া পুনরায় বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন, ‘ নায়ক কতৃক নায়িকা অপহরণ এবং পরস্পরের হাত ধরিয়া দুইজনের পলায়ন সভ্যতার আদি পর্ব হইতেই চলিতেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের প্রাণরসই বোধকরি যুবক-যুবতীর প্রণয় এবং নানা বিপত্তির মধ্য দিয়া তাহাদের মিলন অথবা বিয়োগান্ত পরিণতি। যদিও প্রণয়ীকে লইয়া প্রণয়প্রার্থীর পলায়ন প্রায়শ চাঞ্চল্যকর নাটকীয়তা সৃষ্টি করিয়া থাকে, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ইহা ছাড়া প্রেমাভিলাষ পূর্ণ করিবার আর কোন উপায়ও অবশিষ্ট থাকেনা। ’
গুরুদেব পুনরায় দৃষ্টির ঝাপ অবনত করিলেন। সুবীরের প্রেমার্ত হৃদয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই এই ধারণা বাসা বাঁধিতে শুরু করিয়াছে যে ভাগিয়া যাওয়া ছাড়া তাহাদের সম্মুখে মিলনের আর কোন রাস্তা খোলা নাই।
কিন্তু শেফালীকে কী করিয়া উহাতে রাজী করিবে, সে নিজে তাহার জন্য জীবন পর্যন্ত বিলীন করিতে প্রস্তুত থাকিলেও, শেফালী কি তাহার প্রতি ততোটা অনুরাগী? সে কি তাহার স্বামী-সন্তান-সংসার সব পরিত্যাগ করিয়া এক বস্ত্রে পথে নামিতে উৎসাহী হইবে? যদি বাস্তববাদী চিন্তায় প্রভাবিত হইয়া শেফালী ভাগিয়া যাইবার পরিকল্পনাকে খারিজ করিয়া দেয় তাহা হইলে তাহার মনের চাবি ভাঙিয়া তাহাকে দুঃসাহসী রোমাঞ্চভিলাষীতে পরিণত করিবার আর কোন কার্যকর পন্থা কি রহিয়াছে?
আবারও দৈববাণীর ন্যায় সাধক মহাশয়ের মুখ খুলিয়া ধ্বনিত হইল,-‘ সংস্কৃত পর্ণ। বাংলায় পান। মন্ত্রপুতঃ তাম্বুল। ’
‘ঞ্যাঃ’—বিস্মিত সুবীর আর কোন শব্দ খুঁজিয়া পাইলোনা।
সুবীরের মনে পড়িয়া যায় তাম্বুল রাগে রঞ্জিত শেফালীর পানপানা মুখখানি।
গত বৎসরে এক অনুষ্ঠানে তাম্বুল অধরে শেফালীর ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি দেখিয়াই না তাহার হৃদয় উড়িয়া যায়। গুরুদেব কোথা হইতে একখানা দোতারা বাহির করিয়া গুনগুনাইয়া একটা বৈষ্ণব গান গাহিতে আরম্ভ করিলেন। সুবীর মনোযোগ আর ধৈর্য্যের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা খাটাইয়া গানের কথার চুম্বক অংশমাত্র অনুধাবন করিতে সমর্থ হইলোঃ-‘ হাথক দর্পণ, মাথক ফুল/ নয়নক অঞ্জন, মুখক তাম্বুল। ’
এক পর্যায়ে সে নিজের অজান্তেই সাধক বাবাজির সহিত কন্ঠ মিলাইতে শুরু করিল। সুরের মূর্ছ্বনায় তাহার চক্ষু মুদিয়া আসিল, অন্তর বিগলিত হইয়া গেল।
