আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষ নয়, রোহিঙ্গা

গভীর রাতে বৃষ্টি নেমেছে। গরমে অতিষ্ঠ হওয়া মানুষের দেহে বয়ে যাচ্ছে শীতল পরশ আর বৃষ্টির মধুর ঝাপটা। ঘুম গাঢ় হয়ে উঠেছে কারো কারো। এমনই সময় নাফ নদীর ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী একটা ট্রলারে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা আর বাতাসের তীব্র ঝাপটা ভিজিয়ে দিচ্ছিলো বিশাল এ আকাশের নীচে অসহায় কিছু অচ্ছুত মানুষকে। উবু হয়ে বসা মা তার আর কিছু না পেয়ে নিজের দেহটা দিয়েই আড়াল করে রেখেছিলো তার শিশুটিকে।

আমাদের আর দশটা আহ্লাদী বাচ্চার মতো এ শিশুটি নয়, জন্মের পর থেকেই অভুক্ত থাকা আর পশুদের মতো বসবাসের সাথেই তার সখ্যতা। তবে নাফ নদীতে কয়েকদিনের ফেরারী সময়ে খাবারের অভাব তার কঠিন হয়ে যাওয়া পাকস্থলিও আর সইতে পারছিলনা। তীব্র বৃষ্টির ভেতরও মা'র কোলে লুকিয়ে সে বলে উঠলো, "ও মা, একটুখানি খাওয়া দে"। পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মায়ের চোখ থেকে বেয়ে পড়া অশ্রু বৃষ্টির পানিতে কেবল একটু লবনাক্ততা যোগ করতে পেরেছিল মাত্র। নাফের এপারে নাসাকা বাহিনী, নাফের ভেতর মায়ানমার নৌবাহিনী আর এপারে বাংলাদেশের কোস্টগার্ড আর বিজিবি তাড়া করে ফিরছিল রোহিঙ্গা নামের নিকৃষ্ট একদল মানব গোষ্ঠীকে।

এই পৃথিবীর বুকে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে নিগৃহীত আর অসহায় এক জাতির ডায়েরীতে যোগ হচ্ছিলো নতুন প্রবঞ্চনার ইতিহাস। স্বাভাবিক পৃথিবীর কাছে মিয়ানমার এমনিতেই এক রহস্যময়তার নাম। দেশটির রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বা সামাজিক কোন কিছুর খবরই বাকী বিশ্ব ঠিকভাবে কখনও জানেনি। অর্ধেকেরও বেশী বনভূমি আবৃত বিশাল এই দেশের এক কোনায় আরাকান নামের একটা প্রদেশ আছে যার ভেতর জাতিগতভাবে মুসলিম রোহিঙ্গা নামধারী এ জনগোষ্ঠীর বাস। রহস্যময় সে দেশের সবচেয়ে সিক্রেট ইস্যু হলো রোহিঙ্গা মুসলিমদের খবর।

প্রতিনিয়ত মৃত্যু আর ধর্ষণের শংকা মাথায় নিয়ে ঘোরা এ জাতির প্রকৃত অত্যাচারিত হবার ইতিহাস বোধহয় তাদের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউই জানেনা। যতটুকু জানা গেছে তাতেই সুস্থ্য মানুষের বিবেকে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট। মিয়ানমারে এ রোহিঙ্গাদের কোন নাগরিকত্ব নেই। তাদের কোন ভোটাধিকার নেই, সমগ্র মিয়ানমার তো দূরের কথা, নিজেদের প্রদেশেই তাদের কোন শিক্ষার অধিকার নেই। আরাকান বা রাখাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশ নিষিদ্ধ।

এদের কোন লাইব্রেরী নেই, প্রায় সকল মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এদের পুরুষদের জোর করে রাষ্ট্রীয় খাতে বিনা বেতনে শ্রমিক হিসাবে কাজ করানো হয়। গবাদী পশু পালন করে, সামান্য জমিতে কৃষিকাজ করে অথবা বনে বাদাড়ে ঘুরে এটা সেটা কুড়িয়ে বিক্রি করে বা বন থেকেই কুড়িয়েই কিছু খেয়ে তাদের দিন কেটে যায়। এদের ভ্রমনের উপর কঠোর নজরদারী আর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে হয়েছে। অত্যন্ত সীমিত করে দেয়া হয়েছে এদের চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধাকে।

বড় কোন হাসপাতালে জটিল রোগের চিকিৎসা পাবার কোন অধিকার এদের নেই। মিয়ানমার সরকার তাদের নিজেদের ভেতর বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বলে আমি আগে শুনেছিলাম, তবে বিশ্বাস করিনি। এখন জানলাম এ খবর সত্য। শুধু তাই নয়, সন্তান ধারণের ব্যাপারেও এদের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। এদের নারীদের করুণ অবস্থা বোধ করি আইয়ামে জাহিলিয়াকেও হার মানায়।

