আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রফেসর মিরাজ ও বিশ্বসেরা দাবাড়ু

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! ঘুম ভেঙ্গে উঠেই প্রফেসর মিরাজ মোবাইলের নিউজ ফিডে খবর পেলেন, সারা পৃথিবীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত ওয়েবসাইট হ্যাক হয়ে গেছে। সমস্ত মিসাইলের নিয়ন্ত্রণ এখন হ্যাকারদের হাতে। মিরাজ ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। হায় হায়, এ তিনি কি শুনলেন? এটা কি স্বপ্ন, না সত্যি? মিরাজ নিজের হাতে একটা রাম চিমটি কাটলেন। ভেবেছিলেন ব্যথা পাবেন না।

কিন্তু ব্যথায় উহ করে উঠলেন তিনি। তার মানে এটা স্বপ্ন না, বাস্তব। তাড়াতাড়ি পায়জামার ফিতা লাগিয়ে বাথরুমে গেলেন তিনি। পায়জামার ফিতা না খুলে শুলে তার ঘুম হয় না। তার নাকি গরম লাগে।

এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তার পায়জামার আবার চেন আছে। কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে সেই চেন খুলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলেন তিনি। কাজ শেষ করে আবার চেন আটকে চলে এলেন ব্রাশ করতে। নিজের উদ্ভাবিত পেস্ট দিয়ে দুই মিনিট ধরে ব্রাশ করলেন তিনি।

এটা তার নিজেরই বানানো, কিন্তু বিশেষ কারণে তা বাজারজাত করা যায় নি (বিশেষ কারণটা হচ্ছে, তার পেস্ট ব্যবহার করে দাঁতের সমস্যার হার শতকরা পঁচিশ ভাগ বেড়ে গিয়েছিল)। মুখ ধুয়ে আবার বেডরুমে এলেন মিরাজ। পিসিটা স্টার্ট দিলেন নেটে নিউজ দেখার জন্য। কিন্তু তার পিসিটা আবার দুদিন ধরে নষ্ট। স্টার্ট সহজে হতে চায় না, নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে মনিটর আর সিপিইউতে বাড়ি দিলে মাঝে মাঝে উইনডোজ স্টার্ট পেজ পর্যন্ত শো করে।

ব্যস, ও পর্যন্তই। আবার সিগনাল না দিয়েই হলুদ হয়ে যায় মনিটর, বন্ধ হয়ে যায় পিসি। মিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। কি করা যায়? হ্যাঁ, ফোন দেয়া যায় তার প্রিয় বন্ধু মাল লু কে। মাল লুর নাম্বারে ফোন দিতে দিতে স্টাডিরুমে ঢুকলেন মিরাজ।

সাথে সাথে বিস্ময়ে হা হয়ে গেলেন তিনি। ওখানে বসে আছেন সারা বিশ্বের বিজ্ঞান সংস্থার প্রধান হাগামোতো প্রিশি। **** প্রিশি মিরাজকে দেখেই একটা লাফ দিয়ে উঠলেন। আরে মিরাজ ভাই, কি খবর? কেমন আছেন? মিরাজ বললেন, ভালো...আপনি হঠাৎ এভাবে?...কি মনে করে? প্রিশি গম্ভীর স্বরে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে মিরাজ ভাই। সারা বিশ্বের পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত ওয়েবসাইট হ্যাক হয়ে গেছে।

মিরাজ বললেন, হ্যাঁ, খবর পেয়েছি। তা এটা কারা করেছে জানেন কিছু? প্রিশি বললেন, কারা না, বলুন কে। এটা একজনেরই কাজ, আর তার নাম দমটম রুন্ন। সে আবার কে? সে হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। সে আগে আমাদের সংস্থায় টেকনিশিয়ানের কাজ করত।

