কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! প্রফেসর মিরাজ একজন মহান মানুষ। মহান মানুষ এই কারণে যে, উনি কখনও কারও প্রশংসা গ্রহণ করেন না।
একবার আমি তাকে বললাম, স্যার, মানুষ তো বলাবলি করে, আপনি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ।
মিরাজ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনি জীবনের কোন কাজে ব্যর্থ হন নি।
তো?
পৃথিবীর বড় বড় গাণিতিক সমস্যা আপনি সমাধান করেছেন।
হ্যাঁ। তো?
পৃথিবীর প্রথম টাইম মেশিন আপনার বানানো।
সো হোয়াট?
আপনি টক্কর দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রোগ্রাম রেক্স ওয়ানের সাথে।
ডাজ দ্যাট ম্যাটার? রিয়েলি ম্যাটার? সালেহ, এটা তো তোমার দোষ।
তুমি খালি আমার সফলতার কথা লেখ তো, তাই লোকজনও মনে করে আমি কি না কি। আসলে কিন্তু আমি তোমাদের মতই সাধারণ মানুষ।
আমার জেদ চেপে গেল। বললাম, কিন্তু ঘটনা তো সত্যি। আপনি তো আসলেই কখনও ব্যর্থতার মুখ দেখেন নি।
মিরাজ বললেন, দেখেছি। ভয়ানক ব্যর্থতার মুখ দেখেছি আমি।
আমি বললাম, মানে?
আমি বিয়ে করেছিলাম এটা কি তুমি জানো?
জানি।
আমার বউ সতের বছরের এক পিচ্চি পোলার সাথে ভেগে গিয়েছিল জানো?
জানি।
কেন গিয়েছিল জানো?
না স্যার...আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, আমি আসলেই ব্যাপারটা জানি না।
কেন স্যার?
শুনবে? এটা কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ স্মৃতিগুলির একটি...শুনতে হয়তো ভালো লাগবে না।
না স্যার শুনব। একটু দাঁড়ান, ডিজিটাল রেকর্ডারটা নিয়ে আসি।
দৌড়ে গিয়ে রেকর্ডারটা নিয়ে এলাম আমি। বসলাম মিরাজের সামনে।
স্যার, বলুন।
মিরাজ বলতে শুরু করলেন। মিরাজের নিজের ভাষায় তার গল্পটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে দেয়া হল।
***
আমার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ। তোমার তখনও জন্মই হয় নি।
তখন আমি দেশেরই একটা ভার্সিটিতে লেকচারারের কাজ করি, আর অবসরে ভার্সিটির ল্যাবে গবেষণা করি। গবেষণা আর পড়ানো, এর বাইরে আমার কোন প্যাশন ছিল না।
আমার বউ ছিল অনেক বড়লোকের মেয়ে। আমরা বিয়ে করেছিলাম তখন থেকে দুই বছর আগে। ওর সাথে আমার বয়সের ডিসট্যান্স ছিল অনেক বেশী।
এই জিনিসটাই আবার খালি লোকের চোখে পড়ত।
বিয়ের আগে মেয়েদের সম্বন্ধে আমার কোন আইডিয়াই ছিল না। বিয়ের পরেও মেয়েদের নিয়ে আগে যে আঁধারে ছিলাম, সেই একই আঁধারে থেকে গেলাম। মেয়েদের মন কি রকম, কি তার গতিপ্রকৃতি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমার চেয়ে জুনিয়র একটা ছেলে তখন বিজ্ঞান সংস্থায় কাজ করত।
ওর নাম ছিল হাগামোতো প্রিশি। দারুণ ছেলে, চরম স্মার্ট আর ব্রিলিয়ান্ট। একটু লেডিকিলার টাইপ। আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল সে।
তো একদিন প্রিশি এসে অভিযোগের সুরে আমাকে বলল, মিরাজ ভাই, আমার গার্লফ্রেন্ড তো আমার কোন কথা শোনে না।
ওকে কন্ট্রোল করার জন্য কোন একটা যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারবেন? এই ধরেন, সেটার মাধ্যমে তাকে যা বলা হবে সে তা-ই শুনবে, মানে ধরেন একটা রিমোট কন্ট্রোল বানিয়ে দিলেন। ওখানে ধরেন দশ পনেরটা বোতাম থাকবে, ধরেন একটায় থাকবে “চুপ হয়ে যাও”, আরেকটায় থাকবে “বয়ফ্রেন্ডের কথা মেনে নাও”, আরেকটায় থাকবে “রান্না করতে যাও”...এরকম। পারবেন?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। গার্লফ্রেন্ড জিনিসটাই কেমন দুর্বোধ্য, তাকে আবার কন্ট্রোল এমনিতেও একটা অস্বাভাবিক বিষয়, আর সেটা যে পুঁচকে রিমোট দ্বারা ভবিষ্যতে সম্ভব হবে এটা মনে হয় খোদ আইনস্টাইনও কখনও কল্পনা করেন নি।
আমি বললাম, কি হয়েছে?
