আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস এবং মিয়ানমারের আরাকানে মুসলিম নির্যাতনের অজানা কাহিনী (৬)

হিজরী প্রথম শতকের শেষ দিকে (৯৬ হিজরী) ৭১২ ঈসায়ীতে উমাইয়া শাসনামলে মুসলিম সেনাপতি হযরত মুহম্মদ বিন কাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নেতৃত্বে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হবার মধ্যদিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও মূলত পবিত্র মক্কা শরীফ বিজয়কালে অর্থাৎ ৮ম হিজরীতে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানাতেই এ অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। কারণ চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার পর চীনের রাজা তাঁইসাং বা তাইসং ইসলাম গ্রহণ করার জন্য লোক পাঠালে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আবু কাবশা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকেসহ এক কাফেলা পাঠান। তখনকার দিনে চীনের ক্যান্টনে যাওয়ার জন্য আরবদেশ থেকে রওনা করলে পথিমধ্যে ভারতের মালাবার, কালিকট, চেররবন্দর, তৎকালীন আরাকানের চট্টগ্রাম ও আকিয়াব প্রভৃতি স্থানে জাহাজ নোঙ্গর করতো এবং বাতাসের গতিবেগের কারণে বিভিন্ন বন্দরে অনেকদিন যাবৎ অবস্থান করতে হতো। এভাবে যাত্রাকালীন সময়ে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ বিভিন্ন বন্দরে ইসলাম প্রচারের কাজ করতেন। এ ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম ও আকিয়াবেও জাহাজ নোঙ্গর করে উনারা ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন।

তখন থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশেষত মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। এ আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোখাম’। এটি আরবী শব্দ; যার অর্থ শ্বেতপাথর এবং আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ের পূর্বনাম কায়কপ্রু। এটি বার্মিজ শব্দ; যার অর্থও শ্বেতপাথর। এদিক থেকে কায়াকপ্রু অঞ্চল ও রোখাম একই অঞ্চল হেতু রুহমী বলতে রোখাম বা আরাকানকেই বুঝানো হয়।

আরাকানের চন্দ্র-সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎ ইঙ্গ চন্দ্র (৭৮৮-৮১০ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমানদের আচার-আচরণ ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে সেখানে ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ দেন এবং সাথে সাথে রাজা মুসলমানদের স্থায়ীভাবে বসবাসেরও অনুমতি দেন। তাছাড়া আরবে ইসলাম কায়েমের পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শতাব্দীতে আরব, ইরানী, গৌড়ীয়, ভারতীয়সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম বণিক, নাবিক, ইসলাম প্রচারকগণ আরাকানে এসে এখানকার স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতেন। এভাবে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এরাই বর্তমান আরাকানী মুসলমান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত এ আরাকান রাজ্যে মিয়ানমারের মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধ সামরিক জান্তা সরকার এখানকার “রোহাংঙ্গ” এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত তাদের উপর অহরহ কঠোর ও নির্মমভাবে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

যা বিশ্ববাসীর জানা সম্ভব হয়না। তাদের মৌলিক অধিকার বলতে কিছু নেই। মুসলিম দেশগুলোও এ ভয়াবহ নির্যাতনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। অথচ মিয়ানমারের ‘কারেন’ বিদ্রোহীরা খ্রিস্টান হওয়ায় পশ্চিমা খ্রিস্টান দেশগুলো যালিম সামরিক জান্তা সরকারকে প্রায় একঘরে করে রেখেছে এবং গত ১২ই জানুয়ারি তারিখে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে। এর আগে গত ডিসেম্বরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শান রাজ্যে লড়াইরত আরেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী শান স্টেট আর্মি-সাউথের সাথে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

কিন্তু আরাকানী রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে কোন ধরনের চুক্তি তো দূরের কথা বরং তাদের নাগরিকত্ব বাতিলসহ দেশ থেকে বহিষ্কার অব্যাহত রেখেছে। উল্লেখ্য, রাখাইন প্রদেশ ঐতিহাসিকভাবে আরাকান নামে পরিচিত। স্বাধীন মুসলিম দেশ আরাকান ১৭৮৪ সালে তৎকালীন বার্মা দখল করে নেয়। আর ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর থেকে আরাকান রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে বিতাড়নের জন্য এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেয়। মুসলিম বিদ্বেষী বৌদ্ধ সামরিক জান্তা সরকার আরাকানের মুসলমানদের উপর বহুমুখী নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করে থাকে।

