গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত এগারটার সময় ক∙বাজারের রামুতে শতাব্দীরও পুরণো বৌদ্ধ মন্দির গুড়িয়ে দিয়েছে কিছু নামধারী মুসলমান। এতে আহত হয়েছে অনেক আর বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে প্রায় হাজারেরও অধিক মানুষ। এর আগে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কে নিয়ে আমেরিকায় এক ইহুদী ছবি বানিয়ে আমাদেও প্রাণের চেয়েও প্রিয় রাসূল (স.) এর পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। যাতে সারা বিশ্বের তৌহিদী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর ফলে ঐ ছবি নির্মাতাকে সেখানকার সরকার গ্রেফতার করেছে।
শুধু তাই নয় মহানবীর দুইজন বিশিষ্ট সাহাবী আবুবকর ও উমর (রা.) কে নিয়েও ব্যঙ বিদ্রুপ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি আমাদের পাশ্ববর্তী দেশের শান্তি আর মানবতার আদর্শবাহী গৌতম বুদ্ধের অনুসারী বৌদ্ধ বিক্ষুরা কিভাবে মুসলমানদেরকে হত্যা করেছিল। বাড়ি ঘরে আগুণ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মুসলমানদেরকে তাদের শত বছরের পুরণো ভিটে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। তাদের রক্তে সিক্ত হয়েছে মায়ানমারের মাটি।
দূষিত হয়েছিল মায়ানমারের বাতাস। গত ২৮ মে মায়ানমারের আরাকানে এক খোঁড়া অজুহাতে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলো, ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে যখন হত্যা করা হলো। রয়টার্স ও এএফপির খবর মতে, চলমান এ সহিংসতায় ৩০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। এরা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেয়েও প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড তাদেরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না।
এইতো গেল মায়ানমারের ঘটনা। এবার দেখা যাক আমরা কতটুকু শান্তিতে রাখছি আমাদের দেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকদেরকে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর রামুতে ফেসবুকে কোরআনকে অবমাননা করে একজন বৌদ্ধ ছেলে একটি ছবি পোস্ট করে তার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সূত্রপাত হয়। সেদিন রাতে আওয়ামীলীগই প্রথম এর প্রতিবাদে মিছিল বের করেছিল। এটা নিঃসন্দেহে ভাল একটি কাজ করার মত বিষয়ও বটে।
কিন্তু তার পরে যেটা হয়েছে যেটা ঘটেছে তা কোন বিবেকবান মানুই সার্পোট দিকে পারে না। আমার বুঝে আসে না যে বর্তমান বিশ্বের মানুষরা কেন যে এত বেশি অসহিষ্ণু আর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে গেছে। কোন ধর্মের মানুষ আর কোন ধর্মের মানুষদেরকে যেন সহ্যই করতে পারছে না। ভারতে প্রতি বছর মুসলমানদেরকে হত্যা করা হয় খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে। এতে সে দেশে কিছু প্রতিবাদ হলেও আমাদের দেশের বড় বড় জাদরেল বুদ্ধিজীবীরা তখন মুখে কূলুপ এতে বসে থাকেন।
আর নিজের জামা কাপড় ঠিক করতে থাকেন।
বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংসের প্রতিবাদে গত ২ অক্টোবর, শাহবাগ জাদুঘরের সামনে এক প্রতিবাদ সামাবেশ করা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে-লেখক-শিল্পী সংস্কৃতিক কর্মী এর ব্যানারে। এতে দেশের অনেক নামিদামী গুনী লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। উক্ত প্রোগ্রামে আমিও একজন দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ব্যানারে স্লোগান হিসেবে লেখা ছিল- ‘বাংলার হিন্দু/বাংলার মুসলিম/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার খ্রীস্টান/ বাংলার আদিবাসী/ আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।
’ লেখাটি অনেক ভালো তাৎপর্যপূর্ণও বটে। প্রতিটি লাইন ব্যাখ্যা করার মতো। উক্ত প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন:দেশের প্রবীন বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট কলামিষ্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সাংবাদিক, আমার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন আনিসুল হক। বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ।
