আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির পাতা থেকে-নটরডেম কলেজ (অম্লমধুর নানা অভিজ্ঞতা).......পর্ব ২....(নবীনবরন ও দীপক স্যারের কথা)

আমি শুনতে পাই লক্ষ কোটি ফিলিস্তিনীর আর্তনাদ...হাহাকার ১ম পর্ব নবীনবরনের প্রায় আধাঘন্টা আগে গিয়ে হাজির হলাম। ঢুকতেই গেইটের সামনে এক সুন্দর তোরণ চোখে পড়ল। ওখানে লেখা “এসো হে নবীন প্রানের উচ্ছাস্বে। “ ঢোকার সময় এক সিনিয়র ভাই একটা সুঁই ও এক টুকরো কাগজ নিয়ে আমার বুক পকেটের সামনে লাগিয়ে দিলেন। ওখানেও একই বাণী লেখা।

তখন সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছিল বাস্কেটবল কোর্টে। আমি ওখানে গিয়ে দেখি যে বেশিরভাগ সিটে সব নবীনরা বসে পরেছে। তখন দেখি এক ভলান্টিয়ার সিনিয়ার ভাই আমাকে বলল যে সামনে সিট খালি আছে। আমি শেষ পর্যন্ত সিট পেলাম একদম সামনের দিকে। আমার ফ্রেন্ডরা হয়ত আশেপাশে বসেছে, কিন্তু কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই।

মোবাইল থাকলে হয়ত এস.এম.এস চালাচালি বা ফোন করে তাদের অবস্থান জেনে নিতে পারতাম। অনুষ্ঠান শুরু হলো কুরআন তেলাওয়াত, গীতাপাঠ, বাইবেল, ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা ও জাতীয় সঙ্গিতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। এরপর গতানুগতিক যা হয় অধ্যক্ষ ও অন্যান্যদের উপদেমূলক বিভিন্ন বক্তৃতা। যেসব বক্তৃতার উপদেশ কখনোই পালন করা হয়না। এরপর শপথ হলো, ফাদার বকুল সবাইকে শপথ পাঠ করালেন।

অনুষ্ঠানের ২য় অংশে হবে কলেজের সব টিচার ও ষ্টাফদের সাথে পরিচয়। তখন ষ্টেজে এক চশমা পড়া চওড়া গোঁফওয়ালা এক ভদ্রলোক ডায়াসের সামনে এসে নিজেকে “স্টুডেন্ট গাইডেন্স” হিসেবে পরিচয় দিলেন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদেরকে দেখলেই মনের মধ্যে সমীহ জাগে, তাদেরকে দেখলেই মনে হয় “ইনি কিছু একটা হবেন। “ অনেক স্কুল কলেজেই টিচারদের মধ্যে একজন থাকেন যাকে সবাই বাঘের মত ভয় পায়, তার ভরাট গলা, কথা বলার স্টাইল ও তার বক্তৃতার বিষয় বস্তু শুনে মনে মনে ধারনা করে নিলাম, হোক ইনি হচ্ছেন সেই বাঘ, সোজা কথায় “আয়রন ম্যান”। মনে মনে দোয়া করলাম “আল্লাহ যেন এই লোককে আমাদের ক্লাসে না ফেলেন”।

তারপর তিনি একে একে টিচার সহ সব ষ্টাফদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু মাঝ পথে বৃষ্টির বাগড়া। সবাই হুড়মুড় করে বিল্ডিং এর ভিতর চলে গেলাম। তারপর লাইন ধরে বিভিন্ন বিল্ডিং ঘুরিয়ে দেখানো হলো।

আমাদেরকে কলেজের বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও ৫০ বছর উপলক্ষ্যে বের হওয়া স্বারক ম্যাগাজিন দেয়া হলো। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর হেঁটেই বাসায় চলে আসলাম। আসলে ওটাও একটা মজা ছিল যে কলেজ শেষ করেই খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাওয়া যেত। নটরডেম কলেজে ভর্তি হতে না পাড়লে নাহলে হয়ত প্রত্যেকদিন সকালে ৭ টার সময় মিরপুরে কমার্স কলেজে যাবার জন্য বাস ধরতে হতো। কলেজে ১ম ক্লাস ও দীপক স্যার (দীপক লরেন্স রোজারিও)- সকাল ৮ টায় ছিল ক্লাস।

আমি সাড়ে ৭ টার সময় আমার ক্লাসে গিয়ে হাজির হলাম। আমার ক্লাস ছিল পুরান বিল্ডিং এর ফিজিক্স ল্যাবের পাশে ১০৩ নম্বর রুম। প্রথমে ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম। কেউ কাওকে চিনি না। একটু কথা বললেই মনে হয় মারাত্তক অপরাধ হয়ে যাবে!! তাই চুপচাপ রইলাম।

