সকাল আর আসেনা গোলাপ হয়ে ফোটেনা কিশোরীর হাতে আমাদের অরণ্য আমাদের অনেক সাধনার ফসল বলেই কিনা- খুব আহলাদী হয়েছে। তার বাবা তাকে আহলাদী করে তোলার পেছনে কিছুটা বেশি দায়ী,একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। কিছুদিন আগে অরণ্য'কে তার বাবা একটা তোতা পাখি এনে দিল। সে সারা দিন এই পাখির কাছেই পড়ে থাকে। কত রকম কথা বলে।
আমি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করি অরণ্যকে পাখি কিনে দেবার কারণ কি?এখন সে শুধু পাখি নিয়েই থাকে। ঠিকমত খেতেও চায় না।
অরণ্য'র বাবার জবাবটা ঠিক এরকম-
'ছেলেবেলায় আমিও পাখি দেখে যারপর নাই খুশি হতাম। আমার খুব ইচ্ছে করতো পাখিদের ডেকে কাছে আনতে। একটু ছুঁয়ে আদর করতে।
এক মেলায় বাবার সাথে গিয়ে দেখি একজন খাঁচা ভর্তি পাখি নিয়ে বসে আছে। বাবাকে পাখি কিনে দেবার বায়না তুলতেই বাবা দাঁত খিঁচে একটা ধমক দিলেন। আমি কাঁদতে শুরু করি। এমন কি মেলাতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাই। তবুও বাবা আমাকে একটা পাখি কিনে দেন নি।
আরেকটু বড় হলে একদিন দেখি একটা সাদা বক বসে আছে আমাদের পুকুরের এক কোণে। আমি আস্তে আস্তে পেছনে গিয়ে একটা মাটির ঢেলা দিয়ে ঢিল ছুড়ি । পাখিটা মাটিতে পড়ে কয়েকবার উলটপালট খেল। যেই আমি ধরব সেই পাখিটা উড়াল দিয়ে চলে গেল। আমি খুব আপসোস করতে থাকি ।
সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। আবার পাখিটাকে আঘাত করে নিজেও কষ্ট পাচ্ছিলাম। একটা অন্যায় বোধ হচ্ছিল আমার।
তাই ভাবলাম শিশুদের পাখির প্রতি এত আগ্রহ । আমার ছেলেও হয়ত অনেক খুশি হবে একটা পাখি কিনে দিলে।
সে এ পাখির স্মৃতি নিয়ে বড় হবে। হয়ত কোন একদিন বলবে যে তার বাবা তাকে খুশি করার জন্য পাখি কিনে দিয়েছিলো। '
একবার দেখি পাখি নিয়ে ছেলেতে বাবাতে কথা হচ্ছে।
অরণ্য বলছে- বাবা -বাবা পাখিটা অনেক সুন্দর, না?
-হ্যাঁ বাবা পাখিটা সুন্দর বলেই তো তোমার জন্য এনেছি!
-বাবা পাখি আকাশে উড়তে পারে?
-হ্যাঁ বাবা পাখি আকাশে উড়তে পারে।
-আমাদের পাখিটা ও আকাশে উড়তে পারবে?
-হ্যাঁ বাবা খুব পারবে!
-আচ্ছা পাখিটাকে ছেড়ে দিলে কি উড়বে বাবা?
-হ্যাঁ বাবা উড়ে চলে যাবে।
আর আসবে না।
তখন অরণ্য পাখিটা হারাবার ভয়ে আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলে -ছেড়ে দিলে আমার কাছে আবার আসবে না বাবা?
না বাবা আর আসবে না । সে আকাশে চলে যাবে।
অরণ্য আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার বাবা ছেলের মনোজগৎ নিয়ে ভাবে। শিশুরা কতকিছুই না চিন্তা করে!
আবার অরণ্য কিছু সময় নিয়ে থেমে থেমে বলে-
-বাবা পাখিটা এত সবুজ কেনো?
তার বাবা বলে -আমি তো ঠিক জানিনা বাবা। তবে পাখিরা -গাছের সবুজে থাকেতো হয়ত তাই পাখিটা সবুজ। বৃক্ষের সবুজ থেকে পাখিরা সবুজ ধার নেয়।
তার বাবা তোতাটার জন্য কামরাঙ্গা আর যা যা তোতা খায় তাই এনে দেয়।
বাপে ছেলে মিলে খাওয়ায়। অরণ্য যখনই হাত বাড়িয়ে খাবার এগিয়ে দেয় তখন তার বাবা তাকে সাবধান করে বলে বাবা সাবধানে তোতার ঠোঁট খুব ধারালো। কামড় দিলে কেটে যাবে। অরণ্য তার কাঁপো কাঁপো হাত সামনে এগিয়ে দেয়। খাবার দিয়ে খুব দ্রুত হাত সরিয়ে আনে।
তারপর সে অনাবিল আনন্দে খিলখিল করে। রাজ্য জয়ের আনন্দ।
এদিকে আমার দুঃশ্চিন্তাটা বাড়তে থাকে । সে যদি পাখির প্রতি এভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে পরে ঝামেলায় পড়তে হবে। ব্যাপারটা অরণ্য'র বাবাকে বুঝিয়ে বললে সেও কিছিটা বিচলিত বোধ করে।
বলে -ভেবে দেখি। কিভাবে অরণ্যকে এ আসক্তি থেকে মুক্ত করা যায়।
একবিকেলে অরণ্য তার বাবাকে বলছে -
বাবা আমি পাখি হলাম না কেনো?
