আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নের হাত ও একফোঁটা জল!!! অসুস্থ বাবার জন্য দোয়া চাই

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে একবার বাবার দাঁত ব্যাথা হল। যেমন তেমন ব্যাথা না, ভয়াবহ আকারের ব্যাথা। ব্যাথার চোঁটে তাঁর দাঁতের মাড়ি ফুলে গেছে। ফোলা মাড়ি বাইরে থেকেতাকালেও বোঝা যাচ্ছে। ডাক্তার দেখাতেই হবে।

উপায় নেই। বাবা আমাকে নিয়ে বিরামপুর(দিনাজপুর)গেলেন। উদ্দ্যেশ্য ডাক্তার দেখানো। ডাক্তারের নাম ডাঃ গোলাম হাকিম। গোলাম হাকিমের চেম্বারের নাম ‘হাকিমী দন্ত চিকিৎসালয়’।

ডাক্তার সাহেব বাবার দাঁত নেড়ে চেড়ে দেখলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘দাতের অবস্থা ভালো না। দাঁতগুলো ফেলে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন কি করবেন। ’ বাবা বদমেজাজী টাইপের লোক।

একরোখাও বলা যেতে পারে। ‘সিদ্ধান্ত নেন” কথাটা তার ভালো লাগেনি। চেঁচামেঁচি শুরু করে দিলেন ডাক্তারের সামনে। বললেন, ‘সিদ্ধান্ত নিজেই নিব তো তোর কাছে কেন আসলাম? যতটা দাঁত ফেলা লাগে ফেলে দে। কোন কথা হবে না।

’ ডাক্তার সাহেব আর কথা বলেন না। বাবাকে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। চাঁদ-তারা অঙ্কিত সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা ছোট্ট রুম। আমি রুমের বাইরে বসে আছি। কিছুক্ষন পরপর সেখান থেকে আকাশ ফাঁটা শব্দ কেঁপে কেঁপে আসছিল।

আমিও শব্দের সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। তখনকার সময় বিরামপুরের হাকিমী দন্ত চিকিৎসালয়ে লোকাল এনাসথেসিয়া প্রচলিত ছিল না। বাবাকে অনেক কষ্টে বাসায় আনলাম। বাড়ীতে এসে সবাই বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাত থেকে তার প্রচন্ড জ্বর শুরু হলো।

জ্বরের মধ্যে তিনি ভুলভাল বঁকতে শুরু করলেন। কোন বোন তার কথা শোনেনি, কোন ভাই তার অমতে বিয়ে করেছে এইসব নিয়ে চলল তার একটানা প্রলাপ। রাত গভীর হতে শুরু করল। বাবার জ্বর বেড়েই চলছে। প্যারাসিটামল-কুইনাইন কাজ করছে না।

দাদা-দাদীরা ছুটে আসলেন। দাদা বাবর হোসাইন সরকার বাবার পাশে বসে কাঁদতে লাগলেন। বাচ্চা ছেলেরা যে ভাবে কাঁদে সেইভাবে। ‘ওরে আমার বড়বাপ, তুই কোথায় যাচ্ছিস? আমারে নিয়ে যা। আমি একা কি করে থাকব?’ উনি কিছুক্ষন কাঁদছেন আর একবার করে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন।

শরবত তৈরী করা হয়েছে পানির মধ্যে শুধু গুড় দিয়ে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদার কান্নার কথাগুলো শুনছিলাম। কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা কাঁদবেন না। আপনি কাঁদলে আমরা ভরসা পাব কোথায়?’ দাদা আমাকে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন। আমার গালে দাগ বসেগেল।

তিনি উচ্চস্বরে চেঁচামেচি শুরু করলেন, ‘এই শালা আমারে কান্না শেখায়। বাপ মরুক, তার পর বুঝতে পারবি বাপ কি জিনিস। ’ আমি চুপ করে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। রাত গভীর হচ্ছে। বাবার জ্বর বেড়েই যাচ্ছে।

