আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঁদছে সিলেট..কাঁদছে শিক্ষামন্ত্রী...সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক ছাত্রলীগের আগুনে ভষ্মিভূত।

চাচা চৌধুরীর মগজ কম্পুটারের চেয়েও প্রখর ছাত্রশিবির তাড়াতে ছাত্রলীগের ধরিয়ে দেওয়া আগুনে পুড়ে ভষ্মিভূত হয়ে গেলো সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক এমসি কলেজ ছাত্রাবাস। সবার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো ৯১ বছরের প্রাচীন ছাত্রাবাসের ৫টি ব্লক। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ছাত্রজীবনের স্মৃতিময় ভবনগুলোও ছাই হয়ে মিশে গেলো মাটিতে। ঐতিহ্যের স্মারক এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগে নেতৃত্বদানকারী সিলেট জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি পঙ্কজ পুরকায়স্থ বাংলানিউজকে জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই এ ছাত্রাবাসের অধিকাংশ সিট ছাত্রশিবিরের অধীনে ছিল। আগুন দিয়ে এমসি কলেজ শিবিরমুক্ত করেছেন তারা।

স্থাপত্যকলায় সংশ্লিষ্টদের মতে, সেমি পাক্কা আসাম টাইপ- এর এত বিশাল ভবন বিশ্বের কোথাও হয়তো এখন আর অবশিষ্ট নেই। উপযুক্তভাবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপিত হলে অনেক আগেই এ হোস্টেলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করতো ইউনেস্কো। অথচ, আগুনের লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে গেলো সিলেটবাসীর গর্বের এ ঐতিহ্য। আগুন দেয়ার পর ছাত্রলীগের বিজয় মিছিল নান্দনিক স্থাপত্যের সুবিশাল আয়তনের সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ কলেজের সাবেক ও বর্তমান হাজার হাজার ছাত্রের আবেগানুভূতি। দু’দিকে পাহাড়ঘেরা সুবিশাল আয়তনের এই ছাত্রাবাসে মনোরম দৃশ্য যে কারো নজর কাড়তো।

পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করতো এ ছাত্রাবাস। মন্ত্রী হওয়ার পরও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তার ছাত্রজীবনের স্মৃতি বিজড়িত এই ছাত্রাবাসের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। নানা অনুষ্ঠানেও তিনি এই ছাত্রাবাসের ঐহিত্যের কথা বলতেন। রোববার রাতে যখন ভবনগুলো আগুনে পুড়ছিল তখন শিক্ষামন্ত্রী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এর জন্য দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “প্রাচীন ও ঐহিত্যবাহী ভবন পোড়ানো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায়না।

” রাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় ছাত্রাবাস ঘুরে দেখা গেছে, সামনে সুবিশাল মাঠ। সবুজ গাছগাছালি আচ্ছাদিত প্রাকৃতিক সুনির্মল এরকম পরিবেশ শহর জীবনে বিরল। ৬টি ব্লকে ভাগ করা ছাত্রাবাস ভবনের প্রতিটি ব্লকের দৈর্ঘ্য কয়েক শ’ ফুট করে। এক ব্লক থেকে অন্য ব্লকের দূরত্বও অনেক। ৪র্থ ও ৫ম ব্লকের মাঝে ছাত্রদের গোসলের পুকুর।

ছায়া ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন হোস্টেল এদেশে তো নেই-ই, এই উপমহাদেশেও বিরল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিলেটের স্বনামখ্যাত শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তার পিতামহ মুরারী চাঁদের নামানুসারে ১৮৯২ সালে স্থাপন করেন মুরারী চাঁদ কলেজ। শুরুতে কয়েক বছর কলেজের ব্যয়ভার বহন করেন রাজা নিজেই। পরবর্তী প্রজন্মের সম্বল কেবল এই ছবিগুলো, গতকালও জিবন্ত হলগুলো আজ শুধু ছাই। এরপর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল মজিদ সিআইই’র প্রচেষ্টায় বৃটিশ সরকারের অর্থানুকূল্য পাওয়ায় কলেজটি ১৯২১ সালে স্থানান্তরিত হয় টিলাগড়ে অবস্থিত থ্যাকারে টিলায়।

