জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেয়া নিবন্ধনের বৈধতা সংক্রান্ত রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে যে কোন দিন রায় দেবে আদালত। এ বিষয়ে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বুধবার বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এদিকে দেখা গেছে, রুলের চূড়ান্ত শুনানিতে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপস্থাপন করে জনস্বার্থে দায়ের করা এ রিট আবেদন ও আবেদনকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ করা চেষ্টা করেছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীরাও তাদের হলফনামা আকারে যে বক্তব্য দিয়েছেন, আদালতের শুনানিতে তাঁরা ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
আদালত এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর প্রতি মৃদু ক্ষোভও প্রকাশ করেছে।
আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
আদালতে শুনানিতে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, যে গঠনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল, তা ছিল নিবন্ধনের অযোগ্য। তাই নিবন্ধনের পর ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুযোগ নেই। জামায়াতের নিবন্ধন সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
তিনি বলেন, সংবিধানে রাজনৈতিক দল করার মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে কোন দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্য থাকলে সংগঠন বা রাজনৈতিক দল করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের এ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জামায়াতের জন্ম হয়েছে ভারতে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দলটির শাখা রয়েছে। তাই ইসি দলটিকে নিবন্ধন দিতে পারে না বলেও বলেন এ আইনজীবী।
অন্যদিকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ইসি এখনও নিবন্ধনের বিষয়ে পরিপূর্ণ কোন সিদ্ধান্তে আসেনি। তারা কোন সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত রিট আবেদন অপরিপক্ব। তিনি বলেন, ২০১২ সালে ইসি একটি মেমো তৈরি করে।
সেখানে মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও জাসদ ছাড়া বাকি সকল দলের গঠনতন্ত্র ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তাই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হলে বাকি ১০টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনও বাতিল করার প্রয়োজন হবে। এটা করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, যারা জামায়াতের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করেছে তাদের গঠনতন্ত্রে জিহাদ ও ইসলামের কথা রয়েছে। কিন্তু জামায়াতের গঠনতন্ত্রে জিহাদের কথা নেই।
অসৎ উদ্দেশ্যে রিট করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিষয়ে ২০০৮ সালে আইন হয়। এ আইন পরিপূর্ণ নয়।
নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী মহসীন রশিদ বলেন, ২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। সে সময় সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের কথা ছিল। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়।
গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েই তখন ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। তখন ইসির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
শুনানিতে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ॥ একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপস্থাপন করে এই রিট আবেদন ও আবেদনকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে জামায়াতের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। মঙ্গলবার শুনানিতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, রিট আবেদনটি বিড়ম্বনাকর। জনস্বার্থ রিট বিড়ম্বনার উদ্দেশ্যে করা হলে সে রিট চলতে পারে না।
তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে দলটি ও এর সদস্যদের সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক উক্তি ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। রিট আবেদনকারীদের দাবি জামায়াতে ইসলামী আধুনিক জিহাদকে সমর্থন করছে। অথচ তরিকত ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘আল্লাহর পথে জিহাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বুধবার শুনানিতে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, তরিকত ফেডারেশন ও জাকের পার্টির গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন কিছুই নেই। এতে রিট আবেদনের আরজির সঙ্গে তাদের গঠনতন্ত্রের স্ববিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে।
সূত্রটি জানিয়েছে এসব বক্তব্য রিট আবেদনের মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। এসব বক্তব্য উপস্থাপন করেন আবেদনকারী ও রিট আবেদনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন জামায়াতের আইনজীবী।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী হলফনামা আকারে যে বক্তব্য আদালতে দাখিল করেছিলেন তার সঙ্গে শুনানিতে প্রদান করা বক্তব্যের গরমিল রয়েছে। মঙ্গলবারের শুনানিতে এ জন্য আদালত নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর প্রতি মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালত নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী মহসীন রশিদকে বলেন, আপনি হলফনামা আকারে যে বক্তব্য আদালতে দাখিল করেছেন তার সঙ্গে শুনানিতে যে বক্তব্য রাখছেন, তার সঙ্গে কোন মিল নেই।
আপনি একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন এটা মনে রাখা দরকার।
২০০৯ সালে ২৭ জানুয়ারি জারি করা রুলে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯০বি (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মোঃ আব্দুল হাইয়ের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারি করেছিল। পরে রুলটি বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আংশিক শুনানির মধ্যেই ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়।
আদেশে, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
এ অবস্থায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে রুল আবেদনটির ওপর শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিতে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেন আবেদনকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। এ আবেদনে বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চকে এ আবেদনটি শুনানির জন্য দেয়া হয়। পরে গত ৭ মার্চ এ আদালত মামলাটি কার্যতালিকার এক নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর বৃহস্পতিবার হরতাল থাকায় শুনানি হয়নি।
রবিবার আবার শুনানির জন্য তালিকায় আসার পর আদালত বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদনটি পাঠিয়ে দেন। পরে আবেদনটির ওপর প্রায় ১০দিন চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ের জন্য রাখা হলো।
এর আগে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ ব্যক্তির পক্ষে সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর রিট আবেদনটি দায়ের করেছিলেন।
রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, চার কারণে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে পারে না। প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সকল ক্ষমতা উৎস বলে মনে করে না।
সেসঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না। দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোন সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল। তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোন বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে কখনও কোন নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।
চতুর্থত, কোন দলের বিদেশে কোন শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে তাদের জন্ম ভারতে। বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নবেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নবেম্বরে দুবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়।
এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।