প্রিশি বলল, আর বলবেন না ভাই।
আমার বর্তমান গার্লফ্রেন্ড এমন ঘাড়তেড়ার ঘাড়তেড়া, ডানে যেতে বললে বায়ে যায়। বামে যেতে বললে ডানে যায়। একটা কথাও শোনে না, আর আমাকে গাধার মত খাটায়। ওর জন্য আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।
আমি মাথা চুলকে প্রিশির গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম।
হ্যাঁ, ঐ তো লম্বা করে কালো মেয়েটা...
আমি প্রশ্ন করলাম, ঐ যে লম্বা কালো মেয়েটা?
প্রিশি বলল, কোনটা? ও, আরে না। ও তো কত আগেই বাদ হয়ে গেছে।
তাহলে কি খাটো করে গোলগাল...
আরে নাহ! সে তো গেছে প্রায় মাস হয়ে গেল। আপনি দেখি রিসেন্ট খবর কিছুই জানেন না।
রিসেন্ট খবর কি?
এখন যে আছে ওর নাম কার্লা, মৃদু হেসে বলল প্রিশি, অসাধারণ সুন্দরী।
কিন্তু ঘাড়তেড়া। এমন ঘাড়তেড়া যে...নিজের হাতে নিজেই একটা ঘুষি দিল প্রিশি, আমার লাইফটা ছ্যাড়াব্যাড়া করে দিচ্ছে।
আমি সহানুভূতিশীল হয়ে চুকচুক জাতীয় একটা শব্দ করলাম। আমার বউটা এত খারাপ না, আবার এত ভালোও না। মাঝে মাঝেই ঝামেলা করে।
না না, প্রায় সময়ই ঝামেলা করে।
প্রিশি বলল, তাহলে তো আপনি বুঝতেই পারছেন আমার কষ্ট। দেখুন না খেয়ে আর টেনশনে আমার ওজনও কমে গেছে দশ পাউন্ড, বলে তার পেটের কাপড় উঁচু করে দেখাল প্রিশি।
প্লিজ মিরাজ ভাই, একটু বানিয়ে দেবেন যন্ত্রটা?
আমি ভাবলাম, এমনিই মেয়েমানুষ নিয়ে গবেষণা করতে হবে, তার উপর আবার তাকে কন্ট্রোল করার রিমোটও বানিয়ে দিতে হবে। এ তো দুনিয়ার সর্বকালের সেরা আবিষ্কর্তা স্বয়ং টমাস আলভা এডিসনও পারতেন না।
আর আমি তো কোথাকার কোন মাল্লু মিরাজ।
আমি বললাম, না ভাই, তোমার গার্লফ্রেন্ডের ঘাড় সোজা করার যন্ত্র বানানো আমার কম্ম নয়। সরি।
প্রিশি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, কত আশা নিয়ে আপনার কাছে আসলাম...আর আপনি বলছেন সরি...
আমি বললাম, তুমি তো এর আগেও অনেকের সাথে প্রেম করেছ। আবার ছেড়েও দিয়েছ।
এ যখন এতই ঝামেলা করছে, একেও ছেড়ে দাও।
প্রিশি লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল, ভাই এইটা “ট্রু লাভ” এইটাই আমার জীবন। এইটা ছাড়া আমি বাঁচব না। বিশ্বাস করেন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
আমার মনে পড়ল প্রিশি এই একই কথা আমাকে আমাদের পরিচয়ের পর গত তের বছর ধরে শুনিয়ে আসছে।
***
প্রিশি ছেলেটা আসলেই মানুষ পটাতে ওস্তাদ। এমনি কি আর মেয়েরা ওর পিছে পিছে ঘোরে? নাহলে আমি কি করে তাকে কথা দিয়ে ফেললাম যে, “যাও, তোমার গার্লফ্রেন্ড বশ করার যন্ত্র আমিই বানিয়ে দেব”?
