~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~ (১)
সকাল থেকে পর পর কয়েকটা টেক্সটের রিপ্লাই নেই। কয়েকবার কল দেয়াও হয়ে গেছে, কেউ ধরছে না। টেনশনে পড়ে গেলাম রীতিমত। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, যে কোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেই যেতে পারে। এতদূর থেকে আর কোন ভাবে খোঁজ নেবারও উপায় নেই।
ওর তো আজকে সকালে ক্লাসে যাবার কথা। বাসায় মোবাইল ফেলে ক্লাসে চলে গেল? না কি ছিনতাই হয়ে গেল ব্যাগ? অথবা কোন দুর্ঘটনা ... । নাহ, ভাবতে পারছিনা আর।
: কেমন আছো?
: কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কেমন আছো তুমি?
: ভাল ছিলাম, ভাল আছি।
: টেনশন করে করে আমি শেষ।
সকাল থেকে ম্যাসেজ দাওনি কেন?
: তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
: বলো, তার আগে বলো তুমি সত্যি ভাল আছো তো?
: আমি তোমার ফেসবুক একাউন্টে ঢুকেছিলাম গতকাল। আমার সে অধিকার আছে অবশ্যই। তারপরও স্যরি, তোমার ইনবক্সে গিয়ে কিছু ম্যাসেজ পড়েছি।
: স্যরি হবার কিছু নেই।
পাসওয়ার্ড তোমাকে দেয়া আছে লগইন করবার জন্যই।
: মেয়েদের সাথে তো ভালই কথাবার্তা হয় তোমার।
: তোমার অজানা নয় এটা।
: না, তা নয়। কিন্তু নীলার সাথে তোমার কনভারসেশন পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি।
আমি তোমাকে বলেছিলাম এই মেয়েটাকে এড়িয়ে চলতে। অথচ তুমি কত সুন্দর করে গুছিয়ে গুছিয়ে ম্যাসেজ দিচ্ছো তাকে। তোমাদের মধ্যে কি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে না?
: নীলা আমার বন্ধু, তুমি জানো ভালই। ওর সাথে আমার অনেক ধরনের কথা হয়।
: আমি সেটা বলছি না।
তুমি সিরিয়াসলি বলো তো, তুমি কি ওকে ভালবাসো?
: দেখো, তুমি আমার কি সেটা তোমার বোঝা উচিত।
: আমি বুঝি বলেই তো তোমাকে বলেছিলাম ওই মেয়ের থেকে দূরে থাকতে।
: তুমি ছাড়া আমার অন্য কোন বন্ধু থাকতে পারবে না? আমরা বেশ ভাল বন্ধু। আমি জানি তোমার সাথে ওর কোন ভাবেই তুলনা চলে না। কি সমস্যা ওর সাথে মিশলে?
: সমস্যা আছে।
শোনো, তুমি হয় আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে, না হয় ওর সাথে। ভেবে দেখো, আর আমাকে জানাও।
খুব দিশেহারা লাগছে আমার। রাগও লাগছে প্রচণ্ড। অযথা সন্দেহ করা মানেই আমাকে অবিশ্বাস করা।
একটা মেয়ের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকা মানেই এই নয় যে আমি তার সাথে প্রেম করতে চাচ্ছি। ওকে ভালবাসি বলে কি অন্য কোন মেয়ের মেশা যাবে না? বিশ্বাস ভালবাসার একটা বড় অংশ। সেই বিশ্বাস হারিয়ে গেলে ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার।
(২)
ম্যাসেঞ্জারে ওর নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলে আছে অনেকক্ষণ থেকে। আমাকে দেখছেনা সে, কিন্তু আমি দেখছি।
ইদানীং অনলাইন হওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। আড়াল থেকে দেখে যাই সব কিছু। কমেন্ট করা হয়ে ওঠেনা। অযথা কথা শুনতে কার ভাল লাগে? এই তো সেদিন, রূপকথার ছবিতে কমেন্ট করাতে কি সব বললো আমাকে ...
: তোমার কি ইদানীং রূপকথাকে বেশ ভাল লাগে?
: ও আমার বোন, এটা কেমন কথা বললে তুমি?