মূলত যে সেকশনে মস্তিষ্কের সাথে সফটওয়্যার সংযোগ দেবার উপর গবেষণা চলছিল ও ওখানেই কাজ করত। কয়েকদিন আগে সে পৃথিবীর সেরা দাবাড়ু সফটওয়্যার রেক্স ওয়ান চুরি করে। তারপর তার ল্যাবেই সবার অজান্তে নিজের মস্তিষ্কে লোড দেয় সফটওয়্যারটা। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তার ব্রেইন সেল জিনিসটাকে রিজেক্ট করে নি, বরং সেটার সাথে সহজেই অ্যাডাপ্ট করে নিয়েছে। সফটওয়্যারটা থাকার ফলে রুন্নর ব্রেইন এখন সেকেন্ডে হাজার হাজার লজিক বিশ্লেষণ করা শিখে গেছে।

তাই এখন সে পৃথিবীর ইতিহাসে যত জটিল জটিল গাণিতিক সমস্যারই উদ্ভব হোক না কেন, সবই সল্ভ করতে পারে। সে আগে হালকাপাতলা হ্যাকিং করত, দু একবার কয়েকজনের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ফাঁকা করে দেবার চেষ্টা করেছিল সে, আর এখন মাথায় এত বুদ্ধি নিয়ে সে লোভ সামলাবে কি করে? প্রথম চান্সেই সরাসরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওয়েবসাইট হ্যাক করার চেষ্টা করেছে সে। বলা বাহুল্য, সফল হয়েছে সে ভালভাবেই। মিরাজ বললেন, তো আমি কি করতে পারি? প্রিশি বললেন, আপনি ওকে থামান! ও যা শুরু করেছে তাতে এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো পৃথিবী ওর হাতের মুঠোয় চলে আসবে...হয়তো সে সবাইকে মেরে ফেলবে, বা ভয়ঙ্কর কিছু একটা করবে... মিরাজ একটু ভেবে বললেন, আমি ঠিক কি করব বলতে পারেন? প্রিশি অধৈর্য হয়ে বললেন, আপনি কি করবেন মানে? আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, আপনি পৃথিবীতে প্রথম ও একমাত্র টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছেন... তাতে কি? তাই...হঠাৎ প্রিশি আর কোন কথা খুঁজে পেলেন না। মিরাজ হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন।

বললেন, ও সম্ভবত আমার কাছে আসবে। চমকে উঠলেন প্রিশি। কেন? আপনি জানলেন কিভাবে? আমি জানি...আনমনা হয়ে উত্তর দিলেন মিরাজ। অনেক গুঁতিয়েও প্রিশি আর তাকে কথা বলাতে পারলেন না। *** সারা পৃথিবী অধিকার করতে দমটম রুন্ন নামের মানুষটির লাগলো মাত্র পাঁচ দিন।

এই কয়েকদিনে মিরাজকে দেখা গেল তার ল্যাবরেটরিতে সারা দিনরাত জেগে কি যেন খুটখুট করছেন। *** ঠিক ষষ্ঠ দিনের মাথায় ঘুম থেকে উঠে মিরাজ নিজেকে একটা সুসজ্জিত কামরায় আবিষ্কার করলেন। কি ব্যাপার? তিনি এখানে কেন? একটু পরেই জবাব মিলল প্রশ্নের। মিরাজের কামরায় প্রবেশ করল একজন অচেনা মানুষ। আপনি...মিরাজ প্রশ্নটা শেষ করলেন না।

তিনি জানেন এ কে। মানুষটা বলল, আমি দমটম রুন্ন। আপনি বোধহয় আমার কথা আগেই শুনেছেন। মিরাজ মানুষটার বিনয়ে অবাক হলেন। সারা পৃথিবী যে মাত্র পাঁচ দিনে পদানত করেছে, তার চরিত্রের সাথে এমন বিনয় বেমানান।

