আমি মিথিলার ফোনের অপেক্ষা করছি। বছর খানেক আগে ঢাকা ছাড়লেও মোবাইল ফোনের কল্যাণে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা আগের মতোই রয়ে গেছে। সপ্তাহের প্রতি শনিবার কাজ থেকে ফেরার সময় আমি এই এসফিল্ড পার্কের একটা বিশালাকৃতির ডুমুর গাছের নীচে বসে মিথিলার ফোনের অপেক্ষা করি। ভাবছেন, ডুমুর গাছ আবার বিশালাকৃতি হয় কি করে! তবে এই ডুমুরটা আমাদের অতি পরিচিত লাটিমাকৃতি ক্ষুদ্রাকৃতির বীচিভর্তি ফলটা নয়। নামে ফিগ হলেও এই গাছটার সাথে আমাদের চেনা ডুমুর গাছের কোন মিল নেই।
রাত দশটার দিকে সে ফোন করে। ঢাকার সময় তখন বিকেল পাঁচটা। তখন সে অফিস থেকে বের হয়। ওর সাথে আমি বাসায় বসেও কথা বলতে পারতাম। তবে সমস্যা হলো, আমাদের এক কামরার বাসায় রুমমেট আদনানের কানকে ফাঁকি দিয়ে কথা বলা প্রায় অসম্ভব।
তার উপর সিডনীর এই গরমের সময় আমাদের কম ভাড়ার এসি বিহীন রুমটার সাথে কেবল তন্দুর রুটির চুলার সাথেই তুলনা করা চলে।
ডুমুর গাছটার কাণ্ডটা ঘিরে নির্মিত কংক্রিটের ঘোরানো বেদীটার এক পাশে বসে আমি। মাথায় সিগারেটের তৃষ্ণা – অপেক্ষার সাথে সাথে ব্যারোমিটারের পারদের মতো ঊর্ধ্বমুখী। দূরে, পার্কের অন্য প্রান্তে কয়েকটা পরিবার গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। চারিদিকের পিন-পতন নীরবতায় নিঃশব্দে জ্বলে যাছে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো, পোকাদের নিবিড়তায়।
আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে যাবো, ঠিক তখনি ডুমুর গাছটার অন্য দিক থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠের সুস্পষ্ট ফিসফিস ধ্বনি ভেসে আসলো। হ্যালো ক্যাথি, হ্যা .........লো। হ্যা .........লো। ফিসফিসে নাঁকি স্বর। শোনার ইচ্ছা না থাকলেও আমার শ্রবণেন্দ্রিয় সেই শব্দের উৎপত্তিস্থলের দিকে উৎকর্ণ হয়ে রইলো।
ওখানে লোকটা আগে থেকেই ছিল, নাকি পরে এসেছে, আমি তা জানিনা। আই হ্যাভ কিল্ড হিম; আই হ্যাভ কিল্ড দ্যা বাস্টার্ড। টেনে টেনে বলে যেতে লাগলো লোকটা। পকেট থেকে আমার হাতটা সিগারেটের বাক্স-বিহীন বেরিয়ে আসে নিজের অজান্তে।
লোকটার কথাগুলো শুনে মস্তিষ্ক থেকে একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নীচে নেমে আসে।
আড় চোখে লোকটার দিকে তাকাই। গাছের জন্য তাকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছেনা। মুখের একাংশ, ঘাড় আর আদুল গায়ের পিঠের দিকটাই শুধু দৃশ্যমান। গলায় একটা সাদা কিছু পেঁচানো; তাতে লাল রক্তের ছোপ। উপুড় হয়ে কানের কাছে ফোন নিয়ে কথা বলছে।
আমি নিঃশব্দে একপাশে সরে আসি যাতে ও আমাকে দেখতে না পায়। আমার প্রচণ্ড ভয় করতে থাকে। লোকটা যদি জানতে পারে, ওর কথা আমি শুনেছি, তবে আমাকে জ্যান্ত ছেড়ে দেবেনা। খুনিরা কথনও সাক্ষী রাখেনা। হঠাৎ মিথিলার ফোনের কথা মনে পড়ে যায় আমার।
যে কোন মূহুর্তে ফোনটা বেজে উঠতে পারে এবং সাথে সাথে আমি ধরা পড়ে যাবো। আমি সুইচ টিপে ফোনটাকে অফ করে দেই।