নাট্যাভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। অভিনেত্রী বণ্যা মির্জা। কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রফেসর সুকোমল বড়–য়া। জাহাঞ্জীর নগর বিশ্ব বিদ্যায়য়ের প্রফেসর মানস চৌধুরী।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বাকী বিল্লাহ। সাংবাদিক, অঞ্জন রায় ও ফারুক ওয়াসিফ। সি আর আবরার। শিমুল মোস্তফা, জুনায়েদ সাকী, অরূপ রাহী ও ফিরোজ আহমেদ। সবাই খুব ভাল ভাল কথা বলেছেন।
তবে আমার কাছে সি আর আবরার, ফিরোজ আহমদ, ফারুক ওয়াসিফ এর কথা ভালো লেগেছে। তারা কিছুটা হলেও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে কথা বলেছেন। অন্যান্যরা খারাপ বক্তব্য দিয়েছেন তা আমি বলব না। তবে তারা কেন জানি বিবেকের দায়মুক্ত থেকে কথা বলতে পারছিলেন না। কোথাও যেন আষ্টেপিষ্টে তাদের হাত পা বাঁধা আছে।
তাই তারা শুধু বৌদ্ধদের কথা বলেছেন কিন্তু মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান হত্যার ব্যাপারে তারা টু শব্দও করেননি। এতে পরিস্কার হয় যে, তারা শুধুমাত্র এক পক্ষীয় উকালতি করছেন। আপনি দেখবেন কোন মানুষ যখন এক পক্ষীয় উকালতি করে তখন যে আর সত্যের থাকে না। সে হয়ে পড়ে অসত্যের। আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সত্যের মত বদমাশ’ গল্পে সত্য আর বদমাশ এর পরিচয় অনন্ত সুক্ষèভাবে তুলে ধরেছেন।
সেদিন সুকোমল বড়–য়া চোখের পানিতে শাহবাগের পীচঢালা পথ ভিজে গিয়েছে; তাঁর কান্দা দেখে আমি নিজেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু বক্তব্য শুনছি আর ভাবছি এভাবে তো আমাদের দেশ থেকে আর পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার আর ভারত থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কমবে না বরং বাড়বে। কারণ আমাদের দেশের এ সকল বুদ্ধিজীবীরা শুধুমাত্র হিন্দুদের পক্ষে বৌদ্ধদের পক্ষে খ্রীস্টানদের পক্ষে কথা বলেন আর লিখেন। কিন্তু মুসলমানদের পক্ষে কথা বলেন না। মুসলমানদের রক্ত দেখলে তাদের বুক কেঁপে উঠেনা।
আমার ভাবতে লজ্জ্বা লাগে যে এ সকল বুদ্ধিজীবীরা আবার নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করেন পরিচয় দেন।
আমি চাই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, সুন্দরের পক্ষে কাথা বলুক। লেখালেখি করুক। সকল জাতির মানুষদেরকে তারা তাদের বক্তব্য আর লেখনির মাধ্যমে সত্যের পথ নির্দেশ করবে। মুক্ত দেবে সাম্প্রদায়িক গোলামী আর ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে।
কেবল তাহলেই এ সকল বুদ্ধিজীবীরা জনগণের আস্থা আর ভালবাসা অর্জন করবে। না হয় জনগণ এত বোকা না যে আপনাদের যে-কোন লেখা আর যে-কোন লেখনির মাধ্যমে জাতি আপনাদেরকে নম্ নম্ করবে। এ রকম ধারণা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আমার কাছে বাংলাদেশের দুইজন বুদ্ধিজীবীকে প্রকৃতি বুদ্ধিজীবী বলে মনে হয় তাদের একজন হলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর আসিফ নজরুল অপরজন হলেন নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির। তাদেরকে দেখা যায় দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সত্য কথা বলতে।
বুদ্ধিজীবীর প্রকৃতি কাজতো প্রকৃত সত্যকে জগগণের কাছে তুলে ধরা এবং এর জন্য সমাধানের পথ বাতলে দেয়া। পায়দা লোটা নয়। আমরা যদি এ রকম ক্ষুদ্র মানসিকতা পরিহার করতে না পারি তাহলে এ রকম হত্যা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাড়তেই থাকবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শান্তি প্রিয় একজন মানুষ। কোন প্রকার হানাহানি মারামারি ধর্মীয় গোঁড়ামি দলাদলি আমি কখনো সমর্থন দেই না।
আমি মায়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের যে রকমভাবে ব্যথিত এ কষ্ট পেয়েছি তার ছেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি আমাদের দেশর বৌদ্ধদের মূর্তি ধ্বংস করাতে। এটা আমাদের জন্য একাধারে লজ্জ্বা আপমান আর সংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় বহন করছে। সরকারের উচিৎ দোষী ব্যক্তিদেরকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ রকম হীন কাজ করার সাহস না পায়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিচয় দিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও এ পরিচয় বজায় থাকবে এটাই আমি এবং দেশবাসীর প্রাণের কথা, মনের কথা আজন্ম চাওয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।