আমি এখানে কেন? আমার কাছে আপনি কি চান? রুন্ন হাসল। বিষণ্ণ হাসি। আমি চাই...আপনার টাইম মেশিনটা। মিরাজের আশঙ্কা সত্যি হল। তিনি এটাই ভেবেছিলেন।

তার মত বুড়োর কাছে সারা পৃথিবীর অধিপতির আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে? মিরাজ বললেন, আপনি চেয়েছেন যেহেতু, আমি অবশ্যই দেব আমার টাইম মেশিন। কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্ন ছিল। রুন্ন বলল, বলুন। মিরাজ বললেন, আপনি টাইম মেশিন দিয়ে কি করবেন? রুন্ন আবার হাসল। তারপর বলল, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, কিন্তু আপনি নেহায়েত একজন বুদ্ধিমান মানুষ বিধায় আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দেব।

বুদ্ধিমানদের আমি পছন্দ করি। বর্তমানে পৃথিবীর সব বড় বড় প্রযুক্তি আমার হাতে। আমি এই প্রযুক্তি নিয়ে চলে যাব বহু অতীতে, যে সময়ে মানুষেরও উদ্ভব হয় নি। সেখানে গিয়ে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের গোড়াপত্তন করব আমি, যাতে মানুষ শুরু থেকেই জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে থাকে। আমি ও আমার বংশধরদের দিয়েই আবার যাত্রা শুরু করবে মানুষ।

পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস লেখা হবে অন্যভাবে। মিরাজ অবাক হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধিমান পাগলটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে যদি সত্যিই অতীতে ফিরে যেতে পারে, এবং তার কথামত মানব সভ্যতা স্থাপন করতে পারে, তার মানে হচ্ছে, আজকে তিনি বা অন্য যারা পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে আছেন তারা কেউই থাকবেন না। রুন্নকে যে কোন মূল্যে থামাতেই হবে! মিরাজ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি পাবেন টাইম মেশিন।

কিন্তু তার আগে আমার একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে আপনাকে। চ্যালেঞ্জ? কি চ্যালেঞ্জ? মিরাজ বলল, আপনি আমার বানানো একটা প্রোগ্রামের সাথে দাবা খেলবেন। রুন্ন হঠাৎ হা হা করে হাসতে লাগল। দাবা!! মূর্খ মানুষ, তুমি জানো, পৃথিবীর সেরা দাবাড়ু সফটওয়্যারটি এখন আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত? আমাকে হারানো অসম্ভব এটা তুমি জানো? মিরাজ বলল, জানি। তবুও আপনাকে আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে।

রুন্ন কৌতুক করে বলল, যদি না করি? মিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে বুঝব নিজের বুদ্ধির উপর আপনার আস্থা নেই। রুন্ন ভ্রূ কুঁচকে মিরাজের দিকে তাকিয়ে রইল। তার আঁতে ঘা লেগেছে। এত বড় কথা? তার বুদ্ধিবৃত্তিকে অপমান! পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সফটওয়্যার যার মাথায় আছে তাকে অপমান!! তারপর একসময় হাসি ফুটল তার মুখে। আচ্ছা ঠিক আছে।

আমি রাজি। তোমার চ্যালেঞ্জটা বিস্তারিত বল। মিরাজ বললেন, আমার প্রোগ্রামের সাথে আপনি দাবা খেলবেন। যদি জিততে পারেন, তাহলে টাইম মেশিন আপনার। আমি নিজ দায়িত্বে আপনাকে অতীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।

আর যদি হারেন বা ড্র করেন, তাহলে আমি আপনাকে টাইম মেশিনে করে আমার যে সময়টাতে ইচ্ছা সেই সময়ে পাঠিয়ে দেব। সেটা হতে পারে অতীত বা ভবিষ্যৎ। আর সাথে সাথে পৃথিবীকে আগের মত করে দিতে হবে। ইন্টারনেট থেকে আপনার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে ফেলতে হবে। যার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে এনেছেন তা ফেরত দিতে হবে।