: নেটে পাওয়া বোন, যে কোন সময় সম্পর্ক চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।
অসহ্য রাগে নিজের চুল টেনে ধরেছিলাম।
এটা কেমন কথা? ওর সাথেও পরিচয় অনলাইনেই। অনলাইনের সম্পর্ক কি শুধুই ভার্চুয়াল? স্কুল কলেজে, এলাকাতে, না না কাজে আমাদের কত মানুষের সাথেই তো পরিচিত হতে হয়। এদের কেউ কেউ বন্ধু হয়ে ওঠে, একেবারে আপন হয়ে যায়। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটিকেও আমি কয়েক বছর আগে চিনতাম না। অনলাইনে পরিচিত মানুষগুলিও তো সেই রকমই।
যার সাথে মতের আর পছন্দের মিল হয়, সেই তো আপন হয়ে ওঠে। সামনা সামনি দেখা হওয়াটা কতটা জরুরী? ভার্চুয়াল রিলেশন বলে আসলে কিছু নেই। যাদের সাথে কোনদিন দেখা হয়নি, তারাও সামনা সামনি দেখা হওয়া মানুষটার মতই প্রিয়।
মোবাইলে ম্যাসেজের শব্দে বাস্তবে ফিরে আসি। "তুমি কি আছো অনলাইনে? একটা কল দিবে?" আমার ইচ্ছে করছে না কথা বলতে।
সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কারও সাথে কথা বলাটা পেইনফুল।
: অনলাইনে ছিলাম না। বলো।
: তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছো?
: না, আমি একটু বেশী ব্যস্ত কয়েকদিন থেকে।
: ব্যস্ত না অন্য কোন দিকে সময় দিচ্ছো?
: না, আমি ... আসলে তোমার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না, অন্য কিছু বলো, প্লিজ।
: তা ইচ্ছে করবে কেন? যেদিন থেকে নীলার কথা বলেছি, সেদিন থেকেই তোমার আচরণ বদলে গেছে। আমাকে ভাল না লাগলে বলো ...
: প্লিজ, তুমি ...
: আমি কি? আমার কথা আর ভাল লাগে না, না?
: দেখো, আমি তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করাই যে আমার অন্য কোন মেয়ের ব্যাপারে আগ্রহ নেই। কারও সাথে ভাল রিলেশন থাকার মানে এই না যে আমাকে তার সাথে প্রেম করতে হবে।
: তাহলে নীলাকে এখনও রিমুভ করনি কেন?
: রিমুভ করিনি, কারণ সে আমার বেশ ভাল বন্ধু। আমি অকারণে তাকে রিমুভ করতে পারবো না।
: ওহ ... তাই? তাহলে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছার কোন মূল্য এখন আর নেই?
: ওভাবে দেখো না। তুমি তো শুধু ওর ব্যাপারে নেগেটিভ না, এমন আরও ডজন খানেক মেয়ের ব্যাপারেও তোমার অভিযোগ। কত জনের সাথে সম্পর্ক ভাঙবো আমি?
: আচ্ছা? তাহলে আর কয়টা মেয়ের সাথে সম্পর্ক চলে তোমার?
মোবাইলটা দেয়ালের গায়ে ছুড়ে ফেলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম আমি।
(৩)
আমার সকালটা শুরু হতো ওর সাথে কথা বলে, ভালবাসার তীব্র অথচ মিষ্টি একটা আমেজ নিয়ে। এখন আর তেমন হয় না।
বেশীরভাগ দিনেই "কেমন আছো" টাইপের কয়েকটা কথা, তার পরেই শুরু হয় ঝগড়া। ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কটা আবার আগের মত করে নিতে খুব ইচ্ছে করে। ও দু একদিন ভাল থাকে, তারপর আবার সেই একই অভিযোগ।
: তুমি কেন এমন করো? আমার ওপর বিশ্বাস নেই তোমার?
: ভয় হয় অনেক, আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। যদি হারিয়ে ফেলি?
: আমাকে তুমি হারাবে না।
তোমাকে ভালবেসেছি আমার সবটুকু দিয়েই। কেউ তোমার স্থান নিতে পারবে না।
: তবুও ভয় তো থাকেই।
: তুমি যে কত ছেলের সাথে কথা বলো, আমি কি কখনও কিছু বলেছি?
: তুমি জানো আমার আর কারও সাথে এমন কিছু নেই।
: তবে তুমি কেন সে বিশ্বাস রাখতে পারো না?
: আমার মনে হয় অনেক মেয়ে তোমার সাথে প্রেম করতে চায়।
: চাইতে পারে, আমি তো চাই না।
: তোমার আচরণের পার্থক্য দেখতে পাই আমি, তাই ভয় পাই।
: কি পার্থক্য?
: নীলার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই তুমি বদলে গেছো।
: বদলাইনি ...
: সেদিন নীলাকে কি সুন্দর করে "Get Well Soon" বললে, এরপর আমি তোমাকে বললাম আমি অসুস্থ, তুমি দুঘণ্টা পর রিপ্লাই দিলে।
: আমি ব্যস্ত ছিলাম, আমি কাজে ছিলাম সে সময়।
: আগে তুমি এমন করতে না।
: আগেও করতাম, অযথা সন্দেহ করো না, প্লিজ, তোমার টেক্সট পেয়েই আমি কল দেইনি সেদিন?