ডুমুর গাছটার একপাশে আমি আর অন্য পার্শ্বে একটা খুনি, যে একটু আগে একটা খুন করে এসেছে। আমি ভয়ে কুল কুল করে ঘামতে থাকি। লোকটা খুনের বর্ণনা দিতে থাকে।
জনৈক জো ক্যাথিকে ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে ইরাক যুদ্ধে যাবার প্রেক্ষিতে ওর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে। এই মৃত্যুদণ্ড জো'র প্রাপ্য ছিল। ক্যাথি, আই ফিল ভেরী লোনলি উইদাউট ইউ। লোকটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আই ডিড ইট ফর ইউ।
আই লাভ ইউ ডার্লিং। আই লাভ ইউ।
সময় বয়ে যায়। লোকটা ক্যাথিকে ফিরে পেতে চায়। ক্যাথি মনে হয় রাজী হয়না।
ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে থাকে। আমি কিছুটা বুঝতে পারি, কিছুটা বুঝতে পারিনা। মনে মনে যায়গাটা থেকে নিঃশব্দে সরে পড়ার রাস্তা খুঁজতে থাকি। একবার ভাবি, চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করি। কিন্তু পার্কে যারা আছে, তারা সবাই বেশ দূরে।
ওরা আসতে আসতে খুনিটা আমাকে সাবাড় করে দিতে পারে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। পার্কের এদিকটায় কোন লোক এলে তখন সুযোগটা নিতে হবে।
আসছে, আসছে! একজন বৃদ্ধা মহিলা একটা বারো/চৌদ্দ বছরের ছেলের হাত ধরে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এদিকে এগিয়ে আসছে। হোকনা বৃদ্ধা আর কিশোর - আমি ডুবন্ত মানুষের মতো খড় কুটার আশ্রয়ে আশায় বুক বাঁধি।
এসে গেছে! এসে গেছে! তারা আমার হাত দশেক দূরে এসে থামে। ওরা দারুণ ঔৎসুক্য নিয়ে আমাদের বসে থাকা ডুমুর গাছটার কাণ্ডটার দিকে তাকায়। কিশোর আঙ্গুল তুলে কিছু দেখায়। ওরা আরো এগিয়ে আশে। আমি ভাবি, চিৎকার দেবার এটাই সুযোগ।
ইজ ইট ইউ বব? আমি চিৎকার দেবার আগেই গাছের কাণ্ডকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে করে উঠেন বৃদ্ধা।
ইয়েস মামি, বলে খুনিটা আড়াল থেকে মাথা নিচু করে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিশালদেহী একটা লোক। বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মতো।
ইউ আর হাইডিং হিয়ার এন্ড আই এম লুকিং ফর ইউ এভরি হয়ার।
আপন মনে গজ গজ করতে থাকেন বৃদ্ধা। কেন সে মাকে না জানিয়ে বাড়ীর বাইরে এলো? ওকে বিকেল থেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধা। ওর একা বাইরে আসা ঠিক হয়নি। মা খুব কষ্ট পেয়েছেন। ওর বিড়াল মিকি ওকে না দেখে দুপুর থেকে কিছুই খাচ্ছেনা।
গড় গড় করে বলে যেতে থাকেন বৃদ্ধা।
আই এম সরি মাম। বৃদ্ধাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেলে লোকটা।
মা ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আমি ভয় আর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাই।
পরনে কার্গো প্যান্ট। খালি গা। মাথা ক্লিন শেভড। গলায় সাদা-লাল রঙের একটা স্কার্ফ জড়ানো। হাতের দিকে তাকাই।
না, ওর হাতে কিছুই নেই।
সেই শূন্য হাতটা কানের কাছে লাগিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে লোকটা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।