আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেইসব দিনরাত্রি-১

আমি একা তুমি একা অথচ দুজন পাশাপাশি মাঝখানে যা তা হলো দাবার দান...... চেক দিও না মন্ত্রি যাবে ভালোবেসো না খেলায় হারবে...... প্রাগইতিহাসিক হাসেরা প্যাক প্যাক করছে আর রাজার বেটা ভাবছে তার গুনগান চলছে। সেই তরুন হাসকে নেউল সাপ আর চিল থেকে বাচিয়ে আমরা আজ রাজার বেটাকে খুশী রাখতে শিখে গেছি। হাস জল থেকে আলাদা করে দুধ তুলে নিচ্ছে আমরা অবাক হচ্ছি, আর বলছি দেখেছো এভাবে বাচতে হয়। হাস সারাদিন পানিতে ভিজে শুকনো গায়ে উঠে আসছে আমরা বলছি দেখেছো এভাবে থাকতে হয়। আমার সোনার বাংলায় এভাবে থাকতে হয়, দেখবে, শুনবে বুঝবে, গায়ে মাখাবে না।

গায়ে মাখালেই তুমি আর হাস হলে না। রাজার বেটা আর তোমার কথা শুনবে না। রাজার বেটা হয়ে যাবে বাজপাখী, তুমি, আমি, আমরা বাজপাখী থামানোর মন্ত্র জানি না। তবে বাজপাখী খুশী রাখতে জানি। নিজের পিঠ বাচিয়ে অন্য পিঠ দেখিয়ে দিয়ে আমরা রাজার বেটাকে খুশী করে ফেলি।

রাজার বেটার আমাদের কথা শুনা খুব জরুরী, হাত কাচুমুচু করে হোক, মুখ একটু লাল করে লজ্বা নিয়ে হোক। রাজার বেটার গুনগান করতে হবে অবিরত। আমাদের হাস হয়ে থাকতে হবে অবিরত। কঠিন জিনিষ নিয়া কচলানো শেষ। আমি ছোট কইলজার মানুষ কঠিন জিনিষ এ কামড় দেই খাই না।

আহারে পিতলের কলসী কথা বলিস না। কথা বলিস নারে কলসী কথা বলিস না, প্রতি সপ্তাহের সোমবার অথবা মঙ্গলবার আমাদের শরীকী বাড়ীর উঠোনে এসে পিতলের কলসী কাধে নিয়ে নাচতে নাচতে যিনি এই গানটা গাইতেন তিনি একজন প্রাগইতিহাসিক ভিক্ষুক। বেটে, চিকন মেদবুড়ি হীন একজন নিস্ব মানুষ। যার সম্বল ওই পিতলের কলস আর গলার ওই একটাই গান। সবাই জড়ো হয়ে ওই একটাই গান শুনতো ওই একটাই নাচ দেখতো্।

একবার শেষ হয়ে গেলে আবার আবার আবার না কোন অনুরুধ নয় চাল হাতের পটে করে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে অর্ডার দেয়া হতো। লোকটা ব্যস্ত হতো ক্লান্ত হতো এবং নেচে যেতো। আজকে এতো বছর পরে আজ আর তার চেহারা আমার মনে পড়ে না, তবে সেই কলস বাজিয়ে গাওয়া গানটা কানে বাজে। অবিরত বাজে মাঝে মাঝে, মনে হয় আমিও বাজাই আর বলি, আহারে পিতলের কলস কথা বলিস না। কথা বলিস না যে মানুষটা শ্রদ্ধার সহিত ভিক্ষা করতো আর আমাদের ফু দিতো সেই মানুষ টার নাম মনে আছে।

আদৌ জানি না সেই মানুষের নাম কি সত্যি সত্যি এটাই ছিলো কিনা। মদই ফীর সাদা একটা ময়লা পাঞ্জাবী পড়ে তিনি যখন সন্ধ্যা সন্ধ্যায় আমাদের উঠোনে দাড়াতেন তখন আমাদের কাজ ছিলো তার সামনে ভীর করে তার ফু শরীরে মাখিয়ে নেয়া। সারাদিন খুট খুট করে মানুষটা সুপোরী চিবুতেন তাই ফু এর সাথে লাল লাল সুপোরী গুড়ো আমাদের নাকে মুখে চোখে পড়তো, যার গায়ে যত বেশী গুড়ো জমা হলো তার জন্য তত বেশী মুশকিল আছান ফু কাজ করবে। এই অদম্য বিশ্বাস নিয়ে কোন দিন দুই তিনবার তাকে ফু দেয়ার কাজ সমধা করতে হতো। একবার আমাদের এলাকার মোকামের বাক্স চুরী করতে গিয়ে সেই ফীর ধরা পড়ে গেলেন এবং তিনি পারালাইজড হয়ে গেলেন আর তার মুশকিল আছান ফু কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

