যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর। ১. আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন কলেজে পড়ি। পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে।
কলেজ শেষে 'মুড়ির টিন' নামক বাসে করে গুলিস্তান আসতাম। গুলিস্তান থেকে আবার বাসে যাত্রাবাড়ী। সদরঘাট থেকে গুলিস্তান চারআনা ভাড়া। ঢাকা শহরে তখন গুলিস্তানই ছিল একমাত্র জমজমাট এলাকা। গুলিস্তানের চোর বাটপারের কাহিনী কিংবদন্তী তুল্য ছিল।
সেরকমই এক চোরের কাছ থেকে জীবনে আমি প্রথম শিরোনামে উল্লিখিত এই পাঠটি শিখি।
একদিন গুলিস্তান নেমে হাঁটতে হাঁটতে জিপিওর সামনে আসি। এক লোক বড়সড় চৌকোনা এক বাক্সে করে নানা রকম জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছে। বসেছে না বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে বলাই ভালো হবে। কোমর সমান উঁচু কার্টুনের উপর চৌকোনা বাক্সটি রাখা।
কলম, খাম, নোটবুক, কালির দোয়াত এসবের পসরা। আমার কয়েকটি কলম কেনা প্রয়োজন। আমি বাক্সের কাছে গিয়ে কলম দেখতে থাকি। অনেক লোকের ভীড় বাক্সের চারদিকে। গুলিস্তান এমন একটি আজব জায়গা ছিল সে সময়, কেউ একজন ডুগডুগি বাজিয়ে একটু হাঁক দিলেই লোকের ভীড় জমে যেত।
বাক্সটিকে ঘিরে একটি জটলার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ কৌতুহল বশতঃ দেখতে এসে জটলাটি আরও বাড়াচ্ছে। আমার ডানদিকে এক লোক কয়েকটি কলম হাতের মুঠোয় নিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে। আমি লোকটির দিকে সরাসরি না তাকালেও বুঝতে পারছিলাম তার উদ্দেশ্য ভালো নয়। কলম বিক্রেতা আরেক ক্রেতার সাথে অন্য জিনিসের দরদামে ব্যস্ত।
এই সুযোগে লোকটি কলমগুলোকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে আস্তে করে সটকে পড়ার ধান্ধায় আছে। আমি লোকটির দিকে তাকাই। লোকটি আস্তে করে কলমগুলো রেখে আমার পাশ থেকে সরে যায়। আমি আবারও কলম বাছাইয়ে মনোনিবেশ করি।
একটু ঘুরে লোকটি অন্যদিকে যায়।
আমার খুব কৌতুহল হয় লোকটি কি করে তা দেখার জন্য। আমি সময় কাটানোর ছলে কলম দেখতে থাকি। লোকটি বাক্সের আরেক পাশ থেকে কলম বাছাইয়ের নামে আবারও কয়েকটি কলম হাতে নেয়। বিক্রেতা তখন অন্য আরেকজন ক্রেতার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। লোকটি কলমগুলোকে মুঠোবন্দী করে যখনই সটকে পড়ার চিন্তা করছে আবারও তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়।
আস্তে করে সে কলমগুলো বাক্সে রেখে দেয়।
আমি এক হালি কলম নিয়ে দাম মিটিয়ে দেই। লোকটির আচরণে আমার মধ্যে যে কৌতুহল জন্ম নিয়েছে সেজন্য আমি ডায়েরী দেখার ছলে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। ডায়েরী, নোটবুক এগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকি আর চোরা চোখে লোকটির উপর নজর রাখি। লোকটি আবারও কিছুটা ঘুরে বাক্সের আরেকদিকে গিয়ে অবস্থান নেয়।
বাক্সের চারিদিকেই কলম সাজানো। বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন আকারের কলম। মাঝখানে খাম, ডায়েরী, নোটবুক, কালির দোয়াত। বাক্সের চারিদিকেই কলম সাজানো থাকায় লোকটির কলম বাছাই করতে সমস্যা হয় না। আবারও কতগুলো কলম নিয়ে সে ভেগে পড়ার উপক্রম করছে।
অনেক লোকের ভীড়ে কেউ লোকটিকে খেয়াল করছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লোকটির সাথে আবারও আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। এবার সে কলমগুলো জায়গামত রেখে দিয়ে ঘুরে আমার কাছে আসে।
তারপর আমার কানের কাছে মুখটা এনে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করেই 'দুনিয়া আনন্দময়, যার মনে যা লয়'- বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
২. একদিন কোনো এক কাজে আমি এক উকিলের কাছে গিয়েছি।
পুরান ঢাকার এই আদালত পাড়াকে সবাই 'কোর্ট-কাচারী' নামেই চিনে। এই কোর্ট কাচারীর পেছনেই উকিলের চেম্বার। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি খ্যাত পুরান ঢাকার এই আদালত পাড়া আরেক আজব জায়গা। আসামী, ফরিয়াদী, স্বাক্ষী, ভবঘুরে, কালো কোট পড়া উকিল, মোক্তার, টাইপরাইটার, দলিল বিক্রেতা, পুলিশ এবং ভ্রাম্যমাণ হকারের হৈ চৈ হট্টগোলে জায়গাটি নরক গুলজারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অনেক খুঁজে কোর্টের পেছনে এক পরিত্যাক্ত বিল্ডিংয়ের প্রায়ান্ধকার এক কক্ষে উকিলের চেম্বার খুঁজে পেলাম।
কক্ষে একটি কাঠের আলমারীতে আইনের কিছু বই গাদাগাদি করে রাখা। কক্ষের অবশিষ্ট জায়গাটুকুতে একটি ছোট্ট টেবিল আর চারটি চেয়ার রাখা। টেবিলের একপাশে উকিল সাহেব বসেন। আমি কক্ষে ঢুকতেই উকিল সাহেবের মুখোমুখি বসা একজন চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। আমি খালি চেয়ারটিতে বসলাম।
বাকি তিনটি চেয়ারে তিনজন লোক বসে আছেন। উকিল সাহেবের হাতের বামপাশে বসা একটি সতের আঠার বছরের ছেলের সাথে উকিল সাহেব কথা বলছেন।
ছেলেটির দিকে তিনি কয়েকটি স্ট্যাম্প এগিয়ে দিলেন স্বাক্ষর করার জন্য। ছেলেটি কোনোরকমে নাম সই করতে পারে বোঝা গেল। অনেক কসরৎ করে স্ট্যাম্পের নির্দিষ্ট স্থানে সে বাঁকাত্যাড়া করে তার নামটি লিখল।
স্বাক্ষর নিতে নিতে উকিল সাহেব ছেলেটিকে বলছেন, 'ব্যাটা গাঞ্জা বেচতে গিয়া ধরা খাইয়া মামলা খাইছ। মামলা চালাইবার পয়সাও তো দিবার পারবানা। এরচাইতে ভালো ছিল হেরোইন বেইচ্যা ধরা খাইতা। হেরোইন বেইচ্যা নিজের জীবনটারেও রঙিন করতে পারতা আর লগে আমিও দুইটা পয়সা পাইতাম। ' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।