বাবা সম্মুখে আগাইয়া আসিয়া বিনা আভাষে তাহার মুখে একখানা মন্ত্রঃপুত তাম্বুল গুঁজিয়া দিলেন। সুবীর চমকাইয়া উঠিয়া নেত্র উন্মোচন করিল, বাবা তাহার চক্ষুর পানে সম্মোহনী দৃষ্টি ঢালিয়া খানিকটা উচ্চস্বরে গাহিতে লাগিলেন, ‘ অধরের তাম্বুল বয়ানে লাগিয়াছে/ ঘুমে ঢুলুঢুলু তব আঁখি। ’
তাম্বুলের রস আস্বাদন করিবা মাত্র তাহার মাথা ঝিমঝিম করিয়া উঠিল, সমস্ত দুশ্চিন্তা কর্পূরের ন্যায় উবিয়া গিয়া সুবীরের হৃদয় নির্ভেজাল প্রশান্তিতে মৌ মৌ করিয়া উঠিল। এতটা নিরাপদ সে বহুকাল বোধ করে নাই, বুঝিতে পারিল যে বাবা মন্ত্রপুতঃ তাম্বুলের মাধ্যমেই তাহার সমস্যার সমাধান করিবেন।
মাথার ঝিমঝিম কমিয়া আসিলে সুবীর বাবার সহিত সম্পূর্ণ বিষয়টি লহিয়া বিস্তারিত আলোচনায় মগ্ন হয়।
বাবার দাবী শুনিয়া শুরুতে কিছুটা দমিয়া গেলেও প্রেমের শক্তিতে বলীয়ান হইয়া সে মনস্থির করিয়া ফেলিল। মাত্র দুই খিলি মন্ত্রপুতঃ তাম্বুলের জন্য সাধু বাবা পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবী করিয়াছেন, এই মর্মে যে, ইহাতে কেবল মাত্র শেফালীর গৃহত্যাগই নহে, পরবর্তীতে তাহাদের দুইজনার নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্বীকৃতিও নিশ্চিত হইবে। সুবীরের মস্তকে এই মুহূর্তে শেফালী ব্যতীত পার্থিব আর কোনো কিছুর গুরুত্ব নাই, সে কয়েক পল ভাবিয়াই সাধু বাবার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করিল। তবে সিদ্ধান্ত হইলো যে কার্যসিদ্ধির পূর্বে কোনো অর্থব্যয়ের প্রয়োজন পড়িবে না, অদ্য সুবীর একখিলি পান লহিয়া শেফালীর নিকট যাইবে এবং আগামীকাল তাহাকে সঙ্গে করিয়া দুই ক্রোশ দূরের পুরাতন মন্দিরের নিকট বাবার সহিত মিলিত হইবে। ঐখানে বাবা অর্থ গ্রহণ পূর্বক আরেক খিলি পান প্রদান করিবেন।
শেফালী অদ্য পান গ্রহণ করিলেই বুঝিতে হইবে যে মন্ত্রের কাজ শুরু হইয়া গিয়াছে, সুবীরের উচিত হইবে অনতিবিলম্বে অর্থ-কড়ির সংস্থান করিয়া ফেলা।
বাবার ডেরা হইতে বাহির হইয়া সুবীর আরও দ্রুতপদে চলিতে লাগিল, তাহার বুক পকেট হইতে মন্ত্রপড়া পান যেন বারংবার ঘাঁই মারিতেছে। বাবা খুব যত্ন করিয়া, দুর্বোধ্য সব মন্ত্র পাঠ করিয়া উহাকে নিজ হস্তে প্রস্তুত করিয়াছেন। পানটি দেখিতে অনেকাংশে ডিঙ্গি নৌকার মতো। সুবীরের স্মৃতির তরঙ্গে বাতাস লাগিয়া কী যেন মনে পড়িয়া যায় যায় করিয়াও পড়ে না।
স্মৃতির সহিত পাঞ্জা না লড়িয়া সে সুখ-কল্পনার সাগরে ভেলা ভাসাইয়া দেয়। আহা আর মাত্র একটি দিন বাকী, তাহার পরেই শেফালী তাহার হইবে, সুবীরের তনু-মনে অজানা সব শিহরণের হিল্লোল বহিয়া যায়।
