আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে । হাজার বছর ধরে বয়ে চলা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রম্মপুত্র-সুরমা বিধৌত আমার দেশ । কৃষক-মজুর-জেলে-ধোপা-তাতী'র শ্রম আর ঘামে গড়া আমার দেশ । হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ আর বাংগালী-সাঁওতাল-গারো-চাকমা-মং-মুরং-খাসিয়া-মনিপুরি সহ সকল ধর্ম সকল জাতির সম্মিলিত দেশ । অনাদিকাল থেকে উর্বর পলিমাটিতে কৃষক ফলিয়েছে সোনার ফসল, জেলে দিয়েছে মাছের যোগান, তাঁতি বুনেছে কাপড়, মজুর আর শ্রমিকেরা নির্মান করেছে সভ্যতার চাকা ।
বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান এখানে জালিকার মত বহমান নদীগুলোর মতই প্রাচীন, নিরবধি । উপমহাদেশে মুসলিম শাসন সিন্ধু বিজয় দিয়ে শুরু হলেও ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, ইসলাম ধর্ম উত্থানের শত বছরের মধ্যেই আরব বনিকদের মাধ্যমে চাঁটগা বন্দর দিয়ে বাংলায় আগমন ঘটে এই ধর্মের । আর কে না জানে, এই বংগভূমে ইসলাম তরবারি দিয়ে প্রতিষ্টিত হয়নি, হয়েছে কিছু মহান সুফি-দরবেশের হাত দিয়ে । সকল ধর্মের মানুষের কাছে আজও তারা শ্রদ্ধেয় । আবার ষোল শতকে হিন্দু ধর্মের সামাজিক এবং নৈতিক পতন যখন অনিবার্য, শ্রী চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব বানী তখন এই ধর্মকে শুধু এই বাংলায়ই নয় পুরো উপমহাদেশে নতুন প্রাণ সন্চার করেছিল ।
বৌদ্ধ ধর্মের মহান প্রচারক অতীশ দীপংকর এই বাংলার জল-কাদায় বেড়ে উঠেছিলেন । তিব্বতি বোদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে আজও তিনি পরম শ্রদ্ধেয় । আর আজ আমার দেশেই জ্বলছে চারশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রামু বৌদ্ধ মন্দির । যদি আশু নিভাতে না পারি, এ আগুনে পুড়বে আমার দেশ, হাজার বছরের গড়া সমাজ আর সভ্যতা ।
বাংলা অন্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস এবং জাতি হিসাবে বাংগালীর উত্থান যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই হাজার বছর ধরে বাংগালীরা একটা ধর্মীয় সহবস্থান আর সহনশীল সমাজ আর সভ্যতা বিনির্মান করেছেন ।
এই হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা আর জীবনযাপন চর্চা আজও বাংগালী বয়ে চলেছে একই মানসিকতা নিয়ে । সাম্প্রদায়িকতা আর জাতি বিভেদের বিষবাষ্প এখানে আরোপিত এবং সমাজের মুলস্রোতে এখনো অগ্রহনযোগ্য ।
ইতিহাসের পাতায় নজর দিলে দেখতে পাই তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের আমলে মগধ তথা বিহার-উত্তর প্রদেশ-বাংলা অন্চলে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে । তারই ধারাবাহিকতায় সপ্তম থেকে দশম শতক পর্যন্ত প্রায় চারশো বছর পাল রাজারা বাংলা শাসন করেছেন এবং তাদের সাম্রাজ্য ভারতের উত্তর হতে দক্ষিন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছিলেন । পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি এবং পৃষ্টপোষক ছিলেন ।
মূলতঃ পাল আমলেই বাংগালী জনগোষ্টির স্বতন্ত্র বৈশিষ্টগুলি চিহ্নিত হতে থাকে এবং বাংলা ভাষার বিকাশও তখন থেকেই সূচনা হয় । নরম-পলিমাটির বাংলার মানুষেরা তখন বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদে আকৃষ্ট হয় । পাল আমলে বাংগালীর সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পাহাড়পুর, ময়নামতি, সোমপুর বিহারগুলি আজও সেই সভ্যতার উৎকর্ষের স্বাক্ষ্য বহন করে । দশম শতাব্দির পরে বাংলা সেন রাজাদের অধীনে আসে । সেন রাজারা মুলত দক্ষিন ভারত হতে আসা কট্টর হিন্দু ছিলেন ।