এ সময়ে কলেজের জন্য একাধিক একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়। একই সময়ে কলেজের অদূরে নির্মিত হয় সুবিশাল এই হোস্টেল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- হোস্টেল ভবনের ভিন্নধর্মী স্থাপত্য শৈলী। কেবলই স্মৃতি প্রায় ২০ কেদার ভূমির উপর নির্মিত হোস্টেলের ভবন, এর অঙ্গ সজ্জা ও স্থাপত্য শৈলী যে কোন দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়তো। প্রতি বিকেলেই ছাত্রাবাস দেখতে ভিড় নামতো দর্শনার্থীদের।

স্থপতি ও নাট্যকার শাকুর মজিদ বাংলানিউজকে জানান, যে স্থাপত্য কলায় হোস্টেলের ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল তা এখন বিশ্বে বিরল। স্থাপত্যকলা বা আর্কিটেকচারের ভাষায় এ ভবনগুলোর নাম ‘সেমি পাক্কা আসাম টাইপ’। সিলেট অঞ্চল সে সময় ছিল আসামের অধীন। ব্যতিক্রমী স্থাপত্য শিল্পের এই সেমি পাক্কা আসাম টাইপ ভবনগুলো নির্মিত হতো টিন শেডে। কড়ি-বর্গা সব কিছু কাঠের।

টিন শেডের নীচে থাকে কাঠের বার্লিন। ভবনগুলোর সিমেন্টিং বা দেয়ালের পলেস্তরাও ব্যতিক্রমী। জানা গেছে, ভূমিকম্প প্রবণ হওয়ায় এ ধরনের হালকা ধাঁচের অথচ ভূমিকম্প সহিষ্ণু সেমি পাক্কা ভবন সিলেট অঞ্চলেই প্রথম নির্মাণ শুরু করে বৃটিশরা। পরে তা আসামের পাহাড়ি অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করে। পুরনো আমলের অসংখ্য বাংলো এই প্রযুক্তিতে তৈরি।

মূলত, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সংঘটিত ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের (যা সিলেট অঞ্চলে বড় বৈছাল নামে পরিচিত) পর থেকেই এই সেমি পাক্কা ভবন জনপ্রিয় হয়ে উঠে ভারত বর্ষের পাহাড়ি অঞ্চলে। এ কারণে সেমি পাক্কা আসাম টাইপ নামের ভবন স্থাপত্য কলায় নতুন একটি কনসেপ্ট বা ধারণার জন্ম দেয়। স্থাপত্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সিলেটে এ প্রযুক্তির ভবন নির্মাণ না হলেও এখনো আসাম ও বৃহত্তর সিলেটের কোন কোন স্থানে টিকে আছে সেমি পাক্কা আসাম টাইপ ভবন। তবে, সম্ভবত, বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বড় সেমি পাক্কা আসাম টাইপ স্থাপনাটি ছিলো সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস। স্থপতি শাকুর মজিদের মতে, এ টাইপের এত বিশাল ভবন উন্নত বিশ্বের কোন দেশে থাকলে ইউনেস্কো বহু আগেই এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করতো।

এমসি কলেজ হোস্টেলে অগ্নি সংযোগে ভবনগুলো পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় আক্ষেপ প্রকাশ করে স্থপতি শাকুর মজিদ বলেন, “সিলেটবাসীর কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো- তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ” সম্ভবত, বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বড় সেমি পাক্কা আসাম টাইপ স্থাপনাটি ছিলো সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস। শুধু স্থাপত্য মূল্য নয়, ঐতিহাসিক দিক দিয়েও এই এমসি কলেজ হোস্টেলের রয়েছে স্বতন্ত্র আভিজাত্য। অসংখ্য নামজাদা ও কীতির্মান ব্যক্তিত্ব যেমন এই হোস্টেলে থেকে অধ্যয়ন করেছেন, তেমনি অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পদধূলি পড়েছে এখানে। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সফরে এলে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ২১ কার্তিক একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন এমসি কলেজ হোস্টেলে।

সুত্র- বাংলানিউজ২৪  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।