শেফালী কলসী লহিয়া পুকুর ঘাট হইতে বাড়ির দিকে যাইতেছিল, সুবীরকে দেখিয়া দাঁড়াইয়া যায়। সুবীর সাধু বাবার পরামর্শ অনুযায়ী কোনো সম্ভাষণ বা আলাপচারিতা ব্যতিরেকেই বুক পকেট হইতে মন্ত্রপুতঃ তাম্বুল বাহির করিয়া শেফালীর দিকে বাড়াইয়া দেয়। ডিঙ্গি নৌকা আকৃতির পান দেখিয়াই শেফালীর চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে, এতটাই চমকাইয়া যায় যে তাহার হস্ত হইতে জলভর্তি মাটির কলস পড়িয়া গিয়া ভাঙিয়া খান খান হইয়া যায়।
শেফালীর প্রশ্নবোধক দৃষ্টির দিকে চাহিয়া সুবীর ধরাকন্ঠে বলিয়া ওঠে, ‘ রাত পোহাবার পূর্বেই, শ্যাওড়া গাছের তলায়। ’ শেফালী অতি কষ্টে সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়াই দ্রুতপদে বাড়ির ভেতরে ছুটিয়া যায়।
সুবীর সমস্ত রজনীতে এক মুহূর্তের পানেও দুই চক্ষু একত্র করিতে পারে নাই। রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর হইতেই শ্যাওড়া গাছে নিচে অস্থির পায়ে পায়চারি করিতেছে। তাহার স্কন্ধে একটিমাত্র ঝোলা, উহার মধ্যে লক্ষাধিক টাকা।
বাবাকে তাহার সম্মানী বুঝাইয়া দেওয়ার পরে বাকি অর্থ সে তাহার আর শেফালীর সুখী সংসারের জন্য ব্যয় করিবে। তাহার বিন্দুমাত্রও লজ্জা বোধ হইতেছে না ইহা মনে করিয়া যে, সমস্ত অর্থই সে তাহার পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সিঁদ কাটিয়া জোগাড় করিয়াছে। প্রেম আর যুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নাই, উহাতে বিজয়ী হওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। ইহা ছাড়া আর কোনো পন্থাও অবশিষ্ট ছিল না, সুবীরের বাবা প্রবীর খুবই জাঁদরেল মানুষ, জাত-পাত কঠিনভাবে মানিয়া চলেন। সুবীরের হঠাৎ করিয়া মনে পড়িয়া যায়, এই শেফালীর প্রেমে পড়িয়া হাবুডুবু খাইয়াছিল তাহার খুড়তুতো দাদা রণবীর, শেফালীও তাহাকে প্রাণ উজাড় করিয়া ভালোবাসিয়াছিল।
উহা জানিতে পারিয়া প্রবীর তাহাকে বাড়ির উঠানে সকলের সম্মুখেই জুতাপেটা করিয়াছিলেন, শালিস ডাকিয়া শেফালীর বাবাকে চরমভাবে অপমানিত করিয়া গ্রামছাড়া করিবার দাবী জানাইয়াছিলেন। সেই অপমান সহিতে না পারিয়া রণবীর নিরুদ্দেশ হইয়া যায় আজ হইতে প্রায় এক যুগ আগে। আর শেফালীর বাবা তড়িঘড়ি করিয়া কন্যার সম্বন্ধ স্থির করিয়া ভূলুন্ঠির মান-সম্মান খানিকটা হইলেও পুনোরুদ্ধার করেন।
রাত্রি ভোর হইবার কিয়ৎকাল পূর্বে কুয়াশা ভেদিয়া শেফালীর ভীরু অবয়ব ফুটিয়া ওঠে। সুবীরের অন্তরাত্মা আনন্দে লাফাইয়া উঠিয়া তাহার কন্ঠরোধ হইবার উপক্রম হয়।
