আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুনি

#####রাত ১টা##### শান্তার দেহটাকে পাঁজাকোলা করে ধরে আমি হেঁটে চলেছি ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে। গোটা রাস্তা একদম ফাঁকা। ঢাকার রাস্তাও যে এতটা নীরব, প্রাণচাঞ্চল্যহীন নিথর হতে পারে, আগে কোনদিন জানতাম না। আমার কিন্তু এই বিরল দৃশ্যে কোন মনোযোগ নেই। আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি শান্তার মুখের দিকে।

কি নিষ্পাপ মুখ। চাঁদের আলোয় তা যেন ঝলমল করছে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আবেশে। কি আশ্চর্য! যেই মেয়েটার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ আমার চিরচেনা, তার এই শ্রেষ্ঠ রুপ-লাবণ্যই আজো আমার কাছে এত অচেনা। ওর এই মুখ, এই ঠোঁট, এই মুখের ওপর এসে পড়া একগাছি চুল আমায় নিয়ে গেল সেই স্বর্ণালী দিনগুলোয়। কি বর্ণীলই না ছিল সেসব দিন।

ওর সাথে আমার পরিচয়, ওর সাথে আমার কাছাকাছি আসা, ওর সাথে আমার এক পথে চলা, হঠাৎ একদিন ওকে মনের কথা খুলে বলা, ওর সাথে আমার মিলন... মিলনের কথা মনে আসতেই চোখটা কুঁচকে গেল আমার। ছোটবেলায় যে মিলনের ব্যাপারে ছিল এত আগ্রহ, কৌতূহল, নিষিদ্ধ ভালোলাগা- সেই মিলনই আজ আমার জীবনে এক বিভীষিকা হয়ে হানা দিল, তছনছ করে দিল স্বপ্নের মত দিনগুলোকে। আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের কথাটা। তার কদিন আগে থেকেই শান্তা আমার সাথে কেমন যেন শীতল আচরণ করছিল। সবসময় কি যেন একটা আড়াল করার চেষ্টায় মত্ত ছিল।

যে চোখে চোখ রেখে ওকে ভালবাসার কথা বলেছিলাম, সেই চোখেই দেখতে পেতাম একটা গোপনীয়তার দোলাচল। মেনে নিতে পারি নি তা। সবসময় ভয়ে সিটিয়ে থাকতাম, ওকে হারাবার ভয়। আর সেই ভয় থেকেই যতসব সন্দেহের শুরু। আমার মত একটা অসমর্থ বেকারের আর কিই বা ছিল সে সময় করার? আমার মনের মধ্যে সবসময় যে কি আশংকা খেলা করত, তার বহিঃপ্রকাশ লেখার খাতায় ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব।

যাইহোক, সেদিন দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম শহীদ মিনারের সামনে। অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম দুজনে। নীরবতার কারণ এই যে আমি সেদিন সরাসরিই ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার কি ব্যাপার শান্তা? তুমি আমায় এড়িয়ে চলছ কেন? তোমার কি আর আমাকে দিয়ে চলছে না? নতুন পুরুষের ঘনিষ্টতা পাবার আশায় শরীর নিশপিশ করছে? আমি জানি কথাগুলো ছিল খুবই কদর্য। এও যানতাম যে তার একবর্ণও সত্যি হতে পারে না। তবু কেন আমার অস্থির মন এমন বাজে কথা মুখ থেকে উচ্চারণ করাল, সে কেবল অদৃষ্টই জানে।

আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে বিমূঢ় হয়ে ছিল ও। তারপর একসময় আলতো করে ঠোঁট নাড়িয়ে বলেছিল, আমার গত ২ মাস ধরে পিরিয়ড বন্ধ। আমি তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি? আসলে নারীদেহের সৌন্দর্যের আমি ছিলাম একজন নিষ্ঠ পূজক। কিন্তু সেই দেহেরই কলকব্জা কিংবা জন্ম রহস্য সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল অস্পষ্ট। তাই আমি আবার বলেছিলাম, পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে তো আমি কি করব? আমার তাতে কি করার আছে? শান্তা আবারো কিছুক্ষণ নীরব থেকে অস্ফুট স্বরে বলেছিল, বিজয়! আমি গত ২ মাস হল কনসিভ করেছি।

এখন আমি কি করব বল? আর দু-এক সপ্তাহের মধ্যে অ্যাবরশন না করালে পরে সমস্যা হতে পারে। আমার শরীরে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আমার ঔরস থেকে যে সন্তানের উৎপত্তি হয়েছে, তাকে অ্যাবরশন করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? না, তা হতে পারে না। আমি বলেছিলাম, এখানে অ্যাবরশনের কথা আসছে কেন? -'তা ছাড়া আর কিই বা করার আছে বল? এই বাচ্চাটাকে কি আমরা অবৈধভাবে দুনিয়ায় আনবো? তারপর তার পরিচয় কি হবে? আর তোমারও তো এখন সম্ভব হবে না আমাকে বিয়ে করে এই বাচ্চার দায়িত্ব গ্রহণ করা। সে সামর্থ্য তো তোমার এখন নেই।

' শান্তা যা বলেছিল, তা সবই সত্য। কিন্তু ঐ যে ও আমার অসামর্থ্যতার কথা তুলল, এতে যেন আমার পুরুষসুলভ অহংয়ে প্রবল আঘাত লাগলো। আমি উল্টো ওকে বলে বসলাম, সত্যি করে বল তো এ বাচ্চা আমারই কিনা নাকি তুমি গোপনে আর কারো সাথে অসভ্যতা করেছ যার ফল এই বাচ্চা? তা না হলে কনসিভ করার দুমাস পর তুমি আজ হঠাৎ এসব বলছ কেন আমায়? যাতে সব দোষ আমার ঘাড়ে ফেলতে পারো, না? নইলে এতদিন ঘটনাটা আমার কাছে গোপন করে গেছ কেন? এ কথা বলেই আমি নিজের কানকে অবিশ্বাস করতে লাগলাম। যা বললাম, তা কি সত্যিই আমি বললাম? আমি কি জানি না শান্তা কতটা সৎ আমাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে? ও তো কখনো চায়ও নি বিয়ের আগে মিলিত হতে। আমিই তো জোর করে ওর কুমারীত্ব ভেঙ্গে দিয়েছি।

