আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমঝোতা

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমঝোতা ফকির ইলিয়াস ======================================= অতিসম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' নামের প্রতি যদি সরকারিদলের আপত্তি থাকে তবে 'অন্তর্বর্তীকালীন' কিংবা 'নিরপেক্ষ জাতীয় সরকার' এমন পদ্ধতির কথা ভাবা যেতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের অধীনে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' এই নামটি থেকে সরে আসাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও। তারা বলেছেন, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে।

এ জন্য প্রধান বিরোধীদলকে জাতীয় সংসদে আসা দরকার। প্রায় একই কথা বলেছেন চৌদ্দ দলের নেতারাও। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির জন্য আন্দোলন করছেন না। তিনি মূলত আন্দোলন করছেন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য। একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী নির্বাচনে জিতে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসত তবে, তারাও এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিত।

দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেরই সামন্তবাদী মানসিকতা এক এবং অভিন্ন। কারণ তারা চায়, অনুকূল সিদ্ধান্তগুলো নিজেদের সময়েই হোক। এই মানসিকতাই বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রধান অন্তরায়। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কা এখন অনেকেই করছেন। বিদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশও করেছেন।

আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে এবং সে নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধীদল বানানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা বিএনপি মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের অধীনে নির্বাচন করতে চায় তবে তা হবে তাদের মহাভুল। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার পর রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, এ নব্বই দিন কারা দেশ পরিচালনা করবেন তার একটি ঐকমত্যের রূপরেখা প্রণয়ন তাই খুবই জরুরি বিষয়। বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, কোন সরকারের অধীনে তার নির্বাচন কমিশন দ্বারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বিষয়টি তার নিজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারত।

অষ্টম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার পর তার দল বিএনপি এবং তার মিত্র জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা নিজেদের প্রতিপত্তি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তারা তাদের নিজেদের লোকদের নির্বাচন কমিশনে বসানোর সর্বশেষ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদেরই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করেছিলেন। ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা অনেকটা অন্ধ হয়েই নিজেদের ভুলভ্রান্তিকে হালাল করতে চান অবলীলায়। নিজেদের স্বার্থের মতবাদ চালিয়ে দিতে চান রাষ্ট্রের মানুষের উপর। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে।

সেই জরিপের ফলাফল, দেশ-বিদেশে আলোচনার বিষয় হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি একশ' সত্তরেরও বেশি আসন পাবে। আওয়ামী লীগ পেতে পারে সত্তরের মতো। জামায়াত চৌদ্দ আসন পেতে পারে। জাতীয় পার্টি চবি্বশ আসন পেতে পারে।

এই জরিপ কি ভবিষ্যৎ জানান দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে? আওয়ামী লীগের চরম ভরাডুবি হতে পারে এমন শঙ্কা নিয়ে সরকারিদলের নীতিনির্ধারকরা কী ভাবছেন? জরিপ অনুযায়ী তাদের জনপ্রিয়তায় এমন ধস নামার কারণ কী? একটি কথা বলে নেয়া দরকার, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা কমবে তা অনুমান করা যাচ্ছে খুব সহজেই। কিন্তু যদি তাদের চরম ভরাডুবি ঘটে তবে পরিস্থিতি কেমন হবে তাও সহজেই অনুমেয়। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়ে যাবে নিমিষেই। এই অভিযোগে অভিযুক্তরা শুধু মুক্তিই পাবে না তাদের অনুসারীরা দেশে তীব্র প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। দেশে চরম অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াসী হয়ে উঠতে পারে একটি চিহ্নিত মহল।

লুণ্ঠিত হতে পারে অনেক অর্জন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সে সুযোগ করে দিতে চাইলে তা দেশের জন্য চরম অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে। দেশের গণমানুষের দাবি পূরণে সরকার ব্যর্থ হলে বিরোধীপক্ষ সে সুযোগ তো পাবেই। দেশের জনগণ তো বটেই প্রাজ্ঞ রাজনীতিকরাও যে সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের অস্বচ্ছতাকে মেনে নিতে পারছেন না তার অনেক উদাহরণ আমরা প্রতিদিন দেখছি। সম্প্রতি সিলেটে, নারায়ণগঞ্জের সদ্য পাস করা মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর গণসংবর্ধনা হয়েছে।

সেই সংবর্ধনায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা, দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আবদুল হান্নান। তিনি বলেছেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এমন চরম ব্যর্থতার পর অর্থমন্ত্রীর উচিত পদত্যাগ করে মানুষের কাতারে এসে দাঁড়ানো। অর্থমন্ত্রী উপস্থিতিতে তার এমন পদত্যাগ দাবি শুনে মুখম-ল পানসে হয়ে গিয়েছে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর। বেশ ক'জন মন্ত্রী যে চরমভাবে ব্যর্থ, তা এই সময়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু পরিবর্তন নেই। মন্ত্রীদের কাউকেই বাদ দিতে চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী! কিন্তু এতে কি শেষ রক্ষা হবে? তা কি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হচ্ছে? আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু এখন ১২ মার্চ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন ওইদিন ঢাকায় কোন সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। আরও এক ধাপ এগিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকাগামী মানুষজনকে রাস্তায় আটকে দেয়া হবে। এমন হুমকি-ধমকি কোন সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিচয় বহন করছে না।

তা কোন মতেই মানা যায় না। মানার কথাও নয়। কারণ আজ যারা সরকারে, আগে তারাও বিরোধীদলে ছিলেন। আগামীতেও বিরোধীদলে যেতে পারেন। তাই পরমতসহিষ্ণুতা তারা লালন করছেন না কেন? খালেদা জিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন।

সংসদে এসে বিএনপি তা নিয়ে কথা বলতে পারে। এখানে যদি আওয়ামী লীগ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেশি দেখায়, তাও তো সংসদের কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ হবে। অতএব, সংসদে আসতে বিএনপি তো গড়িমসি করছে কেন? এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির পজিটিভ সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো দরকার। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশে গেল চারদশকে নির্বাচিত সরকার পদ্ধতি রাষ্ট্র এবং মানুষের কল্যাণে শতভাগ ব্রতী হতে পারেনি।

এর অন্যতম কারণ প্রধান দলগুলোর মধুলোভীদের লুটপাট এবং তাদের বাঁচানোর জন্য সিনিয়রদের কসরত। দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ কোন রাজনৈতিক দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আর রাষ্ট্রের জন্য তো নয়ই। তাই ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক ভাষা পরিহার করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়েই দেশের কল্যাণের কথা ভাবা দরকার। ভোটের রাজনীতি ক্ষমতা দিতে পারে।

নিতেও পারে। এই সত্যকে শ্রদ্ধা না করলে রাজনীতি থেকেই সরে দাঁড়ানো দরকার। সরকারের তিন বছর শেষ হয়েছে। বাকি দুটি বছর অর্থবহ করে তুলতে হলে, সরকারপক্ষকেই বেশি সহনশীল হতে হবে। নিউইয়র্ক, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ --------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.