তারা তাদের সংগে করে বাংলায় হিন্দু জাতভেদ আর কট্টর অনুশাসন নিয়ে আসে । এই সময়ে সংখ্যাগরিষ্ট বৌদ্ধরা বাংলায় কোনটাসা হতে থাকে , রাস্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতা পেয়ে হিন্দু ধর্ম বাংগালী সমাজের চালিকা শক্তির আসন নিয়ে নেয় ।
বারশো শতাব্দিতে বখতিয়ার খলজির হাতে সেন রাজবংশের পতনের পর বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা হয় । কিন্তু বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের অনেক আগেই এমনকি সিন্ধু বিজয়েরও আগে আরব বনিকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম ধর্ম এসেছিল । তবে ইসলাম ধর্ম মূলত পারস্য হতে আগত সুফী-দরবেশদের মাধ্যমে বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
সেন রাজত্বের শেষের দিকে সমাজে কোনঠাসা হয়ে পড়া বৌদ্ধ আর সাধারন হিন্দুরা দলে দলে এই সূফী-দরবেশদের হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ।
সিন্ধু বিজয়ের পর চার শতক উপমহাদেশ কট্টর তুর্কী এবং আফগান সুলতানদের মাধ্যমে শাসিত হয় । কিন্তু দিল্লী থেকে দূরত্ব আর এই বাংলা অন্চলের মানুষের সহজাত স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য আফগান সুলতানরা অনেকটা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করে । এই শাসকেরা ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি, ধর্ম আর ভাষার সাথে একাত্ম হয়ে যায় । সুলতানী আমলে বাংলা ভাষা ব্যাপক রাষ্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতা লাভ করে এবং রাজন্যেরা স্থানীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং জীবনচারনে অভ্যস্ত হয়ে যায় ।
সুলতানী আমলের শেষের দিকে মুঘলরা যখন বাংলা দখল করতে আসে, তখন স্থানীয় মুসলিম এবং হিন্দু শাসকদের যৌথ প্রতিরোধের সম্মুখিন হয় । এই শাসকেরা ভিন্ন ধর্মের অনুসারি হলেও বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে জোটবদ্ধ হয় এবং বাংলার বারো ভূইয়া নামে পরিচিত লাভ করে । কিন্তু বানের মত ধেয়ে আসা প্রবল পরাক্রম মুঘলদের কাছে তারা পরাজিত হন ।
মুঘলরা বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও বাংলার চলমান সমাজ ব্যাবস্থায় তারা কোনও পরিবর্তন আনেনি । কারন মুঘলরা সাম্রাজ্য পরিচালনায় স্থানীয় ধর্ম এবং সমাজের সাথে বিরোধ এড়িয়ে চলতো ।
তাই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধের মিলিত প্রচেষ্টায় যে বাংগালী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, মুঘলরা আসার পরে তাতে কোন বাধা পড়েনি ।
ষোল শতকে ইউরোপিয় বনিকদের সাথে সম্রাট জাহাংগীরের বানিজ্য চুক্তির ফলে বাংলায় ব্যাপকভাবে আর্মেনীয়, গ্রীক, ইংরেজ, ফ্রেন্চ, পর্তুগীজ বনিকরা আসতে থাকে । বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তারা গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে । ব্যবসার প্রয়োজনেই তারা নিজেদের স্বতন্ত্র বসতি এবং চার্চ গড়ে তুলে । কিছু স্থানীয় মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তারা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করে ।
এই ইউরোপিয় বনিকেরা স্থানীয় ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই স্থানীয়দের সাথে একরকম মিলেমিশেই থাকতেন ।
