পত্রিকান্তরের খবরে জানা যায়, পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। সে খবর অনুসারে ৯৯ শতাংশ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নেই। অবশ্য একই খবরে বিজিএমইএর সভাপতির বক্তব্য অনুসারে প্রায় ১০ শতাংশ কারখানায় এখন ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। তা হলেও ৯০ শতাংশেই নেই। সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির মতে, মালিকেরা কখনো চাননি পোশাকশিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠুক।
এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও তারা করেছে। আরও জানা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিলেই সে শ্রমিক চাকরিচ্যুত বা হয়রানির সম্মুখীন হয়। কিন্তু এমনটা হবে কেন? আমরা গণতান্ত্রিক শাসন চাই। পোশাকশিল্প মালিকেরাও তা-ই চান। আর সে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জাতীয় সংসদে সদস্যরূপে ব্যাপকসংখ্যক পোশাকশিল্প মালিক রয়েছেন।
জনগণই ভোট দিয়ে তাঁদের নির্বাচিত করেছেন। আবার ভোটের জন্য তাঁদের কাছেই যাবেন অচিরেই। অথচ নিজস্ব কারখানাটিতে তাঁরা শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন করতে দিতে চান না। চান না তাঁদের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করতে।
আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে নাগরিকদের সমিতি ও সংঘ করার অধিকার দিয়েছে।
সে অধিকার প্রয়োগের প্রক্রিয়া, কার্যপদ্ধতি, দায় ও সীমাবদ্ধতা শ্রম আইন, ২০০৬-এর ত্রয়োদশ অধ্যায়ে রয়েছে। তবে আইনেরই একটি ধারায় মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে একটি অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠনের বিধানও আছে। মালিকপক্ষ এ বিধানের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে সে কমিটি গঠন করে। এটা কখনোই ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হতে পারে না। এ ধরনের অংশগ্রহণমূলক কমিটি গঠনের বিধানের চেতনা ভিন্ন।
অধিকার থাকলেও কোনো শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করতে ইচ্ছুক না-ও হতে পারেন। এমনটা হতে পারে কিছু কিছু কারখানায়ও। সম্ভবত সেগুলো বিবেচনায় রেখেই অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠনের বিধানটি রাখা হয়েছে। কিন্তু তা ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প অবশ্যই নয়। তা হতেও পারে না।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্য। এটি জাতিসংঘের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে কাজ করা এর মূল চেতনা হলেও আইএলওর সাধারণ সভা ও বোর্ডে শ্রমিক, মালিক ও সরকার সব পক্ষের প্রতিনিধিরা থাকেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পারস্পরিক আলোচনা ও বাস্তবতার নিরিখে। শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার সম্পর্কে আইএলও সনদ (কনভেনশন নামে পরিচিত) অনুমোদন করেছে।
এরূপ গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশন হলো ৮৭ ও ৯৮। এ দুটোতেই বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। কনভেনশন ৮৭-তে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের সংগঠন করা ও নেতা নির্বাচনের অধিকার থাকবে। আর কনভেনশন ৯৮-তে রয়েছে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের যৌথ দর-কষাকষির সুযোগ। এ ধরনের সংগঠন ও নেতা নির্বাচন শ্রমিকেরাই করবেন।
বাংলাদেশে শ্রম আইনের বিধিবিধান পর্যালোচনা করে রেজিস্ট্রেশন দেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রম পরিদপ্তর। ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় এ পরিদপ্তর সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার কথা। এ আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার উপেক্ষা করে অংশগ্রহণকারী কমিটির ধারণাকে এর বিকল্প মনে করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কারখানা পর্যায়ে থাকলে শিল্প বিরোধের অনেকগুলোই দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। কথায় কথায় পুলিশ ডাকতে হয় না।
সমস্যা যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন ক্ষুব্ধ শ্রমিক কিংবা এর সুযোগ নিয়ে অন্য কেউ ভাঙচুর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়। তখন এ ধরনের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এক বা একাধিক ফেডারেশন থাকলে দ্রুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসার সুযোগ থাকে। যেমনটা অতিসম্প্রতি চা-শ্রমিকদের একাধিক ফেডারেশন বেতন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। তাদের নেতাদের সঙ্গে সরকার ও মালিকপক্ষ আলোচনা করে তখনকার মতো বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ফেলে। আশা করা যায়, সব পক্ষ বাস্তবসম্মত দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে চা-শ্রমিকদের দাবিগুলোর ন্যায়নিষ্ঠ ও যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে পারবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে অন্য খাতগুলোর বিবেচনায় সর্বাধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে। এগুলোর পরিবেশ যতটা সম্ভব নির্বিঘ্ন রাখতে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে এ ধরনের পদক্ষেপ রাখতে ভয় কোথায়, তা বোধগম্য নয়।
তৈরি পোশাকশিল্পে দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে রানা প্লাজার মতো ট্র্যাজেডি ঘটত না বলে অনেকে মনে করেন। এ সম্ভাবনাময় শিল্পটির সামনে আজ আশাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির সুযোগ দেখা দিয়েছে। একে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের আরও কারখানা গড়ে উঠুক, নিয়োগ পাক আরও কয়েক লাখ শ্রমিক, এটা সবাই চায়।