ঠিক ৮ টার সময় একজন স্যার এসে ডায়াসে উঠলেন। প্রথমে তিনি আমাদেরকে রোল অনুযায়ী বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। মজার ব্যপার হলো আমার বসার জায়গা দুই বছরের জন্য একই জায়গায় থাকবে। একদম চিরস্থায়ী বন্দবোস্ত আর কি! এবার আসি দীপক স্যারের কথা। তিনি নিতেন “ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ”।

তিনি গম্ভীর স্বরে কথা বলা শুরু করলেন। আসলে খামাখাই তিনি গম্ভীর স্বরে কথা বলতেন। প্রথমে তিনি তার পরিচয় দিলেন এবং নটরডেম কলেজ সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। এরপর তিনি এমন বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন যা আমাদের মাথার দুই হাত উপর দিয়ে গেল। এটি ছিল তার এক অসাধারন কৌশল।

সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্ররা যেন উলটা পালটা কিছু না করে বসে, সেজন্য তিনি এই কৌশলগুলো নিতেন। প্রথম ক্লাসেই তিনি বোর্ডে একটি বাক্য লিখলেন- “Not to maximize the profitability, but to maximize the wealth”. আমাদের সবার চোয়াল ঝুলে যাবার দশা। ভাবলাম হায় হায় কোই আইসা পড়লাম??। তিনি আরো ঘোষনা দিলেন এটার উপ ৪ পেজ অ্যাসাইনমেন্ট করে নিয়ে আসতে। এরপর উনি দেখালেন কিভাবে অ্যাসাইনমেন্ট লিখন্তে হয় আর কিভাবে এর পেইজ বানাতে হয়।

বুঝেন অবস্থা, কোথায় প্রথম কয়েক সপ্তাহ গল্প করবে না প্রথমেই অ্যাসাইনমেন্ট!!! “Not to maximize the profitability, but to maximize the wealth”- এটি আধুনিক ব্যবসায়ের একটি কনসেপ্ট। আমরা তো তুমুল আলোচনা শুরু করে দিলাম। কি হবে? কি লিখব? কোথায় পাব ইত্যাদি। এখনকার মত সে সময় যখন তখন গুগল মামারে জিজ্ঞাসা করা যেত না। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত ওই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছিলাম।

শুধু ব্যবসায় না, রাজনীতি, ভূগোল, পরিবেশ, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রযুক্তি সব বিষয় একসাথে করে লিখে জমা দিলাম। যেদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার কথা, সেদিন দেখলাম বিপুল উৎসাহ। ডায়াসের টেবিলের উপরে কাগজের স্তুপ জমা হচ্ছে। কিছু “অতিজ্ঞ্যানী” টাইপ কিছু ক্লাসমেটদের দেখলাম তারা ১৫-২০ পেইজ অ্যাসাইনমেন্ট করে এনেছে। উনি এসে খুব গম্ভীর গলায় সবাইকে কোন কথা বলতে মানা করলেন, একজন ঠিকমত পেইজ সেলাই করেনি দেখে তার খাতা দলাই মলাই করে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, এরপর গলা আরও গম্ভীর করে জিজ্ঞাসা করলেন “কে কে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয় নি?”।

ক্লাসে একটু গুনগুন শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু স্যারের এই কথা শোনার পর সবাই চুপ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে ২/৩ জন উঠে দাঁড়ালো, তাদের চেহারা দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলাম,- “নটরডেম কলেজে আসছিস, আবার অ্যাসাইনমেন্ট করিসনি??” আমি অ্যাসাইনমেন্ট করে এনেছি দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। যারা আনেনি তাদেরকে বলা হলো আজকে সন্ধ্যার মধ্যে অ্যাসাইনন্ট জমা দিতে হবে। যারা অ্যাসাইনমেন্ট আনেনি তাদের মুখে কালিগোলা অন্ধকার দেখা দেখা গেল। আমরাও মনে মনে আশঙ্কা করলাম এই লোক তো আমাদের ভালই জ্বালাবে।

পরদিন উনি অ্যাসাইমেন্ট এর ফলাফল ঘোষনা করলেন। উনি বললেন তোমাদের কারো অ্যাসাইনমেণ্ট কিচ্ছু হয়নি, একটা ছেলেও ঠিক করে কিছু লিখেনি !! তারপর তিনি গম্ভীর হয়ে কন্সেপ্টা বোঝালেন। বোঝানোর সময় কিছু “মাতবর” টাইপ ছেলে যাদের ভাবই হচ্ছে “আমি ছাড়া সবাই গর্দভ”, তারা ক্রমাগত মাথা নেড়ে গেল আর প্রশ্ন করতে লাগল। স্যার পুরো ক্লাস ধরে আমাদেরকে বোঝালেন। যদিও আমি কিছুই বুঝি নাই, বুঝি যে নাই এটা বলারও সাহস পাইনি।

