অলোক আমার ভার্সিটি জীবনের প্রথম বন্ধু। আমরা দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটির কমার্স ফ্যাকাল্টির বিবিএ-র ছাত্র। ভর্তি হওয়ার পর ডিপার্টমেন্টের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয়। ক্রমান্বয়ে আমরা ঘনিষ্ট হতে শুরু করি।
অলোক কবিতা লেখে।
ইতোমধ্যেই কবি হিসেবে ওর খানিকটা খ্যাতি এসেছে। ২০০৭ থেকেই ওর কবিতা দেশের নানা লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হচ্ছে। এই তো সেদিন প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় ওর কবিতা বের হওয়ায় আমাদের মধ্যে হই চই পড়ে যায়। আমাদের বন্ধু অলোক কবি হিসেবে একদিন সেলিব্রিটি হবে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হই। আমরা, ওর সহপাঠিরা সেদিন থেকেই কবি বলে ডাকতে শুরু করি।
মিয়াজি আলোক নামে ও লেখে। যদিও ওর পোষাকী নাম মিয়া মোহাম্মদ আলোক। নাম পরিবর্তনের কারন জানতে চাইলে ওর যুক্তি, "আধুনিক কবিদের নামের মাঝে কাব্যিক চমক থাকতে হবে। এই যে দেখ্, টোকন ঠাকুর, ইমরাণ মাঝি, রহমান হেনরী এরা সবাই তো নাম পাল্টিয়েছে। টোকন ঠাকুর তো পিতৃদত্ত নাম খোল-নলচে সহ পাল্টিয়ে ফেলেছে।
আর আমি তো শূন্য দশকের কবি ..."
আধুনিক কবিদের নামের সাথে আমার পরিচয় নেই। কবিতা আমার অপছন্দের বিষয়। আধুনিক কেন, সত্যি বলতে কোন কবিতাই আমাকে টানে না। ইস্কুল কলেজে বাধ্য হয়েই রবীন্দ্র, নজরুল, জসীম উদ্দিন, শামছুর রহমানের কবিতা পড়া। নজরুল, রবীন্দ্র, জসীমউদ্দিনের কবিতা তাও পড়া যায় ছন্দের তালে তালে।
শামছুর রাহমান? ছ্যাঃ ! এগুলো কী করে কবিতা হয় বুঝি না। পরীক্ষা পাশের জন্য তিতা ঔষধ গিলার মত মুখস্ত করতে হয়েছিল বেশ কিছু কবিতা; শিখতে হয়েছিল 'প্রসঙ্গ উল্লেখ করিয়া নিম্নের চরণগুলো ব্যাখ্যা করো' জাতীয় প্রশ্নের উত্তর। বিশ্রী যত ব্যাপার স্যাপার।
কবিদের নাম বিষয়ে ও হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। থামিয়ে দেই ওকে।
- তুই যে নামগুলা কইলি হেরা আবার কোন কুতুব?
-ধ্যাত তুই ক্ষেতই রয়ে গেলি। এদের নাম শুনিছ নাই। এরাই তো সমকালীন পাঠকপ্রিয় প্রতিনিধিত্বকারী কবি।
আমার ভাল লাগছিলো না কবিদের নাম, কবিতা নিয়ে অলোকের এই আজাইরা আঁতলামি। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ওকে বলি, " চল্, রোকেয়া হলের সামনে যাই..ডেগি দেইখা আসি।
" আমার মতোন এ বিষয়ে ওর আগ্রহের কমতি নেই। মনে হয় আমরা যারা অকবি তাদের চেয়ে মেয়েদের বিষয়ে কবিদের আগ্রহ অনেক বেশী থাকে। কবিদের বেশীরভাগ কবিতাই তো প্রেম আর নারী নিয়ে। তাই মেয়েদের হলের সামনে যেয়ে টাংকি মারার কথা বললে ওর চোখ সবসময়েই ঝিলিক দিয়ে উঠে। না করে না কখনো।
এভাবেই বেশ এগিয়ে চলছে আমাদের বন্ধুত্ব।
আমি কবিতা বুঝি না। তবুও ওর প্রায় সব কবিতার প্রথম শ্রোতা আমি। ও যেদিন কবিতা শুনায় আমরা চলে যাই বসুন্ধরা মার্কেটের সিনেপ্লেক্সের পাশের ফুডমলে। আইসক্রিম খেতে আমার ভাল লাগে।
কবিতা পড়ার আগে একটা নিরিবিলি টেবিল বেছে নিয়ে ও আমার পছন্দের আইসক্রিম অর্ডার করে। এটা যেন একধরণের অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। ভরাট কন্ঠে আবৃত্তি করে শুনায়, করে ওর সদ্য লেখা কবিতার ব্যাখ্যা। দূর্বোধ্য লাগে ওর কবিতা ও কবিতার ব্যাখ্যা। ও বলে এগুলো পোষ্টমডার্ণ কবিতা।
" কবিতা লজিকালি বোঝার চেষ্টা করিস না। বরং দেখ কবিতা তোর বোধে টোকা লাগে না। " যদিও আমি নির্বোধ নই তবুও কবিতা শুনে নিজেকে বোধহীন মনে হয়। আমার ভোতা অনুভবে কোন সাড়া জাগে না। ওর কথাগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে যায়।
বন্ধুত্বের অত্যাচার। মনে মনে আমি কবিতার গুষ্ঠি কিলাই। কবিতা নিয়ে ও যখন কিছু বলে তখন ভীষণ ঘোরের মাঝে থাকে। এই অবসরে আমি শুরু করি আশেপাশের টেবিলে মেয়েদের দেখতে, জুতসই কোন মেয়ে পেলে চোখ শুরু করে তার শরীর ব্রাউজ করতে। ওর কবিতা শুনার চেয়ে এই সব ডাঙ্গর ডাঙ্গর মেয়ে দেখতেই আমার বেশী আনন্দ।
যা হোক, কবিতা শুনার বিনিময়ে এখানকার আইসক্রীম, কফির বিল কিংবা হাকিম চত্বরের দোকানগুলোতে চা-নাস্তার বিল ওই দেয়। এটাই বা কম কীসের! খোলামকুচির মতোন ও খরচ করে যতক্ষণ ওর পকেটে পাত্তি থাকে। সব কবিই কি এমন দিল দরিয়া হয়!
চলবে....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।