আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিতাসের বুকে ভারতের বাঁধ দেয়ার খবর দেইখা এ গল্প নাজেল হইছে

কতো কী করার আছে বাকি.................. কাঁদে বেহুলা কাঁদে কোব্বাদের চোখের সামনেই লাশের কাফন গলে ভোর ছড়াতে শুরু করে। রাত তখনও মিলায়ে যায় নাই। রাতের ফাঁকে ফাঁকে কাফনা-গলা মিহি-ভোরেরর রঙ পাতলা দুধের মতো উড়ে উড়ে মিশে যেতে থাকে। আমের পাতায়, তালের মাথায়, একটু একটু কাফন-গোলা মিহি-সাদা রঙ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিতাস যেদিকে সেখানেও বাতাসে ভাসতে ভাসতে কাফন-গলা ভোর চলে যেতে থাকে।

যেতে যেতে তারা কোব্বাদের বাপের গায়ের জলটুকু সঙ্গে নিয়ে যায়। অথবা কোব্বাদ আর তা মা কাঁদতে থাকলে তাদের নাকের আর চোখের পানিও কাফন-গলা ভোররে ভিজায়ে দেয়। ভেজা-ভেজা ভোর ফুটতে শুরু করে। এতক্ষণ অন্ধকারই ছিল। রাত ছিল।

যেই না লাশটা ধুয়ে তারা উঠানে এনে রাখল, আর লাশটাও ভোর ছড়াতে শুরু করল। মসজিদের সামনে আরও কয়েকজন জড়ো হয়েছে। মরে যাওয়া মান্নানকে এরা সবাই চেনে। মান্নান মিয়া পাগল হয়ে গিয়েছিল, ভারত খুঁজতে গিয়েছিল। সে আজ মেলা দিন।

কোব্বাদের তখন বগল তলে লোম গজাতে শুরু করেছিল, নাকি তারও আগে সবার অগোচরে তার বগল তলায় লোম গজাচ্ছিল তা কে জানে কিন্তু মান্নান চলে যাওয়ার পর সবাই খেয়াল করে তার একমাত্র ছেলেটা লায়েক হেয়েছে, তাবাল হয়ে উঠেছে। বাপের কষ্ট সে এবং তার মায় টের পাইছে, সমাজের বাকিরা টের পাইছে, কিন্তু পেটেরে টের পাইতে দেয় নাই কোব্বাদ। পেট খুব হারামজাদা আর বজ্জাত আছে। তারে তুমি খুশি রাখবা সেও তোমরে খুশি রাখবে। ভরা-পেট সাপের মতো সে তখন নির্বিষ নিজেরে গুটায় রাখবে।

কিন্তু তারে তুমি দানা-পানি না দিছ সে হয়ে উঠবে কাল নাগ। ঘরে শত্রু বিভীষণ, তাওর তখন তুমি শান্ত করতে পারবা না। সে তখন তোমার ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসবে। ইজ্জত বাজারে বিকায়ে দিয়ে আসবে। সবাইরে দেখায়া বেড়াবে, দেহ আমি কোব্বাদের ক্ষিধা, কোব্বাদ একটা ফকিরের ছাও ও ক্ষিধারে খাইতে দেয় না।

মান্নানই এসব বলেছে কোব্বাদরে। কিন্তু সেই সেই যে বাড়ি ছাড়ল আর আইজ ফিরল লাশ হেয়ে। ক্ষিধার চোটে ঘরের বাইরে যায় নাই সে। সে গেছিল ভারত খুঁজতে। ভারত খুঁজে পেয়েছিল কিনা সেই জানে, কোব্বাদ জানে না।

তার মাও না। প্রায় শেষ রাতের দিকে তাদের ঘরে হাউ-মাউ হামলে পড়ে ইলিয়াস মিস্ত্রী। কোব্বাদ তার সাথেই কাজ করে এখন। সে-ই প্রথম মান্নানের লাশ দেখার সংবাদ জানায়। বাঁধের ওপর পড়ে আছে অসহায় মান্নান।