শ্লীলতাহানী আর ধর্ষণ এদের কাছে আজ আর কোন মানবাধিকার হরণের নাম নয়। দাসপ্রথা পৃথিবী থেকে উঠে গেছে, তবে এরা হলো এমন এক জাতি, যারা দাসপ্রথা থাকলে বিনা বাক্য ব্যয়ে তাতেই সম্মত হতো, দু মুঠো খাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য। মায়ানমারের ১৩৫ টি জাতি গোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক, সহযোগী নাগরিক এবং ন্যাচারালাইজিড নাগরিক নামে তিন ক্যাটাগরির নাগরিকত্ব কার্ড দেয়া হয়েছে, তার ভেতর অচ্ছুত এ রোহিঙ্গারা স্বভাবতঃই পড়েনি। আজ না তারা মায়ানমারের, না বাংলাদেশের, না মানব শাসিত এ পৃথিবীর কোথাকার নাগরিক। রোহিঙ্গা অত্যাচারের ইতিহাস একটু একটু করে বের হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের আশা ত্যাগ করে ভাগ্য বিড়ম্বিত একদল রোহিঙ্গা ২০০৮ সালে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয়ের সন্ধানে যায়। উপকূলে থাই সীমান্তরক্ষীরা রোহিঙ্গাদের ট্রলার থেকে ধরে চুড়ান্ত নির্যাতন করে নৌকার ইঞ্জিন কেটে দিয়ে, খাবার ফেলে দিয়ে মাঝ সমূদ্রে ভাসিয়ে দেয়। ধারণা করা হয় পাঁচটি নৌকার শুধুমাত্র একটি ভেসে থাকতে সক্ষম হয় আর যার কোন যাত্রী ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা আর কেউ কেউ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে উদ্ধার হয়। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে এ ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। 'থাই বোট অ্যাবিউস' নামে এ ঘটনা পরবর্তিতে প্রচার পায়।

পূর্বের আরাকান আর বর্তমান রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রতিক যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে কয়েকগুন উৎসাহে কচুকাটা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। আজকের প্রথম আলোতে (১৪ই জুন, '১২) একজন বিদেশী সাংবাদিকের অনুদিত কলামে এসেছে, রোহিঙ্গা মৃত মুসলিমের মাথা মুড়িয়ে, গায়ে গেরুয়া বসন পরিয়ে দিয়ে তাকে ভিক্ষু বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা যেসব শরনার্থী আছে তাদের অবস্থাও মানবেতর। এদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এসেছে। ক্যাম্পের খাবার সরবরাহ অনেক কমিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে নতুন রোহিঙ্গা আসতে উদবুদ্ধ না হয়।

তারপরও বাংলাদেশ বা থাইল্যান্ডে থাকা শরনার্থী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। পশুপালের খোয়াড়ের মত অকথ্য জীবন তাদের কাছে স্বর্গসম। অসহায় রোহিঙ্গাদের 'অবৈধ' অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আজ কথার ফুলঝুরি ছুটাচ্ছে এসি ঘরে বাস করা সুশীল সমাজ। ঘুরে ফিরে সৌদী আরবের বাংলাদেশী পরিচয়ের রোহিঙ্গাদের অপকর্মের কথা তারা জোর গলায় বলছে। দুঃখের বিষয়, সৌদী আরবে কিছুদিন আগে ঘটা এ ঘটনার আগেই সেদেশের প্রশাসন 'মিসকিন' নামে বাংলাদেশীদের তকমা দিয়ে ফেলেছে।

এমন নয় যে তাদের কাছে এদেশের ভালো কোন ইমেজ আগে ছিলো বা এখন আছে। আজ মানবতার এই বিপন্ন সময়ে সুশীল নামধারী সব লোকের কলম স্তব্ধ হয়ে গেছে। অচ্ছুত রোহিঙ্গারা তাদের কাছে মানবতার অংশ নয়। মনে পড়ছে ইসলামের ইতিহাসের কথা। রাসুলুল্লাহ সাঃ আর মক্কাবাসী সাহাবারা যখন অত্যাচারে টিকতে না পেরে মদীনায় এসেছিলো, তা ইতিহাসে 'হিজরত' বা মাইগ্রেশন নামে পরিচিত।

মক্কার অসহায় লোকগুলোকে মদীনার স্থানীয় মুসলিমগণ শুধু আশ্রয় দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, নিজেদের সম্পদ আর জায়গা জমিও ভাগ করে দিয়ে দিয়েছিলো। যুগে যুগে মুসলিম বা অমুসলিম যে কেউই বিপদে পড়ুক, মুসলিম সমাজ এভাবেই এগিয়ে এসেছে, আর এটা তাদের ঈমানের অংশও বটে। আজ বিপর্যস্ত রোহিঙ্গারা এদেশে কি মুহাজির হিসাবে আসেনি? আজ কি আমরা তাদের সামান্য আশ্রয়টুকুও দিতে পারবনা? আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, আমাদের জন্ম, পারিপার্শিকতা বা অবস্থার উপর কোন হাত আমাদের নেই। আল্লাহ যদি চাইতেন আমরাও রোহিঙ্গা একটি ঘরেই জন্ম নিতে পারতাম। শীতল বাতাসের নীচে না বসে আমরাও এখন ফেরারী নৌকায় মৃত্যুর প্রহর গুনে কাটিয়ে দিতে পারতাম।

যে বিপদে পড়ে রোহিঙ্গা ভাই-বোনগুলো প্রবঞ্চনা নিয়ে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সে বিপদে একদিন আমরাও পড়তে পারি। পৃথিবীতে আমাদের অনেক যাদুকরী যুক্তি খাকতে পারে, তবে আল্লাহর কাছে তাদের ব্যাপারে আমরা কিছুতেই ক্ষমা পেতে পারিনা। একটিমাত্র শব্দই আমাদের এ ভীষণ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, তা হলো আমাদের 'মৃত্যু'। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.