পাখি হলে কি করতে বাবা?
পাখি হলে আকাশে উড়তে পারতাম বাবা!তখন অনেক মজা হতো তাইনা?
অরণ্য'র বাবা এ প্রশ্নে কিছুটা থমকে যায়।
আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি -কি হচ্ছে অরণ্য বাবাকে কি বলছো?
'মা আমি পাখি হলাম না কেনো?'
-তুমি পাখি হলে আমি কাকে নিয়ে ঘুমাতাম বাবা?মা; কে ছাড়া তুমি পারতে থাকতে?
সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে।
আবার একটু পরে তার বাবাকে বলে -
'আচ্ছা বাবা পাখিদের কি বাবা মা থাকে?'
অরণ্য'র বাবা যেন একটা সুযোগ পেয়ে গেল।
'হ্যাঁ বাবা পাখিদের বাবা মা থাকে। এ পাখিটার ও নিশ্চয় বাবা- মা আছে। '
মা'কে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, না বাবা?
'হ্যাঁ কষ্টতো হচ্ছেই মনে হয়। তুমি কি পাখিটা ছেড়ে দিতে চাও?'
ছেড়ে দিলে তো চলে যাবে আর আসবে না তখন?
তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবে। হবে না?
কোথায় দেখে আসব বাবা?
আমরা পাখিটা স্কুল বাড়ির পাশে যে বটবৃক্ষটা আছে না ?ওখানে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসব।
ওখানে আরো অনেক তোতা পাখি থাকে এ পাখিটা ওখানে ওর বাবা মার কাছে চলে যাবে। ঠিক আছে বাবা?
অরণ্য আস্বস্ত হয়।
ঠিক আছে!
কিন্ত্ত একটা দ্বন্ধ তার চোখে মুখে। পাখির কষ্ট তাকে পোড়ায়। পাখিকে হারানোর কষ্ট ও তাকে পোড়ায়।
এক বিকেলে আমি ,অরণ্য ,আর তার বাবা খাঁচাটা নিয়ে পরিকল্পনা মত বের হই।
এই বটবৃক্ষটা এলাকার জন্য অনেক প্রসিদ্ধ। বিশাল জায়গা নিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে আছে। অনেক টিয়ে পাখির আবাস এটা। মাঠ থেকে কৃষকেরা এসে এখানে বাতাস খায়।
বিশ্রাম নেয়। দিন-রাত বটপাতার তালি বাজে।
অরণ্য'র বাবা খাঁচাটা ধীরে ধীরে খুলে।
-বাবা এবার পাখিটা ছেড়ে দাও?
-না বাবা তুমি ছাড় আমাকে কামড় দেবে।
অরণ্য'র বাবা পাকিটাকে যত্ন করে ধরে ছেড়ে দেয়।
পাখিটা একটু উড়ে গিয়ে আবার খাঁচাটার উপর এসে বসে। আরেকবার উড়ে এসে অরণ্যের মাথায় বসে। অরণ্য মহাখুশি। শেষবার উড়াল দিয়ে বটবৃক্ষটার ডালে বসে। অরণ্য'র চোখে তখন অশ্রূ আর আনন্দের ঝিলিক।
অরণ্যও হাত দুদিকে করে পাখির মত উড়তে চায়। পাখিকে উড়তে দেখে অরণ্যের মনটাও কেমন পাখির মত হয়ে আসে। সে উড়তে চায়। সে আকাশ ছুঁতে চায়।
বলে- বাবা পাখিটা চলে গেল না?
হ্যাঁ বাবা চলে গেল।
তোমার কষ্ট হচ্ছে বাবা?
হ্যাঁ বাবা।
তার বাবা তাকে কনভিন্স করে।
বাবা তুমি কি পাখি ভালবাসো?
হ্যাঁ বাবা।
তাহলে পৃথিবীর সবগুলো পাখিই তোমার। ঠিকাছে?
কিভাবে আমার হবে বাবা?
যারা পাখিদের ভালবাসে পাখিরা শুধু তাদেরই হয় বাবা বুঝলে?
অরণ্য কথাটার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে।
কোথায় যেন বুঝেও ঠিক বুঝে না।
অরণ্য'র বাবা বলে চলে -
বাবা মন খারাপ না করো না । চলো আমরা পাখিদের ডাক শুনি।
শুনতে পাচ্ছো ?পাখিরা কেমন আনন্দ করছে?
-পাখিটি তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে গেল না বাবা?
'হ্যাঁ বাবা'।
-তারা খুব আনন্দ করছে না বাবা?
'হ্যাঁ বাবা'।
অরণ্য'র চোখে মুখে আনন্দ ঝলমল করে । সে যেন সে আনন্দটা খুব স্পর্শ করতে পারছে।
প্রথম প্রথম অরণ্য পাখিটার কথা মনে হলেই মন খারাপ করে থাকতো।
তারপর থেকে প্রায়ই আমি তাকে বট গাছটার কাছে নিয়ে আসি। পাখিদের কলতান শুনাই।
ধীরে ধীরে অরণ্য পাখিকষ্ট ভুলে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।