সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! গতকাল রাত্রে আমার এক বন্ধুকে ফোন করে তাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলাম। ধর্মবিশ্বাস বিবেচনায় আনলে বন্ধুটি নাস্তিক। তবে বাবা-মায়ের দেয়া তার নামটি যেহেতু একটি বিশেষ ধর্মকে নির্দেশ করে তাই এ সাবধানতার পরামর্শ। এ পরামর্শ কোন অবস্থায়ই সুখকর নয়। একটা চরম লজ্জা এবং গ্লানিবোধ আমাকে গ্রাস করেছিল তখন।
স্বাধীনতার চার দশক পরেও একজন নাগরিককে শুধুমাত্র তার নামের কারণে বা ধর্মবিশ্বাসের কারণে আমাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিতে হয়। সাম্য আর সার্বজনীনতার শ্লোগান দিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এটাই কি সেই সাম্য আর সার্বজনীনতার নমুনা? আমি লজ্জিত বন্ধু, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা চাওয়া উচিত আসলে রাষ্ট্রের। লজ্জিত হওয়া উচিত আসলে রাষ্ট্রের।
কিন্তু আমি জানি রাষ্ট্র কখনই ক্ষমা চাইবে না। এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাবি করে রাষ্ট্র সব সময়ই তার পুত-পবিত্রতা প্রচার করবে।
হ্যাঁ, সব সময়ই এমন ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে প্রচার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে যখন এমনটা ঘটল তখন বলা হল এটা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। যখন পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরা, জামালপুর আর দিনাজপুরের চিরির বন্দরে এ ঘটনাগুলো ঘটছিল তখনও আমাদের জানানো হল এগুলো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’।
আজকে যখন রামু আর পটিয়ায় এমনটা ঘটছে তখনও কেউ কেউ বলছেন, এগুলো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। যারা ক্রমাগত এসব ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে প্রচার করে নিজেদের পুত-পবিত্র রাখার প্রয়াস চালাচ্ছেন তাদের-কে সবিনয়ে বলব, কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। অন্তত ভুক্তভোগীর জন্যে তো নয়ই। ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে প্রকারান্তরে তাকেই পরিহাস করা হচ্ছে যে তার আবাস হারিয়েছে। পরিহাস করা হচ্ছে তাকে যে তার উপার্জন হারিয়েছে।
পরিহাস করা করা হচ্ছে তাকে যে তার সম্ভ্রম হারিয়েছে।
মূলধারার মিডিয়াও এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখানোর প্রয়াস হিসেবে এতোদিন এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো সযতনে পরিহার করে আসছিলেন। অনেকে আবার বলেন, এসব খবর মিডিয়ায় আসলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। অনেকটা এমন যে, পাশের গ্রামের লোক পরিহাস করবে বলে আমি আমার গ্রামের চোরের বিচার করব না, তার অপকর্মকে আড়াল করব। বটে, সুন্দর যুক্তি।
কিন্তু যারা এই যুক্তি ছাড়ছেন তারা কি কখনও এটা ভেবেছেন যে, এর মাধ্যমে মূলত অন্যায়কেই প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এভাবে প্রশ্রয় পেয়েই এসব অন্যায়ের সীমারেখা একদিন অসীমের দিকে ধাবিত হবে।
আমি বরাবরই বলার চেষ্টা করেছি আমাদের সরকার বা মিডিয়ার উচিত হবে এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে প্রচার না করে সঠিক এবং পুরোপুরি তথ্য প্রকাশ করা, দোষীদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। হাটহাজারীর যে ব্যক্তি ৫০ টাকার বিনিময়ে রাজমিস্ত্রী-কে দিয়ে মসজিদ ভাঙিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছে যদি তার কঠিন ও প্রাপ্য বিচার হত তবে সাতক্ষীরা, জামালপুর, দিনাজপুর, কক্সবাজার অথবা চট্টগ্রামে এসব ঘটনা আর ঘটত না। রাষ্ট্রকে পুত-পবিত্র রাখার প্রয়াসে এসব ঘটনা আড়াল করায় এবং এর ফলে অপরাধীরা ক্রমাগত পার পেয়ে যাওয়ায় এ ধরণের ঘটনা বার বার ঘটছে।
যদি এই সাম্প্রদায়িক চক্রটিকে এখনই দমন না করা হয়, যদি এমনভাবেই আড়াল করা হয় তবে আমি নিশ্চিত এটি অচিরেই বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে তার ছায়ায় পুরো জাতির সভ্য রূপটাকে আড়াল করে দিবে।
তাই আর আড়াল নয়, এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। বিচার করতে হবে এ কারণে যে, যদি মানবতার বিরুদ্ধে কোন অপরাধ থাকে তবে এগুলো সেই অপরাধ। যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ থাকে তবে এগুলো সেই অপরাধ। যদি রাষ্ট্রকে কলুষিত করার কোন প্রয়াস থাকে তবে এগুলো সেই প্রয়াস।
রাষ্ট্র কেবলমাত্র তখনই নিজেকে পুত-পবিত্র দাবি করতে পারে যখন সে তাকে যারা কলুষিত করছে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে পারছে। সে লক্ষ্যে আমার দাবি থাকবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতোই এসব অপরাধের বিচার ট্রাইবুনাল বা বিশেষ আদালতের মাধ্যমে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। এ দাবি শুধু ব্যক্তি আমার নয়, এ দাবি মানবতাবোধ সম্পন্ন সকল মানুষের। মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই। কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলেই এমন অপরাধ আর সংঘটিত হবেনা।
আমি রাষ্ট্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই যে, বিশেষ নামের কারণে বা বিশেষ ধর্মের অনুসরণের কারণে মাঝ রাতে ফোন করে আমাকে যাতে কাউকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিতে না হয়। আমি এ লজ্জা আর গ্লানি থেকে নিষ্কৃতি চাই। আমি রাষ্ট্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই যে, বিশেষ নামের কারণে বা বিশেষ ধর্মের অনুসরণের কারণে কাউকে যাতে সাবধানে থাকার পরামর্শ শুনতে না হয়। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি করব, এসব মানবতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিন। রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তাদের প্রাপ্য শাস্তির ব্যবস্থা নিন।
শুধু কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে আপনার ইচ্ছার প্রমাণ দিন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।