বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ বলা হয় জহির রায়হানকে। জহির রায়হানের চলচ্চিত্রগুলো দেখে দু:খ অনুভব করি। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলা চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্ত ভিত গড়ে নিতো নি:সন্দেহে।
জহির রায়হানের পর তারেক মাসুদ, সবশেষে চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদও। বাংলা সংস্কৃতিতে আমরা কী হারিয়েছি, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? হয়তো দেখেছি, হয়তো না।
কিন্তু আমরা কার কাছ থেকে আর আশা করব? কে আছে আর?
জহির রায়হান যখন ছিলেন তখন তারেক আর হুমায়ূনরা ছিলেন না। অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো কেউ না কেউ আসবে। কিন্তু তা দেখার জন্য জহির, তারেক কিংবা হুমায়ূন রইলেন না। আমরাও হয়তো থাকবো না। আমরা বোধহয় বঞ্চিতই হলাম।
আমরা মুগ্ধ হয়ে হলিউড, বলিউড, কোরিয়ান, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান... মুভি দেখি। গবেষণা করি, বিশ্লেষণ করি। আমাদের দেশের কোন মুভি নিয়ে তা করতে পারি না। কারণ এসব মুভি নিয়ে বিশ্লেষণ করার কিছু নেই। প্রতিটা দর্শকই এক একজন পরিচালক।
সিনেমা হলে গিয়ে বলে দেওয়া যায় কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটবে, পরিণতি কি হবে। তারপরও মানুষ সময় কাটাতে আর স্থূল শরীরসর্বস্ব খেমটা নাচ দেখতে অসহায় দর্শকরা সিনেমা হলে যায়।
হাল আমলে কিছু পরিচালক বাংলা চলচ্চিত্রের ত্রাণকর্তা হিসেবে এসেছিলেন, দু-একজন চেষ্টা করেও যাচ্ছেন। থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার, গেরিলা, মেহেরজান.... আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে। তথাকথিত 'বিকল্পধারা'র ছবি নিয়ে তারা দর্শক হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই কীর্তি শত সহস্র বছর টিকে থাকবে, টিকে থাকবে যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে।
বাংলা চলচ্চিত্রের তিন দিকপাল, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে 'রানওয়ে' মুভি সম্পর্কে কিছু শেয়ার করছি।
-------------------------------------------------------------------
-------------------------------------------------------------------
হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের উত্তরে টিনের ছাপড়া ঘরে রহিমা দুই ছেলে-মেয়ে রুহুল, ফাতেমা আর শ্বশুড়কে নিয়ে বসবাস করে। ক্ষুদ্রঋণ সমিতি থেকে আনা সুদের ঋণ দিয়ে কেনা গাভী দেখাশোনা করে রহিমা। ছেলে রুহুল বেকার, মেয়ে ফাতেমা গার্মেন্টসে চাকুরি করে চার সদস্যের পরিবার চালায়।
যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানুষ ফিরে আসছে বাংলাদেশে তখন ভিটেমাটি বিক্রি করে রুহুলের বাবা গেছে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সন্ধানে। দাখিল শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেও শহরে আসায় আর পড়াশুনা আগায়নি।
রুহুল মামা'র সাইবার ক্যাফেতে ইন্টারনেট চালানো শিখে, যদি কোন চাকরি পাওয়া যায় সেই আশায়। সেই ক্যাফেতেই পরিচয় হয় আরিফের সাথে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব।
চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করতে গিয়ে ইসলাম কায়েম করতে রুহুলকে উদ্ধুদ্ধ করে আরিফ। নিয়ে যায় আফগানিস্তান ফেরত 'উর্দু ভাই'র কাছে। এয়ারপোর্টে চাকুরি দেয়ার টোপ দিয়ে সহজেই রুহুলকে বশ করা সম্ভব হয়। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জিহাদের আহ্বান জানায় উর্দু ভাই। রুহুল আল্লাহ'র পথে ঘর ছাড়ে, হতভাগা মা, বোন আর দাদার চেয়ে উর্দু ভাইয়ের জিহাদী চেতনাই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়।
রাজনৈতিক মতবিরোধে আরিফের সাথে ডিভোর্সের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায় তার একসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা স্ত্রী।
ময়মনসিংহ শহরের চারটা সিনেমা হলে যেদিন বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল সেদিন আমি ছিলাম ময়মনসিংহের পথে। আমার সাথে আরো দুই বন্ধু। উদ্দেশ্য ছিল ময়মনসিংহ গিয়ে সিনেমা দেখা। কিন্তু কারণবশত গৌরীপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আর ময়মনসিংহ যাওয়া হয়নি, গৌরীপুরেও সিনেমা দেখা হয়নি।
স্টেশনের এক দোকানে বসে টিভিতে দেখেছিলাম সালমান শাহ্'র 'প্রিয়জন', ঈদের পরের দিন সম্ভবত। পরে শুনেছি সিনেমা হলে বিস্ফোরণের খবর। কত বড় বাচাই না বেচেছিলাম সেদিন!