সমস্ত ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আগের মত করে দিতে হবে। শেয়ার বাজারও। রুন্ন আবার ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা বুঝতে সে ইচ্ছা করে একটু সময় নিচ্ছে। মিরাজ আবার বললেন, আমার প্রোগ্রামের সাথে খেলার একটা শর্ত আছে।

সেটা হচ্ছে, ইচ্ছা করে কখনই ভুল চাল দেয়া যাবে না। এমনকি যে চালটা সবচেয়ে বেশি লজিকাল, সেটা ছাড়া অন্য কিছুই দেয়া যাবে না। রুন্ন বলল, কেন? আমি ভুল চাল দিলে তো তোমারই লাভ। মিরাজ বললেন, আমার প্রোগ্রামটার আত্মসম্মানবোধ একটু বেশি। প্রতিপক্ষ ইচ্ছা করে ভুল চাল দিলে সে খেলা ছেড়ে উঠে যায়, গালাগাল দিতে শুরু করে।

রুন্ন হাসল। আচ্ছা ঠিক আছে। দেব না ভুল চাল। হয়েছে? মিরাজ বললেন, উহু, ওভাবে বললে হবে না। আমি নিজে আপনার প্রোগ্রামে এই পরিবর্তনটি ঘটাতে চাই।

ভুল চাল দেবার ফাংশনটিই আমি মুছে দিতে চাই। শুধু তাই না, কোন চ্যালেঞ্জ আসলে আপনার প্রোগ্রাম যেন কখনও ভয় পেয়ে না খেলে চলে না যায় সে ব্যবস্থাও করতে চাই আমি। রুন্ন বলল, তুমি যে এই সুযোগে প্রোগ্রামটা ধ্বংস করে দেবে না তার গ্যারান্টি কি? মিরাজ বললেন, আপনি আপনার সকল সহযোগীকে দিয়ে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করবেন। কোন উল্টাপাল্টা করলে সাথে সাথে আমাকে নিরস্ত করবেন। রুন্ন বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।

তোমার কথাই মেনে নিলাম। তুমি অনেক বুদ্ধিমান। কিন্তু সত্যি করে বল তো মিরাজ, তুমি আসলেই কি চাচ্ছ? মিরাজের বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। মানুষটি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান। সে কি বুঝতে পারছে মিরাজ কি চাচ্ছে? *** মিরাজ প্রোগ্রামের উপর তার কাজটি শেষ করে ফেললেন।

পুরো সময়টা তাকে অনুসরণ করল রুন্ন বাহিনীর অসংখ্য রোবট। একসময় জেগে উঠল রুন্ন। কাজ শেষ? হ্যাঁ শেষ। তো কোথায় তোমার প্রোগ্রাম? তার জন্য আপনাকে আমার সাথে আমার ল্যাবরেটরিতে যেতে হবে। আর হ্যাঁ, একা যেতে হবে।

রুন্ন কেন যেন রাজি হল। হয়তো মিরাজের ল্যাবরেটরিতে সে কোন বিপদের আশঙ্কা করে নি। সে আর মিরাজ গেল মিরাজের ল্যাবরেটরিতে। মিরাজ তাকে একটা ফাঁকা জায়গায় বসালেন। তারপর দেয়ালের কোথাও একটা বোতামে চাপ দিলেন।

রুন্নর সামনে কোথা থেকে একটা বড় হলোগ্রাফিক স্ক্রিন হাজির হল। সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা দাবার বোর্ড, তাতে আবার দুইপক্ষের চৌষট্টিটা গুটি সুন্দরভাবে সাজানো। রুন্ন জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোমার প্রোগ্রাম? মিরাজ বললেন, এই তো। এখানেই। বলে রুন্নর মাথার দিকে নির্দেশ করলেন তিনি।