শরীরের হাড় কখান গোনা যায়। চামড়া তখনও কুঁচকে যায় নাই। পেট যেন এক গর্ত হয়ে গেছে। শরীরে কোনো দাগ নাই। সাপেও কাটে নাই তারে।

তাইলে মান্নান মরল কেমনে। এ প্রশ্নের উত্তর সবার সামনে ঝুলে থাকে। বাঁধটা যেখানে বাঁক নিছে মানে, কোড্ডার বড় রাস্তায় মেশার আগে মানে তিতাসের যে ঢাল সেখানও থেকেও কোব্বাদদের ঘর অন্তত দেড় মাইল ভিতরে। সেই ঢালে ইলিয়াসের চাচার দোকান আছে। সে সেখানেই ছিল রাতে।

চাচায় মাছের ছোটখাটো ব্যবসা করে। আখাউড়ায় সেই মাছ চালান দেয়। আরও কয়েকটা দোকান ঘর আছে। আইজ মাছ মারার তদারকিতে ইলিয়াসের ডাক পড়ছিল। সে ঠিক ঢালের মুখে মান্নানের লাশ দেখতে পায়।

দৌড়ে কোব্বাদরে খবর দেয় আর তারপর তার চাচার কাফনের ব্যবসাও আছে, সেখান থেকে কাফন নিয়ে, তিতাসের জলে গোসল করায়ে মান্নানরে ভ্যানে উঠায়ে মসজিদের সামনে নিয়ে আসতে আসতে কোব্বাদ এই প্রথম লাশটার দিকে ভালো করে তাকাইতে গেলে দেখে, সেই কাফন থেকে গলে-গলে ভোর নামতেছে আর সেই ভোর এমনকি আকাশেও উড়ে বেড়াইতেছে। মান্নান অন্তত দুই বছর পরে ফিরে এসেছে লাশ হয়ে। কেউ বলে পাঁচ বছর। তাদের বছরের হিসাব গুলায়া যায় কারণ ভারত খুঁজতে যাওয়ার ঘটনা মান্নানে যখন ঘটাইল, তখন আশে-পাশে আর কোনো ঘটনাও ঘটে নাই। এমনকি এরপর মনে করার মতো, দাগ টাইনা রাখার মতো কিছু ঘটে নাই।

ফলে মান্নান কবে চলে গিয়েছিল তা হিসাব কইরা বাইর করা সম্ভব হয় না। তয় মান্নান পাগল হইছিল। বেহুলার জন্য সে পাগল হইছিল। মান্নানের সব ঘটনাই সবাই জানে। সেও রঙের কাজ করত।

বর্ষা আসলে মাছ ধরত। নির্ঝঞ্ঝাট মান্নান জহুরারে বিয়া কইরা নিয়া আসে তার নানা বাড়ি লাকসাম থিকা। কালো-মান্নান রঙের কাজ করতে গেলে তার মুখে কেমন সবুজ-লাল বা চুনা রঙ লেগে থাকলে তারে দেখতে বিচিত্র সার্কাসের সঙ মনে হইত। এমনকি তার মরণের পরে অনেকেই সেসব কথা স্মরণ করে। সে বিনয়ী আর ভাবুক চরিত্রের আছিল, কেউ কেউ তাও উল্লেখ করে।

তবে সব ছাড়ায়ে তার পাগল হেয়ে ওঠার ঘনাই মান্নানরে আলোচ্য করে রাখে। সে মারা যাওয়ার পরদিনও এমনকি টানা সাতদিন এরপর বৃষ্টি হয়ে গেল, কার-কার যেন জমিনে পানি জমে গেল, কার যেন গরু ছুটে গেল, কার যেন নৌকা গেল ডুবে, কার টিনের চাল ফুটা হইল, কার কি হইল না হইল সব কিছুতে মান্নানের উপস্থিতি বাড়তেই থাকল। বলা যায় মান্নান তাদের অভাবের ঘরেরর চৌকিদার হয়ে উঠল। যতক্ষণ তারা কাজ করে বা যতক্ষণ তারা একা থাকে হয়তো তখন কেউ মান্নানের কথা ভাবে না বা ভাবলেও ঠিক ঠাহর করেতে পারে না মান্না বিষেয়ে সে আসলে কি ভাবল। কিন্তু যেই দুই জন এক হয় কোনো জায়গায়, তাদের আর কিছু করার থাকে না, তারা মান্নানের কথাই বলে।