যাক, উর্দু ভাই'র মুখোশ উন্মোচন করতে শতভাগ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তারেক মাসুদ। ধরা পড়ার ভয়ে সবাই যখন বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লীদের সাথে মিশে যায়, তখন ইজতেমায় বয়ান হয় জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। বিধর্মীদের পাতা ফাদে পা না দিতে সতর্ক করে দেয়া হয়।
সব শুনে রুহুল। নির্জন চরে জিহাদী প্রশিক্ষণে গিয়ে উর্দু ভাই তার সাগরেদকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত চলে যায়, পেছনে দৌড়ায় সবাই। ধরা পড়ে উর্দু ভাইয়ের স্বার্থপরতা। এরপর দেখা যায়, ইসলাম কায়েম না ছাই, এক রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় এতদিন এসব করেছে তারা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতার সাথে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায় বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে।
বিচারকদের উপর হামলা না করতে অনুরোধ করলেও উর্দু ভাই হামলার পরিকল্পনা করে। জিহাদের পথে এগিয়ে যায় আরিফ সহ তিন জন। সাইকেল বোমা ফাটিয়ে আহত অবস্থায় ধরা পড়ে আরিফ। সাগরেদদের অসহায় অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায় উর্দু ভাই। সবাই চলে গেলেও রাতে ঝুকি নিয়ে আস্তানায় থাকে রুহুল।
বোঝাপড়া করে নিজের সাথে।
পরিবারের সদস্যদের ভালো মন্দের কথা চিন্তা না করে নিজের বেহেশত লাভের আশায় আত্মঘাতী হামলা করে মরে যাওয়ার পক্ষে নয় সে। বেচে থেকে অন্যায়ের সাথে লড়াই করা উত্তম। লড়াই হয় তার মনের সাথে। যে তার ভালোবাসার মানুষকে নেশাখোরের হাত থেকে বাচাতে পারে না সে কিভাবে সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করবে?
তারেক মাসুদ ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়েছেন।
ছোট বেলার চিন্তা চেতনা উঠে এসেছে সেলুলয়েডের ফিতায়। মাটির ময়না ছবিতেও এর ছাপ পাওয়া গেছে। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে গল্পটি এগিয়ে চলে। যে বিচক্ষণার সাথে গল্পটিকে নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে তাতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গন সমৃদ্ধই হয়েছে। যার প্রমাণ স্বরূপ রানওয়ে পেয়েছে বহু পুরস্কার, কোটি মানুষের ভালোবাসা।
তারেক মাসুদরা বেচে থাকলে একটা সময় তাদের ছবি অস্কারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতো না, পুরস্কারও ছিনিয়ে আনতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। ততদিন সময় পেলেন না জহির, তারেক আর হুমায়ূন।
রানওয়ে ডিভিডিতে বেরিয়েছে। যদি সম্ভব হয় কিনে দেখবেন।
ডাউনলোড লিঙ্কও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমি এই মুভিটির জন্য তা সমর্থন করছি না। আশা করি মুভিটি সবাই দেখবেন।
আইএমডিবি'তে রানওয়ে
রানওয়ে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট
রানওয়ে ফেসবুক পেজ তারেক মাসুদ স্মৃতি ট্রাস্ট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।