আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ জেলখানার ডায়েরী

বুদ্ধিমত্তা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আপনি তখনই বুদ্ধিমান যখন আপনার পাশের লোক বোকা !! শরীর আর চলতে চাইছে না। আর চলবেই বা কিভাবে গতকাল থেকে শরীরের উপর তো আর কম ঝাক্কি যায়নি। থানা হাজতে ভোরের দিকে একটু বিশ্রাম পেয়েছিলাম সেখানেই দেয়ালে ঢেস দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম। কোন এক সুহৃদয় হাজতী কি মনে করে একটা আধ খাওয়া সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে ডাক দিল, ভাইজান নেন দুইডা টান দেন।

চোখ খুলে একটু অবাক হলাম। ভাবলাম তাহলে কি সেক্সপিয়ারের কথাই ঠিক! সত্যিই কি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের মনের ভাষা আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষ বুঝতে পারে? যাইহোক এত ফিলোসফিক্যাল এনালাইসিসের মতো অবস্থা নেই। পূর্ণিমা চাঁদ এখন ঝলসানো রুটি। হাত বাড়িয়ে আধ খাওয়া সিগারেটটা নিলাম। যদিও সিগারেট টানার মতো মুখের অবস্থা তেমনটা নেই।

আহত মুখ আর মুখের ভেতরের কিছু ডাক্তারী সেলায় বার বার বাধা দিচ্ছে ঠোঁট দু'টো একত্র করতে। তবুও কষ্ট করে কসরত করে চেষ্টা করলাম সিগারেটে দু'টো সুখটান দেয়ার। সিগারেটে টান দিতেই নাড়ীভুঁড়ি সব উলটে আসতে চাইল। বুঝতে পারলাম এতটা ধকল শরীর মহাশয় ভালো ভাবে গ্রহন করতে পারেনি। এদিকে নিজেও বুঝতে পারছি শরীরের ব্যাথা বাড়ছে সাথে মাথার ভারে মাথাটা ছিঁড়ে যেতে চাইছে।

ও আল্লাহ একটু শক্তি দাও। একটু শুতে পারলে ভালো হত কিন্তু শরীরটাকে এতটুকু সরিয়ে নেয়ার মতো শক্তি মনেহয় আর অবশিষ্ঠ নেই। একটু নড়তে চাইলেই ব্যাথায় শরীরটা ভেঙ্গে আসতে চায়। ঠেস দিয়ে বসে থাকা অবস্থায়ই চোখ বন্ধ করলাম। মাথার অসহ্য যন্ত্রণা মনে হচ্ছে চোখ ছিড়ে বেড়িয়ে আসবে।

হয়তো এভাবেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম অথবা ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলাম কারণ বিক্ষিপ্ত এলোমেলে হ্যালুসিনেশন গুলো ঠিক ঘুমের সাথে যায়না। হাজতী জেলখানা সব কিছু কেমন যেন একটি অবাস্তব জগতের প্রতিবিম্ব মনে হতে থাকে। এদিকে এক হাজতী সারটা সময় ধরে নিজ মনে গুন গুন করে কি জানি গাইছিল। সকালে সম্বিৎ ফিরে পেলাম এক পুলিশের ডাকে। হাতে একগ্লাস দুধ আর একটি ব্যাথার ঔষধ ধরিয়ে বলল, এগুলা খেয়ে নিন আর টয়লেটের ঝামেলা সেরে নিন, কোর্টে যেতে হবে।

খাওয়ার মতো অবস্থা নেই তাই সেভাবেই রেখে দিলাম। এক হাজতি এসে বলল, ভাই কষ্ট কইরা খাইয়া নেইন, সারাদিন বহুত ধকল যাইব। এই বলে সে দুধটা আর ঔষধটা খেতে আমাকে সাহায্য করল। বুঝতে পারছি টয়লেট সেরে নেয়া প্রয়োজন পুলিশ মশাই আরেকবার এসে তাড়া দিয়ে গেছে। কিন্তু দুপায়ে ভর করে দাঁড়াব এমন শক্তি মনেহয় আর অবশিষ্ঠ নেই।

কোন এক হাজতিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ভাই আমাকে একটু ধরে দাঁড় করিয়ে দিবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বললাম আর কোন দু'জন আমাকে ধরে তুলতে আসল কিছুই বুঝলাম না। দু'জন হাজতি এসে ধরে তুলে আমাকে টয়লেটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। দুধটা আর ঔষধটা খাওয়ায় কিছুটা কাজ হয়েছে, নিজের শরীরের উপর অনেকটা নির্ভর করতে পারছি। পুলিশ হয়তো তার অভিজ্ঞতার আলোকে জেনে বুঝেই ঔষধটা দিয়েছে।

