আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিবন্ধীদের জন্য মা-বাবার দরদ

ন্যাকামো ভীষণ অপছন্দ, যদিও বাধ্য হয়ে সহ্য করি! সন্তানের জন্য মা-বাবার টান তো নতুন কিছু না। কিন্তু সে সন্তান যখন জন্মগতভাবে দুরারোগ্য কোনো ত্রুটিযুক্ত থাকে - যাদের জন্য সারা জীবন শুধু করেই যেতে হয় - পাওয়ার কিছু নেই - কোনো আশা নেই- তাদের জন্য মা-বাবার যে কি পরিমাণ বিশেষ দরদ থাকে - আমার দেখা তার দু’টি চিত্র তুলে ধরছি: ১. চৌদ্দ বছরের ছেলে অরুণ। মাস খানেক আগে প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে আমি রিসিভ করি আইসিইউতে। সে আর শ্বাস নিতে পারছিল না। হাত-পাগুলো নীল।

মাস্ক দিয়ে অক্সিজেন দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছিল না। এমন সুন্দর ও সুঠাম এক কিশোরের আজ শ্বাস নেয়ার শক্তিই প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। অগত্যা তাকে ইনটিউবেট (শ্বাসনালীতে টিউব) করে ভেন্টিলেটরে (কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র) দিলাম। যাহোক, পরক্ষণে মা-বাবার কাছ থেকে জানা গেলো সে ডাউন্স সিন্ড্রোমের রোগী। আর তার বর্তমান সমস্যার ধরন বিবেচনা করে তার মাইয়েস্থেনিয়া গ্র্যাভিস (মাংসপেশির শক্তিহীনতা) হয়েছে বলে গণ্য করা হলো।

একবার ভাবুন, জন্মগত প্রায় অমোচনীয় একটি রোগের সাথে আবার আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী রোগের আক্রমণ! ভয়ঙ্কর ব্যাপার! এদের সিক্রেশন খুব বেশি হওয়ায় কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রে থাকাকালীন অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। তবুও বিশেষ যত্ন, নির্দিষ্ট ওষুধ (গামা-গ্লোবিউলিন, বেশ এক্সপেন্সিভ), ডাক্তার-নার্সদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পরিচর্যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমতে প্রায় ৩ সপ্তাহ পর তাকে ভেন্টিলেটর থেকে মুক্ত করা গেলো। এখন সে মোটামুটি স্বাভাবিক, তবে ডাউন্সের রোগী তো! তাকে নিয়ে মা-বাবার যে উৎকণ্ঠা আর তৎপরতা আমি দেখেছি - তা সত্যিই অনেক চিন্তার উদ্রেক করে! গত ১৪ টি বছর মা তাকে নিজে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন, অনেক সময়ই তার বিছানাও পরিষ্কার করতে হয়েছে, রাখতে হয়েছে চোখে চোখে। আইসিইউতে ভর্তি হবার প্রথম দিকে আমি তার অবস্থা যখন তাদেরকে বর্ণনা করি - সে কি কান্না! এরপরও সকাল-বিকাল-রাতে-মধ্যরাতে-শেষরাতে-ভোরে যখনই আমি গিয়েছি - মাকে - কখনো কখনো বাবাকে বাইরে বসে থাকতে দেখেছি। এতটুকু হতাশা বা অনীহা তাদের মধ্যে কখনো লক্ষ্য করিনি।

মায়ের মুখটি ঠিক যেন শুকিয়ে যাওয়া একটি বাসি বেলী ফুলের তোড়া! বারবার মায়ের প্রশ্ন - ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলের অবস্থা কেমন? কবে ভালো হবে? অথচ তারা খুব ভালো করেই জানেন যে, সে এই রোগ থেকে ভালো হলেও তার আসল রোগ থেকে তো মুক্তি নেই। কোনদিনও স্বাভাবিক কোনো বৈষয়িক কাজে আসবে না সে। আমি ডরমিটরিতে ফিরে একাকী প্রায়ই ভাবি - মানুষের জীবনে একজন মায়ের যে কি অবস্থান - তা কি আমি ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি? সবাই কি পেরেছে? ক’জন পারে? ২. আরেকটি ৫ মাসের বাবু এসেছে আইসিইউতে। জন্মগতভাবে তার হার্টে রয়েছে এক মহা-গোলযোগ! ট্র্যান্সপজিশন অব গ্রেইট ভেসেল্‌স এবং ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট। অর্থাৎ হৃদযন্ত্র থেকে বড় রক্তনালীগুলো উল্টোভাবে বের হয়েছে এবং দু’চেম্বারের মাঝখানে রয়েছে একটি বড় ছিদ্র।

অবশ্য এই ভিএসডি’র জন্যই সে এখনো বেঁচে আছে। তবে এর কারণে তার আবার হয়েছে পালমোনারী হাইপারটেনশন। বাচ্চাটির অবস্থা খুবই খারাপ। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট! তাকে ওপেন-হার্ট ডাবল-সুইচ অপারেশন করা হবে। বেশ জটিল এটি।

তবে ফলাফল খারাপ না। কিন্তু প্রবল ঝুঁকি তো রয়েছেই। এই মা’কেও দেখলাম কিভাবে তিনি সারাদিন-সারারাত শুয়ে থাকা বেবীটিকেও যেন তাঁর বুকে তুলে আগলে রেখেছেন। তাঁর আরেকটি সন্তান যেন কাছেই আসার সুযোগ পাচ্ছে না। ফরমুলাটি যেন এরকম: যে যত বেশি নাজুক - তার প্রতি দরদ তত বেশি! তাই ভাবি, মা’দেরকে আল্লাহ কি দিয়ে বানিয়েছেন! একদম ছোটবেলার কথা তো আর আমাদের মনে নেই।

কি কষ্টই না করতে হয়েছে মা’কে? কিন্তু তার প্রতিদানে আমরা মা-বাবার আনুগত্য, সেবা-যত্নে, পরিচর্যায় কতটুকু সচেতন ও বাস্তবে তৎপর? মহান আল্লাহ বলেন: আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়াতে লেগেছে দু’বছর। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে তোমাদের।

[সূরা লোকমান: ১৪]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.