এদিকে সেন আমলের শেষের দিকে সাধারন হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে থাকে এবং কয়েক শতাব্দি ধরে এই প্রবনতা চলতে থাকে। এই সময়ে হিন্দু ধর্ম আরও কট্টর, কঠিন অনুশাসনের বৃত্তে আবদ্ধ হতে থাকে । সামগ্রিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, যখন হিন্দু ধর্ম প্রকট অস্থিত্বের সংকটে পড়ে । এই পর্যায়ে ষোল শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করতে থাকেন ।
বৈষ্ণব ধর্মের সহজিয়া প্রথা, অনুশাসন হিন্দুদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে । চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধারা প্রচারনার জন্য বাংলায় হিন্দু ধর্ম তার অবস্থান ফিরে পায় ।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের কূটচালে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায় । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে শাসনব্যবস্থা কায়েম করে । কিন্তু বাংগালী সমাজে তখনও ফকির-সন্যাসীদের ব্যাপক প্রভাব ।
ফকির-সন্যাসীরা মূলত মানব প্রেম আর সকল ধর্মের একই গন্থব্যের কথা বলতেন । তারাই ছিলেন তৎকালীন বাংগালী সমাজের বিবেক । এই ফকির-সন্যাসীরা রাস্ট্রক্ষমতা দখলকারী বহিরাগত ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং বাংগালী সমাজকে সাথে নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেন । পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহও ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানদের যৌথ প্রতিরোধ । এই ফকির-সন্যাসীদের চেতনা আজও আমরা ধারন করি বাংগালী মানসপটে, লালন-হাসন-করিম সহ অজস্র বাউলের গানে ।
ইংরেজরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘ করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দেয় । হাজার বছরের ইতিহাসে বাংগালী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে সমাজ, যে সভ্যতা , যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, ব্রিটিশরা সেখানে সফলভাবে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দেয় । উপমহাদেশে শিক্ষা আর অর্থনীতিতে নেতৃত্বদানকারি বাংগালীকে বিভক্ত করার জন্য সাম্প্রদায়িক দাংগা লাগিয়ে দেয় । এবং তাদের কূটচালে আমরা পূনরায় পাকিস্থান নামক দেশের উপনিবেশে পরিনত হই । কিন্তু বাংগালী চেতনা বেশীদিন দমিয়ে রাখা যায়নি ।
১৯৫২ সালেই আবার বাংগালীরা যুথবদ্ধ হয়ে ভাষার সংগ্রামে নামেন । যার ধারাবাহিক পরিনতিতে আমরা ১৯৭১ সালে চুড়ান্তভাবে স্বাধীনতা অর্জন করি ।
তাই হাজার বছর ধরে আমরা বাংগালীরা, বাংগালী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যৌথভাবে যে সমাজ, যে সভ্যতা, যে রাস্ট্র বিনির্মান করেছি, তা কিছু সাম্প্রদায়িক ক্রিড়নকের কূটচালে বিনস্ট হতে পারেনা । আমরা আবার যুথবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াব । এই প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির শুধু বৌদ্ধদের নয়, হিন্দু মন্দির শুধু হিন্দুদের নয়, মসজিদ শুধু মুসলমানের নয় ।
এটা আমাদের, এটা বাংগালীদের, এটা বাংলাদেশের সকল মানুষের তীর্থস্থান । হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা এই সমাজে আমরা কোন সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ হতে দিতে পারিনা । আমরা সম্মিলিত ভাবে, যুথবদ্ধভাবে এই সমাজ এই সভ্যতা এই রাস্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাব সুন্দর সমৃদ্ধ আর মংগলময় ভবিষ্যতের পথে ।
( পোস্টের শিরোনাম জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি এবং কবি অধ্যাপক খালেদ হোসাইন স্যারের কবিতা থেকে নেয়া । ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।