মিরাজের কথাটাকে উচ্চমানের রসিকতা মনে করে হা হা করে হাসতে লাগল রুন্ন। *** খেলা শুরু হল। প্রতিপক্ষকে সরাসরি দেখার কোন সুযোগ এই খেলায় নেই। রুন্ন একটা চাল দিচ্ছেন, একটু পরে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে প্রতিপক্ষের গুটি নিজে নিজেই নড়ে একটা চাল সম্পন্ন করছে। অর্থাৎ, প্রোগ্রামটা চাল দিচ্ছে।

খেলার পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় রুন্ন বুঝতে পারল, সে যে প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে খেলছে, সে কখনও ভুল চাল দেয় না। ঠিক তারই মত। বিস্ময়করভাবে, তার খেলার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীর খেলার আশ্চর্য মিল। অফেন্সে আশ্চর্য মিল, ডিফেন্সের স্টাইলও একই রকম। দুজনেই একটু ডিফেন্সিভ খেলতে ভালবাসে।

দুজনেই প্রতিপক্ষকে ভুলের সুযোগ দেয়। এ যেন একেবারে নিজের সাথে খেলার মত! রুন্ন একটু উল্টাপাল্টা খেলে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে চাইল। কিন্তু একটা ভুল খেলতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, সে আর ভুল চাল দিতে পারছে না। সঠিক চাল ছাড়া আর কিছুই সে ভাবতে পারছে না। খেলা চলল ঠিক এক মিনিট।

এরই মধ্যে উভয়েরই অসংখ্য চাল দেয়া হয়ে গেছে, একটা জায়গায় এসে উভয়েই আটকে গেছে, কারণ একই গুটি বারবার আগুপিছু করছে তারা। আর এজন্যেই খেলাটা প্রকৃত অর্থে আটকে গেছে। আরও অসংখ্যবার একই ঘটনা ঘটার পর রুন্ন বুঝতে পারল, একটা ভুল চাল দেয়া ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভুল চাল দেবার কোন উপায় তার নেই। ভুল চাল দেবার ফাংশনটিই আর নেই তার।

তার প্রতিপক্ষও কোন ভুল চাল দিচ্ছে না। এখন এই অবস্থায় খেলা অমীমাংসিত ঘোষণা করা ছাড়া উপায় নেই। অর্থাৎ, ড্র। রুন্ন অনেকবার লজিক ডিডাকশন করে বুঝতে পারল, এখন ড্র ঘোষণা করাই সবচেয়ে “লজিকাল” কাজ। সে ড্র ঘোষণা করল।

ওপাশ থেকেও প্রস্তাবটি গৃহীত হল। অর্থাৎ, দুই পক্ষের সম্মতিক্রমে ম্যাচটি ড্র হয়েছে। রুন্ন আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। সে জানে বাইরে পৃথিবীতে এতক্ষণে আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্রের উপর তার নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ব্যাঙ্ক ব্যালান্স সব আগের মত হয়ে গেছে। তার লুণ্ঠন করা সমস্ত দ্রব্যাদি আস্তে আস্তে আসল মালিকদের কাছে চলে যাচ্ছে। সে চ্যালেঞ্জে হেরে গেছে। রুন্ন মিরাজের দিকে তাকাল। কিভাবে বানালে এই প্রোগ্রাম? কিভাবে? ভগ্ন স্বরে জানতে চাইল সে।

মিরাজ এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। তিনি গিয়ে তার টাইম মেশিনের কয়েকটা বোতাম টেপাটেপি করলেন। ঘড়ঘড় শব্দ করে জীবন্ত হয়ে উঠল টাইম মেশিন। আস্তে আস্তে ল্যাবরেটরির মধ্যে একটা অস্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের মত তৈরি হল। সেই দেয়াল প্রচণ্ড শক্তিতে যেন আশেপাশের সবকিছুকে শুষে নিতে লাগল।