আখাউড়া গিয়ে সিনেমা দেখে ফেরার পথে তারা যখন বাসে চাপে বা টেম্পুতে বা হেঁটে ফিরলেও তাদের ঠিক মনে পড়ে মান্নানের কথা। এর মধ্যে গুরুতর ঘটনা ঘটে যায়। কেউ কেউ বেহুলার কান্না শুনতে পায় রাতের বেলা। কেউ মান্নানরে স্বপ্নে দেখে। কেউ মান্নানের বলে যাওয়া স্বপ্ন দেখে, কেউ দেখেছে কিনা তাও ঠিক কইরা কইতে পারে না।

কিন্তু তাও তার মনে হয় সে দেখছে, স্বপ্নটা সেও দেখেছে। মান্নানের স্বপ্ন যে দেখা নাই তার জীবন দেখার বাকি আছে বলে ঘোষণা দেয় স্বয়ং মৌলভি সাব। মান্নানের মরার পরে এই যে সবাই তারে নিয়া চিন্তায় পড়ল এটা কিন্তু জীবিত মান্নানের বেলায় ঘটে নাই। সে তখন রঙের কাজ করে। বেশির ভাগই আখাউড়াতে।

ঢাকায়ও গেছে বার দুয়েক। শেষ বার বেহুলারে স্বপ্নে দেখার আগে সে ঢাকাতেই ছিল। টানা প্রায় চার কি ছয় মাস না আট মাস যেন। কোব্বাদ বা তার মা ভালো বলেতে পারবে। ফিরে এসে মান্নান অনেক্ষণ তিতাসের বুকে তৈরি করা বাঁধের মুখে বসে ছিল।

তখনও মান্নানরে কেউ পাত্তা দেয় নাই। সে ভালো মানুষ, মোটামুটি চলতে-ফিরতে পারে। তো সে ঢাকা থেকে ফিরে তিতাসের বুকে রাস্তা দেখে আর তার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বিচ্ছুর মতো শত-চাকার গাড়ি আর সেই গাড়িতে কি যায় তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাঁধের মুখেই সন্ধ্যা করে দেয়। কাজেও যায় না, নতুন কাজও খোঁজে না। কেমন করে, এমন করে সন্ধ্যা পার করে দেয়।

শেষ দিকে লাল সূর্য তিতাসের জেলে ঝিলিক দিলে তা মান্নানের মুখে এসে পড়ে। তাতে মনে হয় যেন সে কোথাও রঙ করে এল। সেই রঙ লেগে আছে মুখে। এমন করেই দিন কয়েক গেল। মান্নান এ সময়ে কথাও তেমন বলত না।

দুপুর গড়ায়ে গেলেও বাড়িতে ফিরত না। অমন নধর বৌটারে ধরেও দেখত না। কি হল মান্নানের কেউ বুঝতে পারে না। একদিন মান্নান, তখন সকাল আটটা এনকি দশটাও বাজতে পারে। সে মোমিনের দোকানে না ইলিয়াসের মোকামে গিয়ে কাল রাতে কি স্বপ্নে দেখেছে তা বলতে থাকে।

বিরক্ত মুখে ইলিয়াস বা মোমেন তার গল্প শুনে যায়। দ্বিতীয় দিনেও একই কথা। সেই এক স্বপ্ন। তৃতীয় দিন পার করে পঞ্চম এমনকি টানা সাত দিন সে রাতে একই স্বপ্ন দেখতে থাকে ও পরদিন যারে সামনে পায় তারেই তা বেলে যেতে থাকে। এতে করে আর সন্দেহ থাকে না যে মান্নান পাগল হয়ে গেছে।