তবে এটা বুঝেছি যে স্যার মোটেও আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট পড়েননি, কেননা আমি যা লিখেলাম সেটা পড়লে নির্ঘাত হার্টফেল করতেন........সম্পূর্ন নতুন থিওরি আবিষ্কারের জন্য। ক্লাস শেষে স্যারের কাছে কোন লেখকের বই কিনব সেটা জানতে চাইলাম। উনি নাক মুখ কুঁচকে বললেন “বই কোনটাই ভাল মনে হয়নি আমার কাছে। তবে মন্দের ভাল হিসেবে খালেকুজ্জামানের বই কিনতে পার। আমি কিন্তু বই খুব একটা ফলো করি না”!! স্যার কিন্তু লেকচারের সবসময়ই খালেকুজ্জামানের লেখা বইটি থেকে পয়েন্ট আলোচনা করতেন! দীপক স্যারের ক্লাসে প্রথম প্রথম একটা জিনিষ খুব খারাপ লেগেছিলো।

উনি কোন সাজেশন দেননি। যেখানে অন্যান্য কলেজে “ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ” সাবজেক্ট এ মোটামুটি একটা সাজেশন দেয়া হতো। আসলে আমার মনে হয় উনি চাননি নটরডেম কলেজের ছাত্ররা “গৎবাধা কিছু প্রশ্ন পড়ে ভাল করতে। এইজন্য তিনি মাঝে মাঝে সিলেবাসের বাইরে থেকেও কিছু জিনিষ শেখাতেন। তাঁর কাছে প্রথম “Break-even point” সম্পর্কে ধারনা লাভ করি।

“ব্যবসায় কাকে বলে” এই লেকচার দেবার সময় তিনি বইয়ে উল্লেখিত লেখকের কোন সংজ্ঞা বলেননি। বলেছিলেন “Philip Kotler” এর কথা। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য যে তারঁ মুখেই প্রথম “Philip Kotler” এর নাম শুনি। তাঁর ক্লাস করে প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম যে “ব্যবসায় শিক্ষা” বিষয়টি শুধু প্রশ্ন মুখস্ত করে পাশ করা নয়। এতে জানার অনেক কিছু আছে যা শুধু বই পড়ে সম্ভব না।

তিনি আমাদের কে কিছুটা হলেও আত্মনির্ভরশীল হতে শিখিয়েছিলেন। নটরডেম কলেজে পড়ার সময় নিজে নিজেই সব করতে হয়েছিলো। টিচাররাই সব দ্বায়িত্ব নিবেন, এইরকম কিছু ছিলনা। কয়েকদিন আগে এক রেডিও চ্যানেলে ঢাকার একটি কলেজের কথা শুনলাম সেই কলেজের কর্মকর্তার মুখে তিনি যা বললেন তার আসল কথা হলো...” এটি একটি সম্পূর্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হয়না, কলেজ থেকেই হ্যান্ডনোট দেয়া হয়, প্রতি বিষয়ের মোট ৫০/৬০ প্রশ্ন প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের মুখস্ত করানো হয় এবং তা তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়।

এই পদ্ধতির ফলে তাদের জি.পি.এ ৫.০০ পেতে খুব সহজ হয়ে যায়। “ ২০১১ সালে এসেও এই মুখস্তের মত মেধা ধ্বংস করার মত পদ্ধতির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আর “জি.পি.এ ৫.০০ পেতেই হবে না হলে সব শেষ” এই রকম উদ্ভট ভাবনা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক ভয়ঙ্কর খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। ...নটরডেম কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষার পর কোন মডেল টেস্ট হয়নি। আমার নিজেরই এখানে সেখানে ঘুরে “মডেল টেস্ট” দিতে হয়েছিল।

তবে এতে আমার কোন দুঃখ নেই। আমি যে “আত্মিক শিক্ষা” পেয়েছি সেটাই আমার জীবনের মুল্যবান পাথেয় হয়ে থাকবে। দীপক স্যারের কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি ক্লাসে আসার সময় সাথে করে ““Philip Kotler” এর বই নিয়ে আসতেন, একদিনও বাদ দেননি। ওই বইয়ের মলাটও খুলে গিয়েছিল, তবুও তিনি ওই বই আনতেন।

তবে তিনি ওই বই ক্লাসে একদিনও খুলেননি, তিনি যেভাবে বইটি নিয়ে আসতেন, সেভাবেই নিয়ে যেতেন। আর্মির পোশাক পড়া কাওকে দেখলে যেমন অকারনেই ভক্তিভাব জেগে ওঠে, স্যার মনে হয় আমাদের ভক্তিভাব জাগানোর জন্যই ওই বই নিয়ে আসতেন। কিছুদিন আগে নটরডেম কলেজের সাইট দেখলাম। ওখানে দীপক স্যার এর নাম নেই। স্যার মনে হয় বাইরে চলে গিয়েছেন।

স্যার....যেখানেই থাকেন না কেন আপনার প্রতি রইল আমার শুভকামনা। .....(চলবে) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।