আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরকীয়া

অনার্সের পর যে এক বছর ঢাকায় ছিলাম তখন সেখানে সোহেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সোহেল হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার কাজ হচ্ছে খাল কেটে কুমির আনার মত নিজের ইচ্ছায় ঝামেলা ডেকে আনা এবং সেই ঝামেলার অর্ধ্যেকটা পাশের কারও ঘারে নিয়ে ফেলে ঝামেলায় অংশীদার করা। যে সময়ের কথা বলছি তখন এক সন্ধ্যায় সে নতুন এক ঝামেলা এনে অর্ধ্যেকটা আমার ঘারে ফেলল। সে খুবই সিরিয়াস চেহারায় আমাকে বলল,‘শোন, খবর পাইছস, রুবেল তো পালায় গেছে?’ ‘পালায় গেছে মানে?’ ‘ঐ যে একটা মেয়ের সাথে অর সম্পর্ক ছিল না? আজকা সকালে অর সাথে পালায় গেছে। ’ ‘বলছ কী!’ ‘বিকালে রুবেলের বাবা আসছিল।

আমারে খুইজা বাইর কইরা নিয়া মাজারের সামনে গিয়া কান্দাকাটি অবস্থা। রুবেল আমারে কিছু জানায় নাই। কল দিছিলাম, মোবাইল বন্ধ। ঐ মেয়ে তার ছোট দুই বাচ্চা সকালে ঘুমের মধ্যে রাইখাই পালাইছে। রুবেল যাওয়ার সময় টাকা, ঘরের সবার মোবাইল নিয়া গেছে।

’ ‘শোন, এগুলি খুবই ঝামেলার ব্যাপার। পুলিশ কেস-টেসও হয়ে যায় অনেক সময়। আমাদের কিছু করার নাই এখানে। দূরে থাকা ভাল। ’ ‘বন্ধু বলতে অয় শুধু আমাদের কাছেই আসত।

এখন বিপদের মধ্যে যদি আমরা না যাই তাইলে খুব খারাপ হয়। ’ সোহলের এই কথাটিতেই ফেঁসে গেলাম। যেখানে বন্ধুর বিপদের দোহাই সেখানে আর না করা যায় না। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তিনজনে মিলে নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে রুবেলের সাথে পরিচয়। রুবেল কাঠখোট্টা ধরনের ছেলে।

ওর তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। ওদের পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে বন্ধু বলতে আমরাই ছিলাম। ওর নানান গল্প গুজব হত। কিন্তু সে নিজে আমাকে কখনও সেই মেয়ের কথা বলে নি। আমি সোহলের কাছ থেকে কিছু কিছু শুনেছিলাম।

মেয়েটার সাথে সোহেলের কয়েকবার কথাও হয়েছে। একবার এবোরশান করানোর সময়ও সে সাথে ছিল। রামপুরায় রুবেলদের বাড়িতে গিয়ে দেখি মরা কান্নার আয়োজন বসেছে। ভাই-বোন, আশেপাশের আত্মীয়স্বজন যা আছে সব এসে ঘর ভর্তি হয়েছে। গ্রাম্য মহিলাদের মত রুবেলের মা এক তলা বাড়ির মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এই দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। ভিড়ের মধ্যে কালোর মধ্যে বল প্রিন্টের ফ্রক পড়া পুতুলের মত দুইটা বাচ্চা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। বড়টির বয়স আট-নয় হবে। দুজন অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছে।

কে একজন আমার কানের কাছে এসে বলল,‘এই দুই বাচ্চা ঐ মহিলার। ’ আমার ভিতরটা ধ্বক করে উঠল। রুবেলের মা কাঁদতে কাঁদতে আমার সামনে এসে বলল,‘বাবা তোমরা অর বন্ধু, আমার পোলারে আইন্যা দেও। তোমগো গোলাম হইয়া থাকমু। ’ আমি পুরো ঘটনা শুনলাম।

ঐ মহিলার শ্বশুড় বাড়ি রুবেলদের পাশের বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতে সেখানে মহিলা তার হাজবেন্ড আর দুই মেয়ে নিয়ে থাকে। হাজবেন্ডের কিছু সমস্যা আছে বলে সবার অনুমান। হয়ত দাম্পত্য জীবনে পরিপূর্ণভাবে ফিট ছিল না কিংবা ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। আর মহিলা না-কি দেখতে অনেক সুন্দর।

দুধের মত গায়ের রং। রুবেল তার মেয়েদের পড়ালেখার ব্যাপারে প্রায়ই তাদের বাসায় যেত। আর উদাসীন হাজবেন্ড প্রায়ই মাসের পর মাস থাকত চিল্লায় । এই সুযোগে ঘটতে শুরু করল পৃথিবীর আদিমতম সমস্যা(না-কি পাপ?)। রাতে ঐ মহিলার কাছে যাওয়ার সময় রুবেল একবার ধরাও খেয়েছিল।

পরে সেটা ধামচাপা দেওয়া হয়েছিল। আমি রুবেলের বাবাকে বললাম,‘এইসব ঘটনা আমি নিজেও জানতাম না। বাসা থেকে যাওয়ার পর সে আমাদের সাথেও যোগাযোগ করে নাই বা আগে কিছু বলেও নাই। দেখি, আমি বাইরে থেকে অন্য নাম্বার থেকে কল করে ওর সাথে যোগাযোগ করা যায় কি-না। যোগাযোগ হলে আপনাদের জানাব, ঠিক আছে?‘ বাইরে এসে সোহেলকে বললাম,‘বাচ্চা দুইটার জন্য এত খারাপ লাগছে।

চল দেখি ফোনে হারামজাদাকে পাওয়া যায় কিনা