কিন্তু পাগল হলে খালি একটাই স্বপ্নের কথা কেন বলবে। সারাদিন বাঁধের এপাড়-ওপাড় করে সে। কোনোদিন বাঁধের তলায় বালির বস্তা ধরে টানাটানিও করে। ঘুরাঘুরি করে। সাত দিন কি দশদিন পার হয়ে গেলে সে এবার বলতে থাকে সে রাত হলে বেহুলার কান্না শোনে।

এবেং লখিন্দরেকে আর বাঁচানো যাবে না বলে বেহুলা মাতম তোলে রাতভর। এক্ষণে মান্নানের পাগল হয়ে যাওয়া বিষয় সবাই নিশ্চিত হয়। এবং বেহুলার কান্না মান্নানের বৌয়ের চোখে ভর করে। কান্নাও যে ভুত হয় তা কি আর মান্নান বোঝে না, ফলে সে বউরে বেলে কান্দিস না, লখিন্দর মরত না। আমি বাঁধ কাটতে যাই।

তারপর বার দুয়েক কোদাল নিয়ে এসে বাঁধ কাটার চেষ্টা করতে গেলে কোনদিন কোব্বাদ কোনদিন নাদের কোনদিন ওয়াহাব তারে ধরে নিয়ে আসে। কোনদিন কাটতে-কাটতে সে নিজেই বেহুঁশ পড়ে থাকে। মান্নানের দশা খারাপই হতে থাকে। সে এরপর ভারত কোথায় তা বলে বলে বাজারময় ঘুরতে থাকে। এমন খুঁজতে খুঁজতেই সে একদিন বাঁধ ধরে কোথায় চলে যায় আর তারে খুঁজে পাওয়া যায় না।

মেলা দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। তার আশায় কোব্বাদের মা দিন-রাত গুজরান করে। মান্নান আর আসে না। কোব্বাদও রঙের কাজ শুরু করে। মান্নানের ছেলে বলেই সে কাজ পায়।

তার হাতও খারাপ না। রঙ করতে করতে জীবনের অনেক কিছু ভুলে যেতে হয় কোব্বাদকে। লাশটাই যত নষ্টের গোড়া। লাশ হয়ে মান্নান আবার ফিরে আসে। যে স্বপ্ন সবাই ভুলে গিয়েছিল তা আবার তাদের মনে পড়ে যায়।

কোব্বাদেরও। বাপের কুলখানি শেষ করে সেও একদিন সন্ধ্যাতক বাঁধের মুখে বসে থাকে। অনেকেই তারে নিষেধ করে। তাছাড়া মান্নান-তাড়িত বলে কেউ কেউ কোব্বাদরেই মান্নান ভাবে আর তা স্বাভাবিক বিবেচনা করে। কোব্বাদ সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থেকে ফিরে যায় বাড়িতে।

রাতে আর তাদের খাওয়া হয় না। যদিও এরা-তারা খাবার পাঠায়েছে। কিন্তু সে খাবার পড়েই থাকে। ক্লান্ত কোব্বাদ শুয়ে পড়লেই ঘুমায়ে যায় কিনা বুঝতে পারে না। সে বরং নিজেরে সেই বাঁধের পাড়েই দেখে আবার।

রোদ তখন জ্বল-জ্বল করতেছে। বাঁধের পাড়ে একদল মানুষ দাঁড়ায়ে আছে। সাবই চিল্লা-চিল্লি করতেছে। গম গম আবাজ উঠতেছে। কি হইল, কি হইল বইলা আরও মানুষ ছুটে আসতেছে।

বেহুলা আটকা পড়ছে বাঁধের কাছে এসে। লখিন্দর শুয়ে আছে। চাদর ঢাকা শরীরে কলার ভেলায় শুয়ে আছে সে। তার পায়ে সাপের দংশন। নীল হয়ে আছে পা।