যাহোক, আমি ভাই এক কথার মানুষ। বলেছি যখন, যন্ত্র বানিয়ে দিতে হবেই। কোন মাফ নাই।
কাজে লেগে পড়লাম। মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করলাম। তাদের সাইকোলজির উপর একগাদা বইও পড়ে ফেললাম।
দুঃখের ব্যাপার, মেয়েদের সাইকোলজি আমার মাথায় এক ছটাকও প্রবেশ করল না। বাউন্স খেয়ে বেরিয়ে গেল।
ব্রেইন ওয়েভের সাথে বাইরের কোন যন্ত্র থেকে উৎপন্ন সিগন্যালের সম্পর্ক বের করার ব্যাপারে কাজ শুরু করলাম আমি। বলা বাহুল্য, এক সময় ধরে ফেললাম জিনিসটা। প্রত্যেকটি কাজ করার সময় মস্তিষ্কে বিশেষ বিশেষ জায়গা উত্তেজিত হয়। সব উত্তেজনাগুলো মিলিয়ে তৈরি হয় একটা ব্রেইন ওয়েভ। বাইরে থেকে মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ জায়গাকে উত্তেজিত করে সেই ব্রেইন ওয়েভকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ব্যাপারটা বোঝার পর আমি যন্ত্রটা নির্মাণের কাজে হাত দিলাম। এবং, সফল হলাম।
ব্রেইন ওয়েভকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্রটা বানিয়ে আমি যখন হুররে বলে একটা চিৎকার দিলাম, তখন হঠাৎ মনে পড়ল যে আমি একটানা ছাব্বিশ ঘণ্টা নির্ঘুম। আনন্দটা একটু উদযাপন করার সামান্যতম শক্তিও তখন গায়ে ছিল না আমার। ঘুমিয়ে গেলাম সাথে সাথেই।
ঘুম ভাঙল তিন দিন পর। উঠেই প্রিশিকে ফোন দিলাম, প্রিশি, তোমার যন্ত্র রেডি।
প্রিশি ভাবল আমি ফাইজলামি করছি। ও বলল, তাই গো?
আমি বললাম, হ্যাঁ গো।
ও বলল, তাহলে একটু যন্ত্রের “নাচো” বোতামটায় চাপ দাও না গো।
একটু নেচে দেখাও না গো।
কি ফাজিল! সিনিয়রের সাথে ফাইজলামি! আজকে ওর...
সাঁই করে চলে গেলাম প্রিশির বাড়িতে। ও আমাকে দেখে ও তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারল না। আরে মিরাজ ভাই আমি তো ফাইজলামি করছিলাম...
তাতে কি? বললাম আমি, এখন খেতে দাও। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে।
আমি এমনিতেই বেশী খাই, প্রিশির ফ্রিজে রাখা খাবার দাবার দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। আধঘণ্টা ধরে শুধু খেলামই। গপাগপ টপাটপ।
খাওয়া শেষ করে বিশাল একটা ঢেঁকুর তুললাম আমি।
তারপর খেয়াল করলাম, প্রিশি চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কি হয়েছে?
কিছু না। ওর গোল চোখ গোলই রয়ে গেল। ওর চোখ আবার আগের শেপে আনার মাসলগুলো বোধহয় প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
আমি ওর হাতে আমার আবিষ্কৃত যন্ত্রটা তুলে দিলাম।
যন্ত্রটা দেখতে একটা টিভি রিমোটের মত, কিন্তু বোতামের উপর অন্য টিভি রিমোটের মত সংখ্যা নেই, অন্য কথা লেখা। যেমন, “চুপ হয়ে যাও”, “বয়ফ্রেন্ডের কথা মেনে নাও”, “রান্না করতে যাও”, “গোসল শেষ কর”, “বকবক বন্ধ কর” ইত্যাদি।
প্রিশি রিমোটটা হাতে নিয়ে বলল, কাজ হবে তো?