পাশাপাশি সবার প্রত্যাশা, নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, ন্যায়সংগত বেতন-ভাতা, দৈব-দুর্ঘটনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও কর্মাবসানের পর যথোপযুক্ত গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা তা উপেক্ষা করবেন কীভাবে? সংঘবদ্ধ অবস্থান ও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর তাঁদের প্রভাব অপরিসীম—এটা অনুমান করতে কারও কষ্ট হয় না। তাই রাষ্ট্রশক্তিকে তাঁদের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রায় ক্ষেত্রে। ইদানীং শ্রম আইন সংশোধনী প্রস্তাবেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। নিট মুনাফার শতকরা ৫ ভাগ শ্রমিকদের প্রাপ্য বলে বিদ্যমান শ্রম আইনে স্বীকৃতি রয়েছে।
অথচ বর্তমান বিবেচ্য সংশোধনীতে রপ্তানিমুখী শিল্পকে এ দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। বলা হয়, এটা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়নি। তাহলে প্রয়োগের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়াই তো সমীচীন। তা না করে পেছনে যাত্রা আমাদের বিস্মিত ও হতাশ করে।
তৈরি পোশাকশিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন সরকার গঠন করে দেবে না।
এরূপ কোনো বিধানও নেই আইন কিংবা আইএলও কনভেনশনে। ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকের আইনসংগত অধিকার। সে অধিকার প্রয়োগে তাঁরা যেন বাধাপ্রাপ্ত না হন, এ বিষয়ে সময়ের বিবেচনায় সরকারের বিশেষ নজরদারির আবশ্যকতা রয়েছে। পর পর দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের সংবাদ এ শিল্পের ক্রেতা দেশগুলোতে আমাদের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
তারা আমাদের কারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থার শোচনীয় দুর্বলতা, শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদির অপ্রতুলতা আর আজতক কোনো দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির সাজা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ। পাশ্চাত্যের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আমাদের তৈরি পোশাকশ্রমিকদের শ্রমদাস রূপে আখ্যায়িত করছেন। এ-জাতীয় পরিবেশে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও তাদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলছে। আমদানিকারকদের একটি অংশ এখন আমাদের কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নয়নে সহযোগিতা করতে সম্মত বলে জানা যায়। এটা আমাদের জন্য শুভ সংবাদই বটে।
আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প অমিত সম্ভাবনা ও অযুত সমস্যার মুখোমুখি। এ সমস্যাগুলো থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটিয়ে সম্ভাবনার পুরো ব্যবহার সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে শ্রমিকদের নিরঙ্কুশ সহযোগিতা ও সমর্থক। প্রয়োজন রয়েছে তাঁদের মাঝে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির। এ পরিবেশ সৃষ্টিতে ট্রেড ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পোশাকশিল্প মালিকেরা যত দ্রুত এটা বুঝবেন, ততই মঙ্গল। আর কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে জাতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলো তাদের প্রচেষ্টা জোরদার করতে পারে। সে প্রচেষ্টায় কারখানার মালিক ও সরকারের শ্রম পরিদপ্তরের সহায়তার আবশ্যকতা রয়েছে। এ ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন আমাদের পোশাকশিল্প খাত সম্পর্কে ক্রেতা দেশগুলোর নেতিবাচক ধারণা হ্রাসে সহায়তা করবে বলে মনে করা হয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অনেকগুলো খাতে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
বিশেষ করে, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাতের বিষয় নজরে আসার মতো। সেগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অন্যায্য আচরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপন্ন করতে ভূমিকা রেখেছে ও রেখে চলছে। অবশ্য সাম্প্রতিক কালের কিছু জালিয়াতির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা ‘ঋণ’ প্রদানের সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায় না। ট্রেড ইউনিয়নগুলো দ্বারা যে ধরনের নেতিবাচক ঘটনা ঘটে, এমন তো আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও ঘটে চলছে। জাতীয় পর্যায়ের কথা বাদই দিলাম।
স্থানীয় পর্যায়ে যে নেতারা আছেন, তাঁরা কি ক্ষেত্রবিশেষে নিজ নিজ এলাকায় ব্রিটিশপূর্ব যুগের সুবাদারের মতো আচরণ করছেন না? তাঁদের কর্মী-সমর্থক ও আত্মীয়স্বজন কি সেসব স্থানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে নিরঙ্কুশ লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেনি? শুধু এবার নয়, এর আগের সরকারের সময়ও একই সংস্কৃতি ছিল। তা-ও তো আমরা বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক ধারা বিদ্যমান থাকলে ধীরে ধীরে জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে। দূর হবে এসব অপরাজনীতি। এ ধরনের নেতাদের ভূমিকার জন্য আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই না। ঠিক তেমনি ট্রেড ইউনিয়নের কিছু বিভ্রান্ত নেতৃত্ব একটি পর্যায়ে দায়িত্বশীল হবেন, এ আশা করা মোটেও অসংগত নয়।
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বিভিন্ন দেশে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের একটি অংশ জাতীয় নেতৃত্বেও আসে। আমাদের উপমহাদেশেও তাই হয়েছে এবং হয়ে চলছে। তাই গণতন্ত্র মানলে ট্রেড ইউনিয়নও মানতে হবে। কেননা, গণতন্ত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন একে অপরের পরিপূরক।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।