আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসমাপিকা, ১৫শ অধ্যায়

সত্য সুন্দরকে ব্রত করি জীবনে ১৪শ অধ্যায় Click This Link আসন্ন আনন্দ উৎসবএর আমেজকে কিছুটা হলেও মলিন করে দিল রাকিবের প্রস্থান । সানোয়ার সাহেব তার ছেলে রাকিবের অনুপস্থিতিকে অনুভব করছেন, আনোয়ার সাহেব এবং তার স্ত্রী সালমা মানে লীনার বাবা মায়েরও সেই একই অনুভুতি । তবে মিসেস রেহানা অন্য এক আভাসে এমন কিছু অনুধাবন করছেন যা তাকে পীড়িত করছে । লীনার মনেও মাঝে মাঝে দমকা বাতাসের মত একটা মুখ আসে , লীনা দ্রুতই সেটাকে সরিয়ে দেয় । সে মুখটা ওর রাকিব ভাইয়ের ।

কি বিচিত্র এ জগৎ , সব ঘটনাগুলো কোনক্রমেই সুবিন্যস্ত হয় না । ওলট পালট না হলে কি চলে না ? লীনার পরীক্ষাটা শেষ হওয়া দরকার ; দীপুরও । দীপুর পেশা পরিচয়হীনতা তাড়াতাড়ি ঘোচাতে হবে, উৎকণ্ঠিত সে । ICDDRB (আই সি ডি ডি আর বি) তে আবেদন করা আছে, ওরা তাকে পরীক্ষার পরে যোগাযোগ করতে বলেছে । ওর অনার্স রেজাল্ট এবং অন্য একটা ট্রেনিং এ সাফল্য দেখে ICDDRB কর্তৃপক্ষ ওকে কাজটা দিতে চেয়েছে ।

চাঁদপুরের মতলবে থাকতে হবে । দীপু আপাতত: এটাই করবে । লীনাকে বিয়ে করবার জন্য তাকে একটা কিছু করতে হবে । পরে তার উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হবে । কবে যে পরীক্ষাটা শেষ হবে! দীপুর আর তর সইছে না ।

কানাডা যাওয়া পিছিয়েছে দীপুর বোনদের । সেটা একটা সুখবর । দীপুর মনে হচ্ছে এবার এন্গেজমেন্ট নয় পুরো বিয়েটা সেরে ফেলা যায় । পরীক্ষা শেষ হলে এ কথাটা সে তুলবে ভাবছে । দূরে গিয়ে ভুলে যাবার চেষ্টা কতটা ব্যর্থ সেটা টের পাচ্ছে রাকিব ।

ঢাকায় লীনা , রক্ত মাংসের একজন মানুষ লীনা , তাদের দোতলার চাচাতো বোন লীনা তাকে যেভাবে এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধেছিল সেখানে সূতোটা এত ধারালো ছিল না । লন্ডনের দিনগুলো , রাতগুলো সব লীনা কিনে নিয়েছে । সকাল হলেই মনে পড়ে কোন একজন লীনা আছে যার কারনে রাকিব ঢাকা ছেড়ে এই একাকী জীবন বেছে নিয়েছে । রাতে ঘুমুতে যাবার সময় মনে ভাবে লীনা নিশ্চয় ভাল আছে , বিয়ের গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত আছে । লীনা ভাল আছে এটা না ভাবতে পারলে রাকিবের ঘুম আসে না ।

এখানে লীনা চারিদিক থেকে সমস্ত বাতাসকে ভার করে তাকে ঘিরে রাখে, মায়াবী এক সত্ত্বা এতদূর দেশে তাকে প্রতিপলে মনে করিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব তার নাম লীনা। সে লীনার ব্যপ্তি এত বিশাল যে রাকিব চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারে না । সারাদিন এখানে ব্যস্ততায় কাটে, রাকিব ইচ্ছে করে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । এটাই একমাত্র উপায় লীনার মায়াবী বাঁধন আলগা করবার । ব্যস্ততা তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে ।