আমি বললাম, চেক তো করে দেখি নি।
প্রিশি বলল, ঠিক আছে, চেক করা লাগবে না। যেহেতু আপনি বানিয়েছেন, এটা কাজ করবেই।
আমি প্রিশিকে রিমোটটা কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝিয়ে দিলাম। বললাম, এই রিমোট চালু করলে সে তোমার কাছে যাকে কন্ট্রোল করবে, মানে তোমার গার্ল
ফ্রেন্ডের, ব্রেইনে এখন কি ওয়েভ চলছে এটা জানতে চাইবে। মানে তোমার গার্লফ্রেন্ড এখন তীব্রভাবে কি চিন্তা করছে সেটা জানতে চাইবে। তখন তুমি তাকে সেই তথ্যটি দেবে। তাহলেই যন্ত্র কাজ করবে।
প্রিশি বলল, যদি না বুঝি যে সে কি চিন্তা করছে?
আমি বললাম, বুঝতে হবে। গার্লফ্রেন্ড তোমার আর তুমি বুঝবে না তা কি করে হয়?
প্রিশি মাথা চুলকাল। গার্লফ্রেন্ড কি চিন্তা করছে এটা বের করা বোধহয় আসলেই কঠিন কাজ।
প্রিশির কাছে বিদায় নিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। আসার আগে বললাম, রিমোট কাজ করলে সাথে সাথে জানিয়ো।
না করলেও সাথে সাথে জানিয়ো।
ও বলল, আচ্ছা।
আমি চলে এলাম।
***
প্রিশি গভীর রাতে ফোন দিল। আমি অর্ধচেতন অবস্থায় ফোন ধরলাম।
কি হল?
ভাই, প্রিশির গলায় হতাশা, রিমোট একদম কাজ করছে না।
ক্যান? আমি যা করতে বলেছি করেছ?
হ্যাঁ করেছি...
তাও কাজ করছে না?
না...
ঠিক আছে আমি কালকে সকালে আসছি।
আচ্ছা। ফোনটা কেটে দেবার আগ মুহূর্তে প্রিশিকে ভয়ানক হতাশ মনে হচ্ছিল।
***
সকালে আমি ওর বাসায় গেলাম।
কি হয়েছে?
আমি জানি না, প্রিশি বলল, রাতে আমি রিমোট চালু করলাম, রিমোটকে আমার গার্লফ্রেন্ড কি চিন্তা করছে তা বললাম...
কিভাবে? তুমি কিভাবে জানলে তোমার গার্লফ্রেন্ড কি চিন্তা করছে?
প্রিশি লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেল। এ কথা আমায় জিজ্ঞেস করবেন না।
মানে?
সরি। আপনি আমার বড় ভাই, আপনার সামনে আমি ঐ কথা বলতে পারব না।
আমি রিমোটটা হাতে নিলাম।
দেখি সবই ঠিক আছে, শুধু “কাছে এসো” বোতামটা বসে গেছে।
এটার কি হয়েছে?
মিরাজ ভাই, একটু জোরে চাপতে গিয়ে বসে গেছে...
কয়বার চেপেছ তুমি?
এই ধরেন...পঞ্চাশ বার...আবার একটি লাজুক হাসি উপহার দিল প্রিশি।
আমি কপাল চাপড়ালাম। আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। প্রিশি তাহলে গার্লফ্রেন্ডকে এই জন্য কন্ট্রোল করতে চায়।
ভাগ্য ভালো, এই গ্রুপের অন্য কোন বোতাম দিতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। নাহলে...