তন্মধ্যে সেখানে যখন তখন যে কাউকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নির্যাতন, বিনা মজুরিতে শ্রম খাটানো, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বিধি নিষেধ আরোপ, মুসলিম পল্লি তুলে দিয়ে সেখানে রাখাইন বুদ্ধ বসতি স্থাপন, বিবাহ বন্ধনে বাধা, যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ, নির্বিচারে শহীদ, গণগ্রেফতার, জায়গা জমি ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণ, মহিলাদের শ্লীলতাহানি, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও মুসলমানদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে অ-স্বীকৃতি, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রোহিঙ্গা তরুণীরা ভয়াবহ সম্ভ্রমহরণের শিকার, চলছে বাধ্যতামূলক শ্রম মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বর হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সরকারি মদদে সেখানকার নির্যাতন-হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়েছেন ভারতে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুরা। তারা ইরানের ইংরেজি ভাষার নিউজ চ্যানেল প্রেস টিভিকে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে। তারা জানান, "আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছি।

তরুণীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অকথ্য সম্ভ্রমহরণ চালাচ্ছে। তাদের অনেককে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানোর পর আবার ফেরত দিয়েছে যাতে আমরা এ অবমাননা নিয়ে চিরদিন বসবাস করি। " এ ছাড়া, বিবাহিত নারীদের ধরে অজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদের দিয়ে কয়েক সপ্তাহ এমনকি মাসব্যাপী জোর করে কাজ করানো হচ্ছে কিন্তু বিনিময়ে কোনো অর্থকড়ি দেয়া হচ্ছে না। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরে নিয়ে যাওয়া নারীদেরকে আর ফেরত দেয়া হচ্ছে না। " পশ্চিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানরা আরো জানিয়েছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে।

জম্মু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এক তরুণ জানান, "আমরা যতই লেখাপড়া করি না কেন মিয়ানমারের সরকারি চাকরিতে আমাদের কোনো স্থান নেই। শুধু আমরা কৃষি ক্ষেতে কাজ করতে পারি এবং কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর পর সরকার সেখান থেকে অর্ধেক ভাগ নিয়ে নেয়। শুধুমাত্র তাই নয় সরকার আমাদেরকে সেনাঘাঁটিতে জোর করে ধরে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করে। কিন্তু বিনিময়ে কোনো অর্থকড়ি দেয় না। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে পরক্ষণেই তাকে হত্যা করা হয়।

" মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে কয়েক শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বসবাস করলেও সরকার তাদেরকে ওই দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এসব মুসলমান বহুদিন ধরে সেখানকার মগ ও বার্মিজ জাতিগোষ্ঠীর হাতে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। সম্প্রতি, এ নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর গণহত্যা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট থিন সেইন বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমার ছেড়ে চলে গেলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হবে। মিয়ানমারে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন রোহিঙ্গা মুসলমানেরা, জুমুয়ার নামাজ নিষিদ্ধ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আহত ও অসুস্থ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভর্তি করা হচ্ছে না বলে খবর পাওয়া গেছে।

গত ২৮ জুলাই শনিবার রাখাইন প্রদেশের মংডু হাসপাতালের গেটে চিকিৎসার অভাবে দু’জন প্রসূতি মহিলা মারা গেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা মুসলমান রেডিও তেহরানকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গত জুন মাসে মুসলিমবিরোধী গণহত্যা শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী ও পুলিশ জুমুয়ার নামাজ নিষিদ্ধ করে। কয়েক দিন পর মসজিদে রাতে নামাজ পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। গত মাসের শেষের দিকে নাসাকার কর্মকর্তারা অন্তত ৪০০টি মসজিদে তালা লাগিয়ে দিয়েছে বলে ওই রোহিঙ্গা মুসলমান জানান। বর্তমানে মুসলমানেরা আর মসজিদেই যেতে পারছেন না।

নাসাকা বাহিনী সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কাউকে মসজিদের আশপাশে দেখা গেলে সাত বছরের কারাদ- দেয়া হবে। এ দিকে কথিত জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই শেষ পর্যন্ত অভিযোগ করেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষা করার পরিবর্তে তাদের উপর দমন অভিযান চালাচ্ছে। সে মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানায়। নাভি পিল্লাই এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘বিভিন্ন নিরপেক্ষ সূত্র থেকে আমাদের কাছে স্রোতের মতো খবর আসছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী মুসলমানদের সাথে চরম বৈষম্যমূলক ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছে; এমনকি তারা মুসলিম নিধনেও অংশ নিচ্ছে। ’ জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান বলে, মিয়ানমার সরকার দাঙ্গা বন্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালিয়েছে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে) ১ম পর্ব এখান থেকে পরতে পারেন ২য় পর্ব এখান থেকে পরতে পারেন ৩য় পর্ব এখান থেকে পরতে পারেন ৪র্থ পর্ব এখান থেকে পরতে পারেন ৫ম পর্ব এখান থেকে পরতে পারেন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.