ঠিক নীল ও না কালচে হয়ে যাচ্ছে। বেহুলা কত কি বলে কিছুই শোনা যায় না। তার রুক্ষ চুল, তার গায়ে সোনা-বরন শাড়ি। দুই হাত মেলে ধরে খুব জোরে নাড়ে। আর কি যেন বলে।

তার মুখ বাঁকা হয়ে আসে। কানলেই কেবল এমন চেহারা হয় মানুষের। বেহুলা আর লখিন্দরের আটকে যাওয়া ভেলা দেখতে দেখতে কোব্বাদ সে উপরে উঠতে থাকে। তার পায়ের নিচে মাটি নাই। বেহুলা আর লখিন্দর আর যারা তাদের দেখতে এসেছিল সবার কাছ থেকে উপরের দিকে উেঠে যেতে থাকে কোব্বাদ।

কোথায় উঠে তার ঘুম ভেঙে যায় সে বুঝতে পারে না। কিন্তু ঘুম ভাঙলে সে বুঝতে পারে এটা স্বপ্ন। পর দিন কাজে গেলেও এ স্বপ্ন সে ভোলে না। কাউরে বলেও না। তার মনে ভয় ঢুকে গেছে।

বাপের পরিণতি না তার হয়। তারও কি এমন ধারার মরণ হবে। সে কি পাগল হয়ে যাবে। কাজে ভুল হয়ে যায় কোব্বাদের। মালিক তারে ছুটি দেয় কয়েক দিনের জন্য।

বাপ-মরা ছেলে বলে হয়তো সুবিধা পায় কোব্বাদ। ঘরে ফিরলেও মায়ের সাথে তার কথা হয় না। মাও কেমন চুপ করে থাকে। মারে দেখতে বেহুলার মতো লাগে। কোব্বাদরে বার কয়েক খাইতে ডাকে।

কোব্বাদ খাইতে যায়। আবার ফিরে আসে। বাজারের দিকে ঘুরতে যায়। বাজারে সবাই কেমন তাকায় তার দিকে। সবার দিকে কোব্বাদ তাকায়।

এরাই ছিল তার স্বপ্নে। এদের সবাইরে সে দেখেছে। কোব্বাদ ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়। বাঁধের মুখে গিয়ে বসে থাকে। কেউ ফিরে যেতে বলে, কেউ মাথায় হাত বুলায়ে দিয়ে চলে যায়।

কেউ তার পাশেই বসে থাকে। বাঁধের মুখে বসে থাকা লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। কাজ ছেড়ে দিয়ে এরা কেউ কেউ সারাদিন বাঁধের পাশেই বসে থাকে। কোব্বাদ তাদের দেখে কি দেখে না। সে বাঁধের দিকে তাকায়ে থাকে।

এখানেই আটকা পড়েছে বেহুলার ভেলা। বাড়ি ফিরে গিয়ে আবারও তরে সেই স্বপ্ন দেখতে হয়। মালিকের কাছ থেকে আবারও ছুটি নিয়ে আসে সে। স্বপ্নটা দেখার জন্য কিছুটা নিরাপদ সময় চায় কোব্বাদ। একা থাকলে স্বপ্নটা জমে উঠবে বেলেই তার ধারণা।

ফলে বাড়ি ফিরে গিয়ে সে আবার শুয়ে পড়ে। রাতে সে কান্না শোনে। উঁ উঁ স্বরে সেই কান্না কোব্বাদের পৈঠায় বসে থাকে। দরজ খুলে বাইরে আসেলে সে বেহুলারে দেখে। বেহুলা কি বলে বুঝতে পারে না যদিও।

কিন্তু দুই হাত মেলে দিয়ে তার কান্না ঠিক কোব্বাদ শুনতে পায়। বেহুলারে দেখতে দেখতে আবারও আকাশের দিকে উঠতে থাকে কোব্বাদ। বেহুলা নিজের তলপেটে হাত বোলায়। তার ঋতুকাল বন্ধ হয়ে আছে। কেউ হয়তো পাশ থেকে বলে বা কোব্বাদ নিজেই নিজেরে বলে।