***
বাসায় রিমোটটা পড়ে ছিল ঠিক দশ দিন। ভেবেছিলাম ওটাকে ঠিক করার কোন চেষ্টা করব না। কিন্তু মাঝখানে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে আমাকে রিমোটটা ঠিক করার কাজে হাত দিতেই হল।
আমি সারাদিন ল্যাব আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকি, এমনিতেই বউ এইজন্য আমার উপর মহাক্ষ্যাপা।
তার উপর এই কয়দিন রিমোটের পিছনে প্রচুর সময় নষ্ট করেছি দেখে বউ আমার উপর আরও ব্যাজার হয়েছে।
এইসব ঠিক করার অনেক রকম তরিকা আছে, কিন্তু পুরুষ হিসেবে আমি নিতান্তই নিরীহ মৃগশাবকের ন্যায়। তাই কোন তরিকাই প্রয়োগ করতে পারলাম না। বউ এই কয়েকদিনেই আমাদের মধ্যে দূরত্বের দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলল।
কিন্তু দশদিনের মাথায় আর পারলাম না।
শালা আমার বউ আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে, এটা কি মেনে নেয়া যায়? হলই বা আমার মাথায় টাক, হলই বা একটু বেশী খাই আমি, হলই বা ভুঁড়িটা একটু রাজকীয় আমার। কিন্তু তাতে কিইবা আসে যায়?
রিমোটটা যে ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিয়েছিলাম সেখান থেকে তুলে আনলাম। খুটখাট করে পাঁচদিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেললাম জিনিসটা।
কেন যেন রিমোটটার মধ্যে ইচ্ছা করে আমি সামান্য কিছু মডিফিকেশন করলাম। কেন যেন রিমোটের রেঞ্জ অনেক বাড়িয়ে দিলাম আমি।
একটু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও ঢুকালাম তার মধ্যে। এখন সে অনেকটা বুদ্ধি রাখে, অনেকটা আমার মতই চিন্তা করতে পারে।
তো একদিন রাতে আমি আমার রুমে শুয়ে আছি, হাতে ধরে আছি রিমোটটা। ঠায় তাকিয়ে আছি ওটার দিকে। আমার বউ তার রুমে, জোরে টিভি চলছে।
টিভিতে একটু পরপরই ভয়াবহ মিউজিক দিচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে কে না কে মরে যাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে বজ্রপাত হচ্ছে। আবার একটু পরে মনে হচ্ছে কারও বিয়েতে সানাই বাজানো হচ্ছে। কি কি যেন ডায়লগও শোনা যাচ্ছে। একটা ডায়লগ, এক মিনিট ধুমধাম ঠিকিস ঠুকুস।
আবার ডায়লগ। তারপর আবার একমিনিট টিগ ডিগ ডা ডা। তারপর বিজ্ঞাপন। আবার পুরো জিনিসটা রিপিট। ভিসিয়াস সাইকেল।
আমার একটু কৌতূহল হল। বউ তো আমার এখন পুরো সিরিয়ালে মজে গেছে। শালার স্টার প্লাস ছাড়া সে আবার কিছু বুঝে না। সবসময় সে তক্কে তক্কে থাকে কখন একটা সিরিয়াল হবে আর সে হা করে গিলবে। কার সাথে কার বিয়ে, কার ঘরে কে মেহমান হয়ে এল, কার পা ভাঙল, কার বাচ্চা হল, কার সাথে কে ভেগে গেল...সব তার মুখস্থ।
এমনকি প্রত্যেকটা সিরিয়ালের প্রতিটি ঘটনা আলাদাভাবে মুখস্থ।
আমি রিমোটটা চালু করলাম। রিমোট অবিকল আমার স্বরে বলল, কি হইছে?
আমার রিমোটকে আমি আমার মত করেই সৃষ্টি করেছি। অবিকল আমার গলায় কথা বলে সে।
আমি বললাম, কিছু হয় নাই।
টেনশনে আছি।
ক্যান?
বউ আর আমার দিকে চায় না।
আমি আছি কি করতে?
তুমি কি করবে?
তোমার বউ কি চিন্তা করতেছে বল, এখনই তারে তোমার সামনে এনে দিই।
বলব?
বল।
আমি ভেবে বললাম, আমার বউ এখন কঠিনভাবে হিন্দি সিরিয়াল দেখতেসে।
দুনিয়ার অন্য কোন দিকে তার খেয়াল নাই। সুতরাং, সে শুধু ঐ সিরিয়ালেরই চিন্তা করতেসে।
রিমোট বলল, তথাস্ত।
রিমোটের মধ্যে ভট ভট করে একটা শব্দ হল। একটা লাল আলো জ্বলে উঠল।
মানে, সে এখন সার্চ করতেসে এই চিন্তা কার ব্রেইন ওয়েভের সাথে মেলে।
কিন্তু সার্চ করতে এত টাইম লাগছে কেন?