জ্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদেরও উৎকন্ঠা বেড়ে চলছে। এর মাঝে একবার দাদা এসে বলে গেল, ‘এই হারামীটা এখানে কি করে? এখনো ঘুমাই নাই। ভাগ এখান থেকে। ’ আমি ভাগলাম। রুম গিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকলাম।

ভয়লাগছে-ভুতের ভয়। এমনিতেই দুপুর থেকে বাড়ীর আবহাওয়া থমথমে। এই গভীর রাতে কিছুকিছু মানুষ জেগে আছে। বাবার বেডের পাশে হারিকেন আর কুঁপির বাতি আলাদা একটা আবহাওয়া তৈরী করছে। এই আবহাওয়াটা আমার খারাপ লাগছে।

শেষ রাতের দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ছোট এই গল্পটা বলার একটা অনেক বড় কারন আছে। কারনটা বলার জন্য আসল ঘটনা বলতে হবে। আসল ঘটনায় আসা যাক। বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ছিলেন।

বাজার মসজিদে ফজরের জামাতে খুব কম লোকই পড়ত। কম লোকের মধ্যে দুই জনকে সব সময় পাওয়া যেত। এই দুইজন লোক আমি এবং বাবা। শীতের সময় মসজিদের মুয়াজ্জিন মসজিদে আসতেন না। এই লোক বাবাকে জোর করে মসজিদের চাবি দিয়ে যেতেন।

ফজরের আজানের দায়িত্ব পড়ত আমার কাঁধে। এই কাজগুলো আমি কখনোই আগ্রহ করে করতাম না। সব সময় বিরক্ত হতাম। এতো ছোট বয়সে ফজরের নামাজ পড়া আমার জন্য খুবই বিরক্তিকর ছিল। এই বিরক্তির কাজটা বাবা আমাকে করতে বাধ্য করতেন।

কাকডাকা ভোরে তিনি আমার পা ধরে টানাটানি করতেন। মসজিদে যেতে হবে। আজানের সময় ঘনিয়ে আসছে। আজ বাবা অসুস্থ। আগামীকাল আমাকে ফজরের নামাজ পড়তে হবে না।

সকাল বেলা দেখি আমার পা ধরে কে যে টানছে। আমি ফজরের সময় প্রতিদিন পা টানা বিষয়টাতে অভ্যস্ত। আমি প্রানপনে চাচ্ছিলাম এই হাত যেন বাবার হয়। চোখ শক্ত করে বন্ধ করে আছি। ‘কিরে হারামী? চোখ বন্ধ করে আছিস কেন? নামাজ পড়তে যাবিনা?’ পরিচিত একটা কন্ঠ।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি দাদা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ বিমর্ষ। রাত জাগা মানুষের চোখ। চোখের মনি ভয়ানক রকম লাল।

আমি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে বাইরে আসলাম। কলপাড়ে যেতে হবে। অযু না করলে নামাজ হওয়ার কথা না। বাড়ীটাকে এতো আশ্চর্য রকম নীরব মনে হচ্ছে কেন? এই নীরবতা আমার অপরিনত ছোট মানুষের কানে পিনের মতো ফুটো করে যাচ্ছে। কলপাড়ে কলের শব্দে আমি তাকালাম।

চমকে গেলাম। একজন পরিচিত মানুষের মুখ। দীর্ঘদিন এই মুখটা আমি শুনে এসেছি। আরো দীর্ঘদিন এই মুখটা দেখতে চাই। ছোট্ট একটা ঘটনা বলে শেষ করি।

২০০০ সালের ১ জানুয়ারী। আমি কান্নাকাটি করছি। হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে কান্না। নাকের সর্দি আর মুখের লালা পরনের শার্টে মাখামাখি। কান্নাকাটির বিষয়টা খুবই ছোট।

এতো ছোট ঘটনায় কান্নাকাটি দেখে মা কিছুক্ষন আগে একটা চড় দিয়ে গেছেন। গালের মধ্যে পাঁচটা আঙ্গুল বসে আছে। আমি কান্না বাড়ানোর সুযোগটা মিস করলাম না। কান্নার স্বর আরো বাড়িয়ে দিলাম। আশেপাশের সব বাড়ীর লোকেরা এসে দেখছে ঘটনা কি।