কোব্বাদের মতো আরও জনা কয় সে রাতে আকাশ ভ্রমণে যায়। তাদের চোখের সামনে বেহুলার উঁ উঁ কান্না চড়াই পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। বেহুলার তলপেটের বেদনা কুয়াশার মতো তাদের ঘাড়ে-গায়ে পড়তে থাকে। তারা আকাশে কতদূর উঠে গেলে দূরে বাঁধের গায়ে লখিন্দরকে দেখতে পায়। নিস্তেজ শুয়ে আছে সে।

আবছা ছায়া-ছায়া আঁধারে কোব্বাদরা মিশে যেতে থাকে। আকাশ থেকে নেমে আসে কখন তারা বুঝতে পারে না। কিন্তু পর দিন সূর্য উঠলে বাঁধের কাছ থেকে ঘুরে এসে কেউ কেউ কাজে যায়। কেউ আবার শরীর খারাপ বলে ঘরেই শুয়ে থাকে। কোব্বাদ কাজেই যায়।

আজ তার ছুটি শেষ হয়েছে। কাজে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও সারাদিন খাটতে হয়। গত রাতের স্বপ্ন সে ভুলেই গিয়েছিল। খালি যখন রঙ করতে শরু করেছে। তখন দেয়ালে সে বেহুলারে বসে থাকতে দেখে।

যতই রঙ করে কোব্বাদ বেহুলা ভেসে উঠতে থাকে। এতে মালিকের বকা শুনতে হয়। বাপের মতো পাগল হইবিনি, এমন খোঁটাও শুনতে হয়। শুনে শুনে নিজেকে আরও গুটিয়ে আনে কোব্বাদ। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে কখন নিজে বিছানায় শুতে পারবে সেই চিন্তায় সে নিজেকে গোপন করতে থাকে চরাচর থেকে।

বাড়ি ফিরে এসে কোব্বাদ আবার স্বপ্ন দেখে। আসলে কোব্বাদ আরাধনা করে সেই স্বপ্নের। বেহুলার প্রতি এ তার প্রেম না তার মুক্তি বেহুলাতেই কে জানে। এ স্বপ্নের ফজিলত জানতেও হয়তো কোব্বাদ বা তার গ্রামের কেউ কেউ শুয়ে পরে নিজেদের বিছানায়। রাতের ঘুমে বেহুলাই আসে, আজ তার অবস্থা আরও খারাপ।

আজ সে শুকিয়ে গেছে অনেক। আজ সে সারা গায়ে দারুন ব্যাথা জানিয়ে যায়। আজ তার কথা একটু বুঝতেও পারে কোব্বাদরা। বেহুলার উত্থিত আঙুল বাঁধের উল্টা পাশ দেখায়ে দেয়। মুক্তি চায় বেহুলা।

লখিন্দর যে মারা যাবে, আর টিকবে না। কি হবে বেহুলার। তার সারা শরীরে বাঁধের যন্ত্রণা ফুটে ওঠে। তার শরীরে কারা যেন বাঁধ বানায়ে দিছে, রক্তও বাধা খায় বাঁধের গায়ে। কি করে সে বাঁচাবে লখিন্দরকে।

বেহুলা যারা বাঁধ দিয়েছে তাদের কাছে যেতে চায় লখিন্দরকে নিয়ে, আজকের মধ্যেই, নইলে বাঁচবে না কেউ। স্বপ্ন দেখা শেষ হলে নিজেকে অনেক তাজা আর শরীরে শক্তি পায় কোব্বাদ। তার চোখে সূর্য জাগে, লাল সুর্য ভোর ফোটাতে থাকে কোব্বাদেও চোখ থেকে। সেই চোখে তিতাসের বুকের বাঁধ পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই দিকেই হাঁটা দেয় কোব্বাদ।

তার পেছনে আরও কে কে যেন বাঁধের দিকে এিগিয় যায়, ঘষা আঁধারে ঠিক বুঝতে পারা যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.