আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'দেয়াল’-এর শানে নুযুল, উপন্যাসের ডানা ও ইতিহাসের সত্যস্তম্ভ

'দেয়াল’-এর শানে নুযুল, উপন্যাসের ডানা ও ইতিহাসের সত্যস্তম্ভ ফকির ইলিয়াস =========================================== হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘দেয়াল’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকে দুইপর্ব ছাপা হওয়ার পরই বিভিন্ন ব্লগে তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এখন তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ‘দেয়াল’ সংশোধন করে প্রকাশ হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন হাইকোর্ট। আদালত এ বিষয়ে লেখক হুমায়ূনকে সঠিক ইতিহাস কেন সরবরাহ করা হবে না মর্মে শিক্ষা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সচিবের প্রতি রুল জারি করেছেন।

বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশটি দেন। সংবাদপত্রে আগাম প্রকাশিত ওই উপন্যাসের দুটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের হত্যাদৃশ্যের যে বিবরণ দেয়া হয়েছেÑ তাতে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। আমরা জানি, কোনো গল্প কিংবা উপন্যাসের ঘটনা কল্পনাপ্রসূত হয়। কোনো উপন্যাস যদি সত্য, ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লেখা হয় তাহলে প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা জরুরি হয়ে পড়ে। এমন অনেক উপন্যাস রয়েছে বাংলা সাহিত্যে।

বিশ্বসাহিত্যে লেখা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ এই ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি লিখতে কেন অনুপ্রাণিত হলেন তার শানে নুযুল বিষয়ে কিছু বলা দরকার। হুমায়ূন আহমেদ কয়েক মাস আগে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে আসেন। এর কদিন পর জাতিসংঘ সেশনে যোগ দিতে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আসেন। এ সময় শেখ হাসিনা, হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে তার বাসায় যান।

দশ হাজার ডলার ‘টোকেন সাহায্য’ও করেন প্রধানমন্ত্রী। বিষয়টি মিডিয়ায় দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ। এরপর শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্কের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে অবৈতনিক উপদেষ্টার পদ দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় প্রেসনোটে বলা হয়, রাষ্ট্র সম্মান দিয়েই হুমায়ূন আহমেদকে এই পদটি দিয়েছে। অবশ্য এই পদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা বিষয়ে বাড়তি কোনো সুবিধা পাওয়া যায় কিনা, তারও একটা প্রচেষ্টা থাকতে পারে বলে সে সময়ে কোনো কোনো সূত্র বলেছিল।

শেখ হাসিনা ও তার সরকারের এই বদান্যতার পর, হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে ঘোষণা দেন তিনি জাতির জনকের নির্মমতম হত্যাকা- ও ১৫ আগস্টের ট্রাজেডি নিয়ে একটি ‘বড় উপন্যাস’ লিখবেন। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর হিসেবে আসে। এরপরই হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে থেকেই, বর্তমান সরকারের ‘ভালোবাসার’ ঋণ শোধ করতে গিয়েই এই ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি লেখার কাজে হাত দেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের আরেকজন অবৈতনিক উপদেষ্টা ছিলেন কিংবা আছেন ড. মনসুর খান। যিনি নিউইয়র্কে একটি প্রাইভেট টিউটরিয়ালÑ ‘খানস টিউটরিয়াল’-এর মালিক।

অত্যন্ত উচ্চমূল্যে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানো হয়। যা একান্তই বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জনের একটি প্রতিষ্ঠান। কথিত আছে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক মনসুর খানের স্ত্রী মিসেস নাঈমা খান, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ার সুবাদে মনসুর খান ২০১২ সালের একুশে পদক (শিক্ষা) লাভ করেন। এই রাষ্ট্রীয় উপঢৌকন আমেরিকায় অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। হুমায়ূন আহমেদ নিজে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে থেকেই ‘দেয়াল’ লেখায় হাত দেন।

ধারণা করা যায় তার এই উপন্যাস লেখার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক, বর্তমান সরকারকে খুশি করা। দুই, বই বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণ মুনাফা লুটা । তাই নিউইয়র্কে থেকেই যেসব ডাটা, উপাত্ত কিংবা রেফারেন্স তিনি পেয়েছেন, সেগুলোই ব্যবহার করে কাজটি সহজভাবে করতে চেয়েছেন। ফলে উপাত্তের যাচাই-বাছাই তার খুব একটা করা হয়নি।

হ্যাঁ, একটি উপন্যাস পড়ে প্রজন্ম অনেক সত্য জানবে, সেটাই বিশ্ব সাহিত্যের নজির আমাদের শেখায়। হুমায়ূন আহমেদ সেই সময় বিনিয়োগ না করে ‘শর্ট কাট’ চেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই সাহিত্যিক, যিনি বাংলাদেশে সবসময় মিলেমিশে থাকতে চেয়েছেন রাজাকারদের সঙ্গে। তিনি জানেন, তার পিতা ফয়জুর রহমান হত্যাকান্ডে সাঈদীর ইন্ধন ছিল। হুমায়ূন বাংলাদেশে সাঈদীর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেননি।