অবশেষে আবার হাতকড়া, পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় উঠে বসলাম পুলিশ ভ্যানে। গন্তব্য জেলা আদালত প্রাঙ্গন। শরীরও অনেকটা সয়ে এসেছে কিছু বুঝতে পারছি জ্বর এসে গেছে, মাথাটা আবার ভারী হয়ে আসছে, কেমন যেন শীত শীত লাগছে। মনে মনে শুধু একটা কথাই জপছি, সহ্য কর! সহ্য কর! আল্লাহ শক্তি দাও!! অনেকটা পথ পেড়িয়ে অবশেষে চলে এলাম আদালত প্রঙ্গনে। সাথে হাজতীদের আরো কয়েকজন রয়েছে দেখে কিছুটা আস্বস্থ হলাম।

কারণ কাল রাত থেকে তারাই আমার সবচে আপন জন! আদালতের অস্থায়ী হাজতখানার গ্রীলের সাথে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় অপেক্ষা করতে থাকলাম অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। আল্লাহর কাছে তখন একটাই চাওয়া আদালত যাতে পুলিশের রিমান্ড মঞ্জুর না করে। এদিকে জ্বর মনেহয় ক্রমেই বাড়ছে, শরীরে শীতের তীব্রটা টের পাচ্ছি, মাথাটা আবার ধরেছে। অবশেষে সুদীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আল্লাহ আমার চাওয়া শুনলেন, আদালত পুলিশের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর না করে আমাকে পাঠিয়ে দিল জেল হাজতে।

হাজতের গাড়ী অন্যান্য কয়েদীদের সাথে করে নিয়ে চলল জেলখানার দিকে। আবারো পিছমোড়া করে হাতকড়া বাধা অবস্থায় হাঁটু মুড়ে দাঁড় করিয়ে দিল জেলখানার মূল ফটকের সামনে। কিভাবে দাঁড়াতে পারছি বা কিভাবে এতটুকু সহ্যশক্তি পাচ্ছি জানিনা শুধু বারবার মনেহচ্ছে এই বুঝি জ্ঞান হারাচ্ছি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মুল ফটক পেড়িয়ে ঢুকে গেলাম জেলখানায়। খুলে গেল হাতকড়া।

দু'জন জেল প্রহরী অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে নিয়ে চলল জেলখানার মেডিক্যাল ওয়ার্ডের দিকে। ছেড়া, রক্ত আর ঘামে ভেজা আমার কাপড় চোপর দেখেই হয়তো ডাক্তার সাহেব কিঞ্চিত বিভ্রান্ত হলেন। বুঝতে পারলাম হয়তো এ ডাক্তার নতুন জেলখানায় জয়েন করেছে। ক্রিমিন্যালদের সাথে নিজেকে এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি। মুখে বিভ্রান্তির সাথে কিছুটা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

ডাক্তার আমার শরীরে হাত রেখে কিছুটা চমকে উঠে বললে এ তো অনেক জ্বর, কেমন বোধ করছেন এখন। আমি উত্তর দিলাম না, ডাক্তার আমার জ্বর মেপে কাটা জায়গা নতুন করে ড্রেসিং করিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখে পাঠিয়ে দিল ওয়ার্ডে। মনে মনে যতটুকু কল্পনা করেছিলাম ওয়ার্ডের অবস্থা দেখলাম তার চাইতে ভালো। জেলেই কাজ করে এমন এক কয়েদী ফ্লোরে ত্রিপল বিছিয়ে দিল। একটি কম্বল মাথার বালিশ বানিয়ে আরকটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।

শরীর আর চলতে চাইছে না। ক্লান্ত বিধ্বস্ত আহত এই আমার বুজা চোখে আবছা ঘুমের ঘোরে শুধু একটাই ভাবনা আমাকে আমার মায়ের কাছে যেতে হবে। * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * (জীবনে প্রথমবারের মতো ছোটগল্প লেখার চেষ্টা। লেখার ভুলত্রুটি এবং অসামঞ্জন্য মার্জনীয়। ) *কুনোব্যাঙ* নিকটি ছেড়ে দিয়ে দেখি নিকটির জন্য কেমন জানি মায়া হচ্ছে তাই নতুন নিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এই নিকেই থেকে গেলাম।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।