মা চুপ করে ঘরে বসে আছেন। এই ভদ্রমহিলা কারো সাথে কথা বলছেন না। ছেলেকে থাপ্পড় মারার পর তার মাথা ঠিক নেই। সন্ধ্যা বেলা বাবা বাড়ীতে এসেছেন। বাড়ীর বাইরের গেটে একজন ছেলেকে শুয়ে থাকতে দেখলেন।

ধুলাবালিতে মাখামাখি। কাছে গিয়ে ধুলাসহ নিজের পরিবারের সবচাইতে ছোট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন। বাড়ীতে ঢুকে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘটনা কি বউ? বেটা দেখি বাড়ীর বাইরে জলকেলী না খেলে ধুলাকেলী খেলছে। ’ ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘তোমার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আবোল-তাবোল বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করছে।

’ ‘আবোল-তাবোল বিষয়টা কি?’ ‘আজ থেকে ২০০০ সাল। তার কান্নার কারন হলো সে নাকি কোন দিন আর পরীক্ষার খাতায় সালের জায়গায় ১৯৯৯ কথাটা লিখতে পারবে না। ’ বাবা হাসি দিলেন। আমার অট্টকান্না তার অট্টহাসিতে ঢাকা পড়ে গেল। আমার ধুলামাখা ছোট্ট শরীরটাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলেন।

রাতে শুয়ে আছি। ঘুম ধরছে না। বাবার সাথে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। সাহস পাচ্ছি না। বাবা নিজে আমার ছোট্ট শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পাজির পা-ঝাড়া বুঝিস?’ আমি মাথা নাড়লাম।

আমি বুঝি না। ‘তুই হলি সেই পা-ঝাড়া। আজ তোর ১৯৯৯ সাল চলে যাওয়ার জন্য কান্না লাগছে। দেখতে দেখতে ২০০০ চলে যাবে। একটা করে বছর চলে যাবে, তোর আর আমার মাঝে দূরত্ব ততই বাড়বে।

তুই হবি তরুন আমি হব বৃদ্ধ। তুই খুজবি নতুন সঙ্গী, নতুন বন্ধু। আমি হব সঙ্গী ছাড়া। আমার মৃত্যুর সাথে সাথে বংশ তালিকায় যোগ হবে আরেকটি নাম। আমার শ্রেষ্ঠ সময়টা ১৯০০ শতাব্দীতে, তোরটা হবে ২০০০ এ।

বাবার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কান্নায় চোখটা ভিজে যাচ্ছে। লজ্জা পাচ্ছি। বাবাকে চোখের জল দেখাব না। মাথাটা ঢুকিয়ে ফেললাম বাবার চওড়া বুকে।

এতো ছোট বয়সে এতো লজ্জা কোত্থেকে আসে আমি জানিনা না। কাহিনী এবার অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। শেষ করা যাক। বাবা অদ্ভুত সুন্দরভাবে জীবনানন্দ পাঠ করতেন।

প্রতিশুক্রবার সন্ধ্যা বেলা বাড়ীতে কবিতার আসর বসত। বাবার সবচাইতে প্রিয় কবিতা ছিল, ‘পৃথিবীর বাধা এই দেহের ব্যাঘাতে হৃদয়ে বেদনা জমে-স্বপনের হাতে আমিতাই- আমারে তুলিয়া দিতে চাই! সেইসব ছায়া এসে পড়ে দিনের-রাতের-ঢেউয়ে-তাহদের তরে জেগে আছে আমার জীবন; স্বপ্নের হাত। । ’ আমি মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে শুনতাম। মাঝে মাঝে আমার কপালে জলের ফোঁটা টিপটিপ করে ঝরে পড়ত।

আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করতাম। মায়ের জলে ভেজা চোঁখ দুটোকে দেখতে চাই না। শত অভাবের মাঝে বাবার ভালোবাসা আমাদের এভাবেই কাঁদিয়ে যেত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.