: দিয়েছো, কিন্তু তোমার কথা কেমন যেন নিষ্প্রাণ ছিল।
: আমি ক্লান্ত ছিলাম তখন।
: অজুহাত দেবে না।
: আচ্ছা যা হোক।
: না, নীলার সাথে তোমার কিছু না থাকলে তুমি ওর সাথে মেশা বাদ দাওনা কেন?
: দেখো, আমরা যথেষ্ট বড় হয়েছি, এই সময় এই ধরণের ছেলেমানুষি মানায় না। আমি আমার মন থেকে জানি যে নীলাকে আমি অন্য চোখে দেখি না, প্রশ্নই ওঠে না। ওর সাথে মেশা বাদ দিয়ে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাব আমি।
: তুমি আসলে আমাকে আর গুরুত্ব দাও না, তাই। আর সেদিন নীলার কথা বলার পরেই ফোন কেটে দিলে, আর কলও করলে না।
আমাকে এভাবে অপমান করতেও আজকাল বাঁধেনা তোমার।
: আমি ফোনটা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম সেদিন।
: আমার ওপর এত রাগ?
: তোমার ওপর না, তোমার অনর্থক সন্দেহের ওপর।
: আমি অনর্থক সন্দেহ করি না। আমি খবর নিয়েছি, মেয়েটা কারও সাথে প্রেমও করেনা।
অবশ্যই কিছু আছে তোমাদের মাঝে।
: আমাদের মাঝে তেমন কিছুই নেই, প্লিজ বিশ্বাস করও আমাকে। আর সবাই কি প্রেম করে? ও হয় তো তেমন কাউকে খুঁজে পায়নি এখনও।
: তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনা, কখনই না, আমি জানি আমার চাইতে হাজারগুণ ভাল মেয়ে তুমি চাইলেই পাবে, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা তোমাকে।
: তুমি কি চাও আমি সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু তোমার হয়ে থাকি?
: না, তা কেন?
: তাহলে তুমি একটার পর একটা মেয়ে সম্পর্কে এমন সন্দেহ করে যাবে, আমার কেমন লাগে সেটা?
: আমি জানিনা, আমার ভয় করে।
এই মেয়ের সাথে কথা বাড়ানোর মানে হয় না। সন্দেহের বীজ কারও মনে একবার ঢুকে গেলে তাকে এ থেকে বের করে আনা যায় না। সম্পর্ক জিনিসটা কাঁচের মতই ঠুনকো। একবারে না ভাঙলেও সম্পর্কে চীর ধরলে সেটা আর জোড়া লাগে না। ক্ষতটা পূরণ হয় না কিছুতেই।
(৪)
একাকীত্ব আর সম্পর্ক ভাঙ্গার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খায় আমাকে। আমার কিছুই ভাল লাগে না। আমি কারও সাথে মিশতে পারি না, কথা বলতে পারিনা কারও সাথে।
মানুষের মাঝে সম্পর্ক হয়, ভেঙ্গেও যায়। সম্পর্ক গড়াটা যেমন কঠিন, ভেঙ্গে ফেলাটাও তেমনি কঠিন আর কষ্টের।
তবুও ... উপযুক্ত কোন কারণে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে নিজেকে বোঝাবার কিছু অন্তত থাকে। সে আমাকে হারিয়ে ফেললো, সুন্দর একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে দিলো সন্দেহের বশে। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে সে নিজেই আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। সম্পর্কের ভিত্তি যে বিশ্বাসে, সেই বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেললে আর কিছু বাকি থাকে না।
একজন মানুষের জীবনে হাজারটা মানুষ আসে।
কারও কারও কথা আমরা মনে রাখি সারা জীবন। কারও কথা দেখা হবার পরেই ভুলে যাই। কেউ কেউ হয়ে ওঠে অনেক আপন, কেউ বা একটু কম। শুধু মুখে বলে কারও সাথে সম্পর্কের গভীরতা বোঝানো যায় না। ব্যাপারটা অনুভবের আর বিশ্বাসের।
কারও সাথে ভালবাসা গড়ে ওঠার মানে এই নয় যে তাদের দুজনকে সারা পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। ভালবাসার মানুষটিকে তার দৈনন্দিন জীবন থেকে সরিয়ে আনা বা তা করার চেষ্টা করাটা বোকামি। হ্যাঁ ... ভালবাসা ধরে রাখতে হয়, নতুন করে রঙের প্রলেপ না দিলে ভালবাসাও এক সময় ফিকে হয় আসে। রঙ্গগুলো ম্লান হয়ে যায়। খুব কাছের মানুষটিকে কাছের করে রাখতে হয় সব সময়েই।
নিজের আবেগ গুলো, ভালবাসার রঙে রাঙ্গিয়ে নিতে হয়। পৃথিবীটা আসলেও অনেক বেশী কঠিন।
"If you love somebody, let them go, for if they return, they were always yours. If they don't, they never were." - Kahlil Gibran ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।