মিরাজ রুন্নকে দেয়ালটা দেখিয়ে বললেন, এটাই তোমার নিয়তি। যাও, চলে যাও। বর্তমান তোমাকে আর চায় না। রুন্ন বলার চেষ্টা করল, যদি না যাই? যদি তোমাকে এখনই খুন করে ফেলি? মিরাজ বললেন, দেখ রুন্ন, তুমি মানুষ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া তোমার মানায়।

কিন্তু তোমার মাথার সাথে যে সফটওয়্যারটি লাগানো আছে সেটা কিন্তু যন্ত্র। সে কিন্তু মিথ্যা বলে না। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া তার কাছে আত্মহত্যার শামিল। তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে তুমি ও তোমার সফটওয়্যার, উভয়েই ধ্বংস হয়ে যাবে। রুন্ন কিছু না বলে তাকিয়ে রইল।

মিরাজ বলল, এখানে বেশিক্ষণ থাকলে তোমারই সমস্যা। তোমাকে ধরার জন্য ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী রওনা হয়ে গেছে। তোমাকে হাতে পেলে তারা তোমায় কুত্তার মত মারবে নাকি শেয়ালের মত মারবে সেটা কি তোমার সফটওয়্যার বুঝতে পারছে না? রুন্ন পরাজিতের মত কাঁচের দেয়ালটির দিকে যেতে শুরু করল। আর মুখে বিড়বিড় করতে লাগল, এটা তুমি কিভাবে করলে? কিভাবে বানালে এই প্রোগ্রাম? কিভাবে?... কাঁচের দেয়ালের কাছে গিয়ে বিষণ্ণ একটা হাসি উপহার দিল সে। তারপর বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি এটুকু অন্তত জানতে পারি? মিরাজ বললেন, না।

পারো না। কিন্তু শুধু একটা কথা মনে রাখবে, বাঁচতে হলে তোমাকে আবারও দাবা খেলতে হবে। রুন্ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিরাজের দিকে তাকিয়ে রইল। ল্যাবরেটরির দরজায় দুমদুম ধাক্কাতে লাগল একদল মানুষ। রুন্ন, রুন্ন, ওপেন দি ডোর।

প্রফেসর, ওপেন দি ডোর। মিরাজ বললেন, Hasta la vista, Babe। রুন্ন একটা বড় শ্বাস নিল। তারপর লাফ দিল কাঁচের দেয়াল লক্ষ্য করে। কাঁচের দেয়াল প্রচণ্ড শোঁ শোঁ শব্দে শুষে নিল রুন্নকে।

তারপর একটা বিদ্যুতচমকের মত উধাও হয়ে গেল ওটা। দরজা ভেঙ্গে গেল। হুড়মুড় করে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করল একদল সশস্ত্র পুলিশ। রুন্ন কোথায়? প্রফেসর, আপনি ঠিক আছেন তো? মিরাজ হাসলেন। দুশ্চিন্তার প্রহর কেটে গেছে, এখন না হাসলে হাসির অপমান হবে যে! ও পালিয়েছে, বললেন তিনি।

পালিয়েছে? দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল পুলিশ কর্মকর্তার কপালে, কোন পথ দিয়ে? কখন? সময়ের পথ দিয়ে, রহস্যময় হেসে উত্তর দিলেন মিরাজ, ওকে আর আপনারা খুঁজে পাবেন না। *** দশ মিনিট পর। সব পুলিশ চলে গেছে। মিরাজ আস্তে আস্তে ফাঁকা জায়গাটার দিকে এগুতে লাগলেন। ওখানেই এতক্ষণ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে খেলা হচ্ছিল।

জায়গাটার সামান্য পিছনে গিয়ে মেঝের উপর খুঁজে খুঁজে একটা আংটা বার করলেন তিনি। তারপর টান দিলেন আংটাটা ধরে। ঘড়ঘড় শব্দে মেঝের একটা অংশ খুলে গেল। ভিতরে অনেক নিচে একটা মেঝে দেখা গেল। ওখানে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল।