তিনি আদালতে যাননি এই সাঈদীর রিরুদ্ধে। অথচ আমরা দেখছি দেশের বরেণ্য লেখক, বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান এই বয়সে এসেও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আদালতে গিয়েছেন রাজাকার সাকার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে। আমরা বিভিন্ন মিডিয়া থেকে জেনেছি, হুমায়ূন আহমেদের বাবা পিরোজপুরের মহকুমা এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যার সঙ্গে সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন শহীদের কন্যা সুফিয়া হায়দার ও ছেলে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। তারা জানান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সহায়তায় ফয়জুর রহমান আহমেদকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে এবং পরদিন তার বাড়িটি সম্পূর্ণ লুট করে নিয়ে যায় সাঈদী ও তার বাহিনী।

‘দেয়াল’ বিষয়ে ‘ইতিহাসের দায়মুক্তি’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন দেশের সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন- ‘১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে কিছু উর্দিধারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গে ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলে। তারপর দীর্ঘ দেড় যুগ গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়; স্বনামে, বেনামে চলে সামরিক শাসন। ১৯৭৫ সাল নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি নিজেদের মতো গল্প সাজিয়েছে, দীর্ঘদিন দেশের মানুষকে সেসব সাজানো গল্প শোনানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছে।

ফলে এই ঘটনাটির ট্র্যাজিক দিকটি চাপা পড়ে গেছে রাজনৈতিক বিতর্কে। হুমায়ূন আহমেদ রাজনীতির মানুষ নন। তিনি রাজনৈতিক বিতর্কে যাননি, সাজানো আখ্যানগুলোর অনেক দূরে রেখেছেন নিজের অবস্থান এবং শুধু মানবসত্যের প্রতি অবিচল থেকে ওই বিষণœ ইতিহাস থেকে রসদ নিয়ে দেয়াল উপন্যাসটি লিখেছেন। একাত্তর নিয়ে যেমন লিখেছিলেন এক মন ছুঁয়ে যাওয়া উপন্যাস, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, যা উপন্যাসের কাঠামোয় ইতিহাসের নানা উপাদানকে পরিবর্তন না করে, তাদের ওপর কল্পনার রং না চড়িয়ে উপকৃত করেছিলেন। দেয়াল উপন্যাসেও ইতিহাসের কাছে তেমনি বিশ্বস্ত থেকেছেন।

তার পরও দেয়াল কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। একে বড়জোর ইতিহাস-আশ্রিত বলা যেতে পারে। এ উপন্যাসে ইতিহাস প্রধানত এর মানবিকতা-অমানবিকতার দ্বন্দ্বেই প্রকাশিত। পাত্রপাত্রী আছে, ঘটনা-উপঘটনা আছে। কিন্তু বাকিটুকু গল্প।

’ আমি সবিনয়ে প্রশ্ন করতে চাই, গল্প যদি ইতিহাসকে সত্যভাবে ধারণ না করে তাহলে প্রজন্ম সেখান থেকে কী জানতে পারবে? বর্ণচোরা খন্দকার মুশতাক, ঘাতক ফারুক কিংবা পাকিস্তান প্রীতিতে হুমায়ূন যে দরদ দেখিয়েছেন, প্রজন্ম তা মানতে রাজি নয়। আর নয় বলেই লাখো প্রতিবাদ উঠেছে। আবারো বলি, হুমায়ূন আহমেদ মুনাফার জন্য লিখেন। সাহিত্যের মান প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। এদেশ হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমদকেও জন্ম দিয়েছে।

তাঁরা বিত্তের পেছনে ছুটে বিবেক বিসর্জন দেননি। ‘দেয়াল’ বিষয়ে রাষ্ট্র ভাবিত বলেই আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদকে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। তবে আমরা এটা জানি রাষ্ট্র কোনো লেখককে চাপ দিয়ে লেখা আদায় করে না। করতে পারে না।

লেখার স্বাধীনতা অবশ্যই সমুন্নত থাকবে। তবে কোনো ধর্ম, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি, বর্ণের বিরুদ্ধে কিংবা হানাহানি ছড়াতে পারে এমন কোনো লেখাকে বিশ্বসংবিধান সম্মতি দেয় না- দিতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ রাজনীতি নির্ভর উপন্যাস লিখবেন না তা কেউ বলছে না। কিন্তু বাণিজ্যের জন্য, মুনাফা লাভের জন্য মিথ্যাশ্রিত, বানোয়াট, কল্পিত কথামালা গেঁথে প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করবেন, তা কোনো মানুষই মেনে নেবে না। ১৭ মে ২০১২ ------------------------------------------------------------------ দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২০ মে ২০১২ শনিবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।