নিষ্পাপ একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছি। আর আমি কিনা ওকে আজ দোষারোপ করছি সবকিছুর জন্য? আমিও আজ সেইসব কাপুরুষদের দলে সামিল হলাম যারা নিজেদের জীবন সংগ্রামে ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হয়ে তার প্রভাবে অন্য আরেকটি নারীর জীবনও বিষিয়ে দেয়, ধ্বংস কে দেয়? আমার ভাবনার ঘোর ভাঙল রাস্তার পিচে স্যান্ডেলের হিলের ঘর্ষণের শব্দে। তাকিয়ে দেখি শান্তা কাঁদতে কাঁদতে, হাত মুখে ঢেকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আমার থেকে দূরে, অনেক দূরে। আমার উচিত ছিল ওকে থামানো।

পারলাম না। আমার পা নড়ল না। শহীদ মিনারের সামনেই সেদিন শহীদ হল আমাদের অতদিনের মধুর সম্পর্কের। তারপর বেশ কয়েকদিন ওর সাথে আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। ওর ফোনে কল করে ওকে পেলাম না।

ওর হোস্টেলে গিয়ে শুনি ও হোস্টেল ছেড়ে চলে গেছে। খবর নিয়ে জানতে পেলাম ও খুলনায় ওর বাড়িতে ফিরে গেছে। তিন-চারদিন পরই শুনি ও আবার ফিরে এসেছে। ওর বাসায় ওর প্রেগনেনসির কথা শুনে ওর বাবা ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। এরপরও আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেতে পারি নি।

তার মূলে কি ছিল আমার সেই পৌরুষের মিছে অহংকার? হায়রে দুর্ভাগা পৌরুষ! ##### তারপরের ঘটনা যাকে ইংলিশে বলে অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট! ও আজ সন্ধ্যায় ক্লিনিকে গিয়ে অ্যাবরশনটা করেই ফেলল। সব দায় যখন স্রেফ ওর, তবে সমাজে মাথা তুলে বাঁচতে ওর মত সাধারণ মেয়ের আর কিই বা করার ছিল? কিন্তু আদৌ কি ওর বাঁচার ইচ্ছা ছিল? মনে তো হয় না। অ্যাবরশনের পর ও যখন হোস্টেলে ফিরে এসেছে, আমিও ওদের হোস্টেলের মেয়েদের কাছ থেকে সব জানতে পারলাম যে ও এই কেবল আবরশন করে ফিরে এসেছে। সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর, ততদিনে ওর সামনে যাওয়ার সাহস হল আমার। কোথা থেকে এই সাহস আসলো, কে জানে! হয়ত বা আমার অমতে কেন অ্যাবরশন করাল, তার জবাব চেতেই সেই চিরাচরিত পুরুষের জোরে হারানো সাহস ফিরে পেলাম।

কিন্তু নারীরা কি সবসময়ই পুরুষের এই পৌরুষ মুখ বুজে মেনে নেবে? না। তা তো হয় না। তাই শান্তার হোস্টেলের ঘরে ঢুকে দেখতে পেলাম শান্তা বিজয়িনীর মত মুখভঙ্গিতে, গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে! ##### আমি তখন আর কি করবো? স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শান্তার মোবাইল তুলে নিয়ে 'ক্লিনিক' লেখা নাম্বারে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনাদের ক্লিনিকের সব আবর্জনা যায় কোথায়? উত্তর পেলাম, কেন ড্রেনে! আবার জিজ্ঞেস করলাম, না না! বলছি ড্রেন থেকে সেটা যায় কোথায়? -'মনে হয় বুড়িগঙ্গায়' ##### পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছে গেলাম বুড়িগঙ্গা তীরের একটা শ্মশানে। পুড়িয়ে দিলাম শান্তার শরীরটা সেখানে। রীতি অনুসারে তার শরীরের ছাই ভাসিয়ে দিলাম বুড়িগঙ্গার জলে।

যাক ভেসে সে। তার হারানো বাচ্চার শরীর সৃষ্টির কথা ছিল যে ভ্রূণ থেকে, তা তো অ্যাবরশনের মাধ্যমে রক্তের সাথে বেরিয়ে এসেছিল ওর জরায়ু দিয়ে। আর এসে মিশেছে ড্রেনেজ সিস্টেমের দরুণ এই বুড়িগঙ্গার জলে। সুতরাং মা আর বাচ্চার শরীরের শেষ স্মৃতি মিলুক এই বুড়িগঙ্গার জলে। যাক তারা একসাথে মিলিত হয়ে।

স্বর্গের পথে পাড়ি দিক হাতে হাত মিলিয়ে। এই কাপুরুষের কারণে বাচ্চাটাকে তার মায়ের কোলে চড়তে দেবার, তার স্তন্য পানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। তবু আমি যে নামে বিজয়! তাই শেষ যাত্রায় তাদের দুটিকে এক করতে পারার মধ্যেই বোধ হয় আমার সান্তনাসূচক বিজয় নিহিত। তাই আজ আমি সত্যিই জীবনযুদ্ধে প্রথমবারের মত বিজয়ী। যতই হই না কেন আমি পৃথিবীর কাছে খুনি! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।