একটু পরে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। মানে, ম্যাচ ফাউন্ড। বিলাই ফান্দে।
রিমোট বলল, বোতামে চাপ দাও।
আমি প্রথমে “টিভি বন্ধ কর” বোতামে চাপ দিলাম। একটু পরে টিভির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
আনন্দে রিমোটকে একটা চুম্মা দিতে ইচ্ছা করল আমার! শালা আসলেই কাজ করে!
এবার চাপ দিলাম “দরজা খোলো” বোতামে। একটু পরে তার রুমের দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল।
আনন্দে আমি রিমোটকে একটা চুম্মাই দিয়ে বসলাম।
রিমোটে একটা লালবাতি জ্বলেই আবার ঠিক হয়ে গেল। রিমোট কি লজ্জা পেলে সেটা এভাবেই প্রকাশ করবে?
আমি চাপ দিলাম “আমার রুমের সামনে আসো” বোতামে। একটু পরেই রুমের সামনে একজোড়া পায়ের শব্দ পেলাম আমি।
চাপ দিলাম “দরজা খোলো” বোতামে। দেখি একটু পরেই ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে যাচ্ছে দরজা।
ঘরে প্রবেশ করল আমার বউ।
তার ঐ রূপ আমি কোনদিন দেখি নি। দুচোখ জ্বলজ্বল করছে, হাবভাবে কেমন একটা উত্তেজনা। মনে হচ্ছে কোন ভিনগ্রহের প্রাণী।
আমি চাপলাম “কাছে এসো”।
বুঝতে পারলাম প্রিশি কেন শুধু এই একটা বোতামই বারবার চেপেছিল।
অনেকদিন পর আমার বউ আমার বিছানার দিকে আসতে থাকল। আমি রিমোটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। ওটার কাজ শেষ।
***
দশ মিনিট পর।
মেইন দরজায় নক হল। না আসলে নক নয়, মনে হল কেউ ধাক্কা খেল দরজার সাথে।
কুকুর টুকুর নাকি? দেখতে যাব? কতদিন পর বউ কাছে এসেছে, এখন কুকুর দেখতে যাওয়া যায়?
একটু পরেই আবার ধাক্কা। তারপর ধাক্কার পরিমাণ বাড়তে লাগল। মনে হল একটু পরপরই যেন কে আমার বাসার দরজায় ইট ছুঁড়ে মারছে।
বা নিজে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। আবার বাইরে হঠাৎ বিশাল চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে।
মাতাল নাকি? ধুর, বউয়ের প্রেমে আমি তখন তার চেয়েও বেশী মাতাল। আমাকে কেউ এখন এখান থেকে ওঠাতে পারবে না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমি এখন এখান থেকে উঠবো না।
হুম।
ধ্যাত, দরজার শব্দ তো বেড়েই চলছে। কত মানুষ আমার বাসার সামনে? এত হাউকাউ কিসের?
প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠলাম। বউও দেখি পিছন পিছন আসছে।
ভালোই লাগল আমার।
নাহ, এবার অন্তত কিছুদিন বউকে নিজের পিছনে ঘোরানো যাক।
ড্রয়িং রুম পার হতে না হতেই দরজায় প্রবল শব্দ হতে লাগল। মনে হল কেউ যেন বুলডোজার দিয়ে আঘাত করছে দরজায়।
ডাকাত নাকি? ভয় পেয়ে গেলাম।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের বাসার দিকে দৌড়ে আসছে অনেক মানুষ।
তাদের মধ্যে মহিলাই বেশী।
নাহ, তাহলে ডাকাত না। দরজাটা খোলা যায়। কিন্তু কাহিনীটা কি?
ততক্ষণে বউ আবার গা লেপটে দাঁড়িয়েছে। কি আর করা, ওকে ঠেলে সরিয়েই আমাকে দরজার দিকে যেতে হল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি হোল দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। উত্তেজিত কণ্ঠের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতে লাগল বাইরে থেকে।
ব্যাপার কি? এরা কি আমার ফ্যান? আমাকে কি একটু আগে নোবেল প্রাইজ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে?