শেফালী এক বস্ত্রেই গৃহত্যাগ করিয়াছে। সুবীরের হাত ধরিয়া সে বিনাদ্বিধায় পথে নামিল, মন্ত্রপুতঃ তাম্বুলের কার্যকারিতা দেখিয়া সাধু বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সুবীরের অন্তর বিগলিত হয়। অতীব চমকপ্রদ আনন্দানুভূতিতে আচ্ছন্ন হইয়া সে পথ চলিতে চলিতে গুনগুনাইয়া গাহিতে আরম্ভ করে-‘এই পথ যদি আর শেষ না হয়...’। যদিও অতি দ্রুত গ্রামের সীমানা পাড়ি দিয়া বাবার সহিত মিলিত হইতে তাহার তর সহিতেছিল না। শেফালী একটি বারের জন্যও তাহার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিয়া উঠিতে পারে নাই।
ভীরু পায়ে, লজ্জাবনত মস্তকে, কী এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে জড়াজড়ি করিয়া তাহারা দু’টিতে সেই পুরাতন মন্দিরের দিকে আগাইতে থাকে।
দূর হইতেই তাহাদের দেখিয়া সাধুবাবা নিজেই আগাইয়া আসিলেন। তাহার মুখভঙ্গিতে সেই শান্ত-সমাহিত রূপটি আর অবশিষ্ট নাই, খানিকটা উত্তেজিত বলিয়া বোধ হইতেছে। বাবা তাহাদের সঙ্গে লহিয়া মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। বেদীর সম্মুখে একখানি খর্জুরপত্রের পাটি বিছানো রহিয়াছে।
শেফালী অল্পবিস্তর কাঁপিতে আরম্ভ করিল, তাহার চক্ষু নিজের অজান্তেই অশ্রুতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সাধু বাবা কাহারও সহিত কোনোরূপ বাক্যবিনিময় না করিয়া উভয়কেই তাহার সম্মুখে বসিতে বলিলেন। সুবীর তাহার ঝোলা হইতে টাকা বাহির করিতে গেলে বাবা ইশারায় তাহাকে নিরস্ত করিলেন। তাম্রনির্মিত তাম্বুল সম্পূট হইতে বাহির করিলেন দুই খিলি পান। একখানা শেফালির হস্তে দিয়া আরেকখানা সুবীরের মুখে পুরিয়া দিলেন।
সুবীরের জিহবা জ্বালা করিয়া উঠিল, মনে হইলো সমস্ত দুনিয়া খনিজ একত্রিত হইয়া তাহার মুখে আক্রমণ করিয়াছে। ঢোঁক গিলিতেই মুহূর্তে তাহার দৃষ্টি ঘোলাটে হইয়া উঠিল, মাথা ঘুরিয়া পরিয়া যাইবার পূর্বক্ষণে সুবীর দেখিতে পাইলো সাধুবাবা একহাতে তাহার টাকাভর্তি ঝোলা আর আরেক হাতে প্রেয়সী শেফালীকে লহিয়া মন্দির হইতে বাহির হইয়া যাইতেছেন।
জ্ঞান হারাইবার পূর্বে জটার আড়ালে ঢাকা পড়া সাধুবাবার আসল পরিচয় চিনিতে পারিয়া সুবীর চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিতে চাহিল, ‘ রণবীরদা, আমাকে ফেল যেওনা, বাবাকে বলে দেব, মাইরি বলচি। ’
কিন্তু তাহার কণ্ঠ হইতে মৃত্যুপথযাত্রী পশুর ন্যায় ঘড়ঘড় শব্দ ব্যতিরেকে আর কিছুই বাহির হইলো না।
রণবীরের হাত ধরিয়া শেফালীর ছায়া দেখিতে দেখিতে মিলাইয়া গেল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।