বদিরা কিছু দেন গো বদিরা, আফনেরা কিছু দিলে আমি খাইবো আমার বউ এ খাইবো বউ এর বাচ্ছারা খাইবো। উঠোনএর এক কোনে বসে মৃগী রোগী এই ভিক্ষুক অবিরত এই লাইন কয়টা বলে যেতো। আর সবাই তার কথায় হাসতো বিশেষ করে যখন সে বলতো, বউ খাইলে বউ এর বাচ্ছারা খাইবো। সেই কথার অর্থ বুঝার বয়স তখন আমাদের হয়নি। আমরাও না বুঝে হাসতাম আর তাকে কিছু দিয়ে বিদায় করে দিতাম, সে হেটে যেতে যেতে একই কথা বলতো, আমি খাইবো আমার বউ এ খাইবো বউ এর বাচ্ছারা খাইবো।

বদিরা কিছু দেন গো বদিরা। ভিলহুকের নাম হয়ে গেলো বদিরা ভিক্ষুক। তিনি আসতেন যখন সন্ধ্যা হতো ভোরের মতন আলো নিয়ে। এবং তিনি প্ররিশ্রান্ত, ক্লান্ত হয়ে বসতেন উঠোনের ঠিক মধ্যখানে, যেখানে বসলে সকলের চোখে আসবে তিনি এসেছেন। তার সাদা লম্বা দাড়ী এবং তার সাদা ময়লা লম্বা পাঞ্জাবী কাধে একটা ভারী ব্যাগ যাতে আছে সারাদিন এর সঞ্চয়।

আমরা বাচ্ছারা যখন জেনে যেতাম তিনি এসে গেছেন তখন যার যার পটে তার জন্য চাল নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম। আর শুরু হয়ে যেতো এবার কেচ্ছা বলো। তিনি আমাদের একটাই কেচ্ছা বলতেন কারন তার অন্য সঞ্চয় এর মতো তার ওই একটাই কেচ্ছা সম্বল ছিলো। আমরাও শুধু ওই একটাই কেচ্ছা শুনার জন্য অপেক্ষা করতাম। গোল হয়ে হেসে হেসে মাঠিতে লুঠিয়ে পড়ে ওই একটাই কেচ্ছা কয়দিন পর পর শুনে যেতাম।

এবং তিনি ক্লান্ত প্ররিশ্রান্ত সামান্য সেই চালের জন্য আমাদের সেই একই কেচ্ছা বলে যেতেন। সেই কেচ্ছা আবার সুর করে বলা হত পুতি পড়ার মতো করে। আমরা মুখস্ত করতাম যতটুকু বুঝা যেতো ততটুকু, কিন্তু কারো কাছে পরীক্ষা দিতে হতো না বলে আবার ভুলে যেতাম। তিনিও আমার মনে থেকে যাওয়া প্রাগইতিহাসিক ভিক্ষুক দের একজন। আমার ভিক্ষুক কথন সমাপ্ত করে দিলাম।

কারন উনাদের কাউকেই আমরা সেই সন্মান দেই না মানুষ হিসেবে যা তাদের প্রাপ্য। মনে হলো এই লেখারও কোন অর্থ থাকে না। যদিবা কোনদিন না মানি, না করি। এই লেখার অন্য একটা কারন, সেটা হলো, যখন লন্ডন এলাম অখানাকার ভিক্ষুকদের দেখলাম, তখন আমার সেই কথাই মনে হলো আমাদের তারাও তো কিছুর বিনিময়ে কিছু চেয়েছে। হয়তো যতসামান্য পেয়েছে, কিন্তু মানুষ হিসেবে এই দুনিয়ায় সন্মান!! সেটা কখনই দেখে নি।

হয়তো মাঝে মাঝে পশুদের থেকে নিজেদের আলাদা করতে পেরেছে অথবা পারেনি, মানুষ মনে হয় হয়ে ঊঠেনি কখনই। ভিক্ষুক থেকে চলে গেছে জগত থেকে। চলবে... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।