দরজার নবে হাত দিলাম আমি। আস্তে করে ঘুরালাম নবটা।
বউ আমার আবার গা লেপটে দাঁড়িয়ে গেছে। আহা, কত ভালো বউ।
নবটা পুরো ঘোরানোর সাথে সাথে মনে হল, একটা ট্রেন যেন আমাকে আঘাত করেছে। বা একটা প্লেন আমার পেটে গুঁতো মেরেছে।
দরজার ওপাশ থেকে ভয়ানক ধাক্কায় আমি মেঝেতে উল্টে পড়ে গেলাম।
তাকালাম সামনে। তারপর যা দেখলাম...
আমি দেখলাম, আমার দিকে হাজার হাজার মেয়ে ছুটে আসছে। হাজার হাজার। চারদিকে শুধু মেয়ে আর মেয়ে। তাদের মধ্যে বুড়ি দাদী আছে, প্রৌঢ়া খালাম্মা আছে, সুন্দরী আপু আছে, চিকনা ভাগ্নি আছে।
সব আছে। কেউ বাদ নাই। দুনিয়ার সব মেয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে।
এক সেকেন্ডের মাথায় তারা আমার শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে।
কে আমাকে জড়িয়ে ধরবে তা নিয়ে শুরু হয়ে গেল রীতিমত মারামারি। আমার বউও হয়তো তাদের মধ্যে ছিল।
গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে আমার দুইটা জিনিস মনে পড়ল।
এক, হারামি রিমোটটার রেঞ্জ আমি ঠিক করার সময় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
দুই, হারামি রিমোটটাকে আর কাজে লাগবে না ভেবে আমি জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
***
সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে আমি জেগে উঠলাম ঠিক দশ দিন পর। পরে জানলাম আমার সারা দেহ মিলিয়ে নাকি মাত্র তেইশটা হাড্ডি ভেঙ্গেছে।
দুই দিন পরে আমার বউ এল। আমার সুন্দরী বউ। দেখে বরাবরের মতই দম আটকাতে গিয়ে মনে পড়ল, আমার নাকে তখন নেবুলাইজার।
দম আটকে রাখতে চাইলেও সম্ভব না।
বউ আমার সামনে একটা কাগজ ধরল। আমি বলতে চাইলাম, লাভ লেটার?
বউ বলল, ডিভোর্স লেটার। তোমার সাথে ঘর, নো মোর নো মোর।
আমি বলতে চাইলাম, ক্যান? কি করেছি আমি?
বউ বলল, আমারে আর তোমার দরকার নাই।
এলাকার প্রত্যেকটা মেয়ে তোমার জন্য পাগল। প্রত্যেকটা মেয়ে। কি ছোট কি বড়। কি কানা কি খোঁড়া। সবাই তোমার প্রেমিকা।
সবাই তোমার লাভার। ওদের সাথেই তুমি মজা পাইবা বেশী। আমারে আর কি দরকার?
আমি বলতে চাইলাম, তুমি ভুল বুঝেছ...
বউ বলল, আমারে কেয়ার করবে এরকম একজনকে আমি অলরেডি পেয়ে গেছি। হি ইজ সো কিউট, হ্যান্ডসাম। হি ইজ সো কেয়ারিং।
আই জাস্ট লাভ হিম ঠু মাচ। ঠু ম্যানি মাচ।
বউ তার পাশে দাঁড়ান মানুষটার হাত ধরে তার দিকে ইঙ্গিত করল। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হলদে দাঁত দেখা গেল তার।
হায় হায়, এই চ্যাংড়া! এরে তো আমি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ভাবসিলাম!!
***
তারপর থেকে আমি একা। অবশেষে তার গল্প শেষ করলেন প্রফেসর মিরাজ।
আমি বললাম, স্যার, সবই বুঝলাম। কিন্তু এলাকার সব মেয়ে আপনার দিকে ছুটে এসেছিল কেন এটা তো বুঝলাম না।
মিরাজ বললেন, গাধা।
তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?
আমি হ্যাঁ ও নায়ের মাঝখানে একটা উত্তর দিলাম। হন্যা...
মানে?
না। ধুর, জীবনে তো শতাধিক মেয়ে পছন্দ হয়েছে, কিন্তু ইন ট্রু সেন্স গার্লফ্রেন্ড তো জোটাতে পারি নি।
তোমার বাসায় মহিলা কে কে আছে?