ঢাকার বন্ধু ইমন সাহিত্য সংস্কৃতি ভালবাসে , তার উপলব্ধিকে রাকিব বুঝতে পারে । ইমন এখনও মেনে নিতে পারেনি রাকিবের চলে আসা, তার ভাষায় "পালিয়ে আসা" । পরে লিখেছিল সে, 'ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেলে ফিরে আসিস' । রাকিব জবাব দিয়েছে , ' যত দিন যাচ্ছে তত সব কঠিন হয়ে যাচ্ছে আমার , দেশে থাকতে লীনাকে পাবো না এই ভাবনায় মনটা খারাপ হত ; এখন মনে হয় ঢাকা মানে লীনা, যে লীনা আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে ; সুদূরতমা । আর কখনো যাবো না দেশে ।

' ইমনের কিছু করবার থাকে না , অন্যকে বলভার থাকেনা । মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মত রুমানাদের পরিবারে আরেক বিপদ উপস্থিত হল । মিসেস রেহানা এক সকালে প্রলাপ বকতে লাগলেন, ঠিক প্রলাপ নয় ; কথা জড়িয়ে যাচ্ছে , চলতে গেলে পড়ে যাচ্ছেন, মনে হচ্ছে বাসার মানুষদের চিনতে পারছেন না । এমন ঘটনা আগে দেখেনি কেউ । দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হল ।

নিউরোলজীর বিখ্যাত ডাক্তার আনিসুল হক পরিচিত। উনি দেখে ওদের আশ্বস্ত করলেন যে ভয়ের কোন কারন নেই । মিসেস রেহানার ডায়রিয়া ছিল গত ২৪ ঘন্টা ধরে, ইলেকট্রোলাইটসের অভাবে এমনটি হয়েছে জানালেন । রুমানাদের দু:চিন্তা কাটছে না । ভাল হবে তো ওদের মা ।

রাকিবকে ফোন করা হয়েছে । সে এখুনি আসছে না জানিয়েছে । তবে বার বার খবর নিচ্ছে । মিসেস রেহানার কোন শব্দ বোঝা যাচ্ছে না । তবে 'রাকিব' শব্দটা কয়েকবার পরিষ্কার বোঝা গেছে ।

লীনার ভাল লাগে না । কেমন যে লাগে নিজেও বোঝে না । লীনার বন্ধুরা এসেছে দেখতে রোগী । রুমানা দীপুকে দেখে নি কখনো । বান্ধবী মিতাকে চেনে ।

কেবিনের বাইরে রুমানা বসেছিল , সে মিতাকে দেখে এগিয়ে গেল । বলল, ' জানো মিতা আমার কেমন নার্ভাস লাগছে আম্মার এমন অসুখে । কি সব বলছে বুঝতে পারছি না ; মাঝে মাঝে রাকিবকে ডাকে , এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে । আরো টেনশন লাগে লীনার জন্য । যদি কিছু বলে ফেলে এই অবস্থায় ।

যদি বলে যে রাকিব ওর কারনে দেশ ছাড়া ; " কথাটা শেষ হবার আগে মিতা নিজে থেকে পরিচয় করিয়ে দেয় দীপুর সাথে । ততক্ষনে দীপুর কানে চলে গেছে কথাটা । দীপু নিজেকে অপরাধী না ভেবে থাকতে পারে না । রুমানাও অপ্রস্তুতবোধ করে । ওরা কেউ এ সবের জন্য দায়ী নয় ।

মানবিকতা এক অমোঘ অখন্ড ভাব । সেটা মানুষকে সত্য চিনিয়ে দেয়, কিন্তু সবসময়ে সত্যকে বিজয়ী করতে পারে কি ? পারে না । আর জীবনের ঘটনাগুলো নিজে নিজের জন্য জায়গা করে নেয় । ক্রমানুসারে নয় অনেকটা ছেলেখেলার মত । লীনা পরীক্ষাটা দেয় ঠিকমত ।