গোপন দরজাটা খোলার শব্দ পেয়ে উপরে তাকাল সে। মানুষটার নাম রুন্ন। রুন্ন বলল, আরে মিরাজ, তুমিও এসে গেছ? টাইম মেশিনটা তোমাকেও টেনে এনেছে নাকি? এটা কোন জায়গা? কত সালে আছি আমরা? আরে কি হয়েছে শোন, আমি এখানে আসার সাথে সাথেই একটা কম্পিউটার বলে উঠল, এখান থেকে বের হতে হলে নাকি তার সাথে দাবা খেলতে হবে। আমি তো ভাবলাম ঠিক আছে, আমাকে হারানো তো সম্ভব না, শুধু তোমার প্রোগ্রাম ছাড়া আর কেউই আমাকে হারাতে বা ড্র করাতে পারে নি। আমি তার সাথে খেলতে রাজি হয়ে গেলাম।

তারপর দেখি কি, শালা কম্পিউটার ঠিক আমার মত খেলে। একদম ভুল চাল দেয় না। তারপর একসময় ড্র হয়ে গেল, কম্পিউটারই প্রথম ড্রয়ের প্রস্তাব দিল, আমারও রাজি না হয়ে উপায় ছিল না, আর তারপরই শালা কম্পিউটারটাও একদম চুপ হয়ে গেল, এখন তাড়াতাড়ি আমাকে উঠানোর ব্যবস্থা কর... মিরাজ খুব সাবধানে পেছন থেকে তার রিভলভারটা বের করলেন। এটা তার ল্যাবেই থাকে সবসময়। ভিতরে গুলি আছে ছয়টা।

আজ এটার প্রথম ও শেষ ব্যবহার হবে। (সমাপ্ত) [ পরিশিষ্ট প্রফেসর মিরাজ যখন তার প্রিয় ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভুঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আমাকে এই কাহিনীটা বলছিলেন, তখন একটা জায়গায় বুঝতে না পেরে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা প্রফেসর, একটা জিনিস বুঝলাম না, রুন্ন টাইম মেশিনে ওঠার আগে কার সাথে খেলে ড্র করল? উনি হাতটা উনার নেয়াপাতি ভুঁড়ি থেকে সরিয়ে আমার মাথার উপর রাখলেন এবং বললেন, শোন, টাইম মেশিনে করে রুন্নকে আসলে কয়েক মিনিট অতীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাকে পাঠানো হয়েছিল ঐ ল্যাবরেটরিরই নিচের একটা গোপন কক্ষে, যেখানে আমি গত পাঁচ দিনে খেটেখুটে দাবা খেলার জন্য একটা কম্পিউটার সেট করেছিলাম। টাইম মেশিনে করে অতীতে আসা রুন্ন আসলে বর্তমানের রুন্নর সাথে খেলেছে, শুধু তাদের খেলাটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে একটা কম্পিউটার ও একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মাধ্যমে। যেহেতু দুই রুন্নই আসলে এক, তাই দুজনেই একই রকম খেলেছে, দুজনের কেউই ভুল চাল দেয় নি, আর তাই খেলাটা ড্র হয়েছে।

কম্পিউটারের কাজ ছিল খালি এর চাল ওকে আর ওর চাল একে দেয়া, কিন্তু এমনভাবে খেলাটা দেখানো হয়েছে যে দুজনেই মনে করেছে তারা কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাথে খেলছে। আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এই টাইম মেশিনের ব্যাপার স্যাপার তেমন একটা ঢুকল না। আমি বললাম, আমি না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু পাঠকরা? প্রফেসর একটা দিলখোলা হাসি হেসে বললেন, সব পাঠকদেরই রহস্যময় জিনিসের প্রতি একটু বেশী আগ্রহ থাকে। তোমার ভয় নেই, না বুঝলেও পাঠকরা তোমার গল্প ফেলে দেবে না। ] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.