আম্মু, নানু, দাদীমা।
প্রতিদিন রাতে কি তারা টিভি দেখে?
আমি একটু ভেবে বললাম, দেখে।
কোন চ্যানেল দেখে?
স্টার প্লাস।
গাধা, তাও তুই বুঝলি না কেন আমার দিকে এলাকার সব মেয়ে দৌড়ে এসেছিল?
আমি একটু একটু বুঝতে পারলাম। তার মানে...
গাধা, প্রফেসর আবার আদর করে এই ভদ্র প্রাণীটার নামে ডাকলেন আমায়, এলাকার সব মেয়ে রাতে স্টার প্লাসে হিন্দি সিরিয়াল দেখত। সে যে বয়সী মেয়েই হোক না কেন। কাজের মেয়ে হোক আর অফিসের কর্মকর্তা হোক, সবাই সময় হলেই সিরিয়াল দেখতে বসে যেত।
বুড়ি হোক আর পিচ্চি হোক, কেউ মিস দিত না সিরিয়াল। সিরিয়াল হচ্ছে চুম্বক, মেয়ে হচ্ছে লোহা। চান্স পাইলেই জোড়া লেগে যায়।
তো আমি যখন আমার রিমোটে টিউনিং করছিলাম, তখন টার্গেট ব্রেইন ওয়েভ দিয়েছিলাম “যে শুধু হিন্দি সিরিয়ালেরই চিন্তা করছে”, আমি মনে করেছিলাম এটা শুধু আমার বউকেই কভার করবে। কিন্তু রিমোটটা প্রিশির কাছ থেকে আনার পর এটায় যে আমি নিজেই মডিফিকেশন করে এটার রেঞ্জ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলাম এটা আমার মনেই ছিল না।
ঐ সময় রেঞ্জের মধ্যে সব বাসায় আরও অনেক মহিলা সিরিয়াল দেখছিল ও তীব্রভাবে তাদের কথা চিন্তা করছিল। সুতরাং রিমোটটা তাদেরকেও টার্গেট হিসেবে নেয় এবং তাদেরকেও কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে।
আমি যখন বিভিন্ন বোতামে চাপ দিচ্ছিলাম, তখন টার্গেট হিসেবে ধরা সব মেয়ে একই কাজ করছিল। টিভি বন্ধের কম্যান্ড দেবার পর সবাই তাদের টিভি অফ করে দিয়েছিল। দরজা খোলার কম্যান্ড দেবার পর সবাই তাদের নিজ নিজ রুমের দরজা খুলেছে।
শেষমেশ যখন কাছে আসতে বলা হয়েছে, তখন সবাই বাসা থেকে বের হয়ে আমার বাসার দিকে হাঁটা ধরেছে। তারপর তো সব বললামই।
আপনি বাঁচলেন কিভাবে? রিমোটটা কি কেউ খুঁজে পেয়ে ডিঅ্যাকটিভেট করে দিয়েছিল?
না, আসলে, রিমোটের ব্যাটারি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
আপনি তো ওটা দিয়ে আরেকটা মেয়েকে পটাতে পারতেন। আবার সুখে শান্তিতে সংসার পাততে পারতেন।
নাহ, মেয়েজাতির উপর আমার সব আকর্ষণ ঐ ঘটনার সাথে সাথেই উঠে গিয়েছিল। তারপরই তো আমি আমার বিখ্যাত কবিতাটা লিখি,
একা আছি
একা থাকব
সবাইকে
সুখে রাখব।
রিমোটটার কি করেছিলেন শেষ পর্যন্ত?
ওটা পাশের বাড়ির কুকুরটা কামড়ে কামড়ে নষ্ট করে ফেলেছিল।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
***
(অফটপিক, স্যার, আমাকে কি এরকম একটা রিমোট বানিয়ে দেয়া যায় না?
শোন সালেহ, তোমার নিজের মধ্যেই সেই রিমোট আছে, যেটা দিয়ে শুধু বউ কেন, দুনিয়ার সব মানুষকেই বশ করতে পারবে তুমি।
তোমার কাজ হল সেটা শুধু বের করে আনা। পাঠকদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।