দীপুও দেয় এবং পূর্বনির্ধারিত চাকরীতে চলে যায় চাঁদপুরের মতলবে । মিসেস রেহানা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে সংসারে ফিরেছেন । তার অতি অপছন্দের দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী সানোয়ার সাহেবের সাথে শান্তিতে বসবাস করবার ভান করে যাচ্ছেন । কেবল ছেলেটা দূরে থেকে কষ্ট দিচ্ছে । একদিন রাকিবের বন্ধু ইমনকে ডেকে আনলেন বাড়ীতে ।

মিসেস রেহানা: রাকিব তোমাকে কিছু বলেছে এভাবে চলে যাবার প্রসঙ্গে কিছু ? ইমন: নাহ্ খালাম্মা , আগে থেকে কিছু বলেনি । মিসেস রেহানা: পরে কি বলেছে ? তুমি তো জানো ইমন ও আমার কত আদরের । সন্তান বয়সে, লম্বায় আর খ্যাতিতে যত বড় হোক না কেন মায়ের কাছে সে কি কখনো বড় হয় ? তোমার কোন অসুবিধা না হলে আমাকে বল বাবা । আমি কেমন কুয়াসাচ্ছন্ন হয়ে আছি । তাছাড়া তোমাকে শুধু জানাই রাকিব চলে যাবার আগে ওর ওয়ালেটে লীনার ছবি দেখে, লীনার ব্যাপারে ওর মধ্যে অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে আমার একটা বিষয়ে খটকা লেগেছে ।

ও কি লীনার বিয়ের আয়োজনে এভাবে চলে গেল ? ইমন: আপনি ভুল বলেন নি খালাম্মা । কিন্তু আমাদের কি করবার আছে ? ওকে আমি বোঝাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছি । আবার সে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যেন ওর কারনে লীনা দীপুর বিয়েটা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় । আবার আপনাকেও সে কষ্ট দিতে চায় না । খালাম্মা , রাকিব এ সময়োপযোগী নয় ।

এখন তো কেড়ে নেবার সময় , ছেড়ে দেবার মত বোকামী কে করে ? মিসেস রেহানা: নাহ্ থাক বাবা ; সেই ভাল । কি প্রয়োজন জোরাজুরিতে । ওতে কি কারও মন জয় করা যায় । তাছাড়া লীনা আমার সন্তানের মত । ওর সর্বাঙ্গীন সুখ আমি মনে প্রানে চাই ।

তবে তুমি কি নিশ্চিত যে রাকিব লীনার জন্য চলে গেল ? ইমন: খালাম্মা, রাকিব ওর ল্যাপটপটা রেখে গেছে না আপনার জন্য ? একটু এনে দিন আমাকে । ল্যাপটপে বসে ইমন একটা মেইল ওপেন করলো রাকিবের । তারপর পড়ে শোনালো মিসেস রেহানাকে । ' ইমন তুই কেন বার বার অনুরোধ করছিস ফিরতে? আমার সবচেয়ে প্রিয় আম্মা , তার অসুস্থতায় পর্যন্ত আমি দেশে যাবার জন্য দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম । লীনা যেখানে আছে সেখানে পৌছুবার মত শক্তি আমি পাই না ।

ও আমার নয় , কখনো হবে না সে কথা এতবার হাতুড়ি পেটায় আমার মাথার মধ্যে যে আমি সহ্য করতে পারি না । লীনা ঢাকায় আছে , আমাকে বলিস না যেতে ওখানে । আর বলিস না, আমার কষ্ট টা তুই অন্তত বোঝবার চেষ্টা কর । আম্মাকে দেখিস, আমার অনুপস্থিতির কষ্টটা তুই লাঘব করবার চেষ্টা করিস । ' মিসেস রেহানা মূর্তির মত বসে রইলেন ।

বাংলাদেশের মেয়ে তিনি , নিজ যোগ্যতায়, নিজ বুদ্ধিমত্তায় এবং ধৈর্য্য দিয়ে বিবেচনা দিয়ে সবার কাছে নিজেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দাড় করিয়েছেন । আজ মনে হল উনি কতটা ক্ষুদ্র কতটা তুচ্ছ, কতটা শক্তিহীন । জগৎ সংসারের সরল অংকে একটা ভগ্নাংশর লব নিয়ে তিনি বিপন্ন বোধ করছেন । চলবে Click This Link  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।