তখন মধ্য দুপুর। বনের ভিতর প্রবেশ করতেই ঝিঝি পোকার শব্দই জানান
দিল শহরের কোলাহল থেকে অনেক অনেক দূরে চলে এসেছি। সিলেটের
মৌলভি বাজার জেলা- কমলগঞ্জ এর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
এখানে দেখা মেলে বিরল প্রজাতির পশু-পাখি আর নানা গাছ-গাছালি,ঝরণা
এবং পাখি। আজ যেন তা হারাতে বসেছে।
বনের ভিতর হাটছি অসস্তির শুরু সেখান থেকেই কিন্তু কেন? নিজেকে প্রশ্ন
করি। জীব বৈচিত্র ভরপুর লাউয়াছড়া বনের ভিতর এখন পর্যন্ত একটাও প্রাণীতো দূরের কথা পাখি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। অথচ পায়ে হাটার পথে
নিসর্গ প্রকল্পের বিভিন্ন সাইন বোর্ডে প্রাণীকুলের ছবি সহ নানা বর্ণনা করা আছে। কোন পথে গেলে কি কি দেখতে পাওয়া যাবে।
এই বনেরই বাসিন্দা সাজু মারসিয়াং এর সাথে চলতে চলতে কথা হয়।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে শেভরনের ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে বনটা যেন কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কথা বলতে বলতে জানালেন সাজু মারসিয়াং। আগে কুলু বানর, উল্লুক,মায়া হরিণ,বন্য শুকর, কাঠ ঠোকরা, মেঝ বাঘ, বন মুরগী হামেসাই দেখা যেতো- কিন্তু এখন এদের টিকিটাও পর্যন্ত দেখা যায় না। বেশ কিছু দিন আগে প্রায় ১৫/২০ টা
উল্লুক কে দেখা গেছে একটা চাপালিশ গাছের উপর একত্রে ডাকতে। ত্রিমাত্রিক ভূকম্পনের জরিপের ফলে-ভূমির কেঁপে উঠা - বোমার শব্দে বন্য প্রাণীগুলো অনেকটা ভীত হয়ে পড়েছে।
মানুষ দেখলেই দূরে সরে যায়।
গত ৭মে/০৮ একটি বিরল প্রজাতির চশমা বানর বোমার শব্দে আতংকিত হয়ে ইলেকট্রীক তারের সঙ্গে জড়িয়ে মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালেন
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বানরটি বাঁচার জন্য ছটফট করছিল। বানরের মৃত্যু এই বনে একেবারেই বিরল ঘটনা। বনের ভিতর খাসিয়া পুঞ্জীর পান জুমে অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় দুই শতাধিক পান গাছ।
জায়গা গুলো ঘুরে ফিরে দেখি আর নিজের মনেই প্রশ্ন করি এ সবের জন্য দায়ী কে বা কারা?
কথা বলতে বলতে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায় শেভরনের বিস্ফোরক দলের কয়েক জন। পরনে লাল/সবুজ রঙের জামা সঙ্গে বিস্ফোরক সরঞ্জাম। বনের ভিতর কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। বেশ কিছু ছবি তুলি। বেশ ভিত দেখায় ওদেরকে।
আমাদেরকে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
সাজুকে প্রশ্ন করি কয়েকটা বানর ছাড়া একটা প্রাণীও চোখে পড়লো না।
এর কারণ কি? এর উওরে সাজু বলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না- সারা বন জুড়ে কিভাবে বিস্ফরকের লাল রঙের তার ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। বনের প্রাণী এমনিতেই অনেক সচেতন। ঐ তার গুলোকে মনে করেছে একটা ফাঁদ।
তাই ওরা বন ছাড়া হয়েছে। কিছু কিছু প্রাণী পালাতে গিয়ে লোকালয়ে এসে ধরা পড়ছে।
পরের দিন- বনের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইন দিয়ে হাঁটছি- হঠাৎ করেই ডাক শুনতে পাওয়া গেল। আমি সেই ডাক অনুসরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। অনেক অনেক ভিতর থেকে সেই ডাক আসছে।
দ্ই পাশে ঘন বন মাঝ খান দিয়ে বয়ে গেছে রেল লাইন-শব্দহীন গাছ গুলো দাড়িয়ে আছে- একটা চাপালিশ এর উচু ডালে দেখা গেল এক জোড়া উল্লক জুগোলকে ডাকছে চিৎকার করে। আমি বেশ কিছু ছবি তুল্লাম কিন্তু কি করে যেন টের পেয়ে গেল ওরা। চোখের নিমিষেই দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেল। সাজু বল্লো এখন আর ওদের খুজে পাওয়া যাবে না কারণ ওরা ভয় পেয়েছে- মানুষকে ওদের এখন বড় ভয়।
লাউয়া ছড়া অরণ্যকে পেছনে ফেলে হাটছি- আর মনে মনে ভাবছি কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়েই না ফিরছি। সেই চশমা বানরের করুণ মৃত্যু-তার স্বরে উল্লক জুগোলের অবিরাম ডেকে উঠা। শেভরনের ত্রিমাত্রিক ভূকম্পনের
সত্তর ফিট গভীরে ক্ষত-বিক্ষত বনের হৃদপিন্ড। জুমে অগ্নিকান্ড-সব কিছু যেন নিরবে দাড়িয়ে। অরণ্যকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি আর একবার পেছনে ফিরে তাকাই-বুঝতে পারি- অরণ্য যেন নিরবে দাড়িয়ে কাঁদছে !
-মেঘমনির
অপ্রকাশিত একটি লেখা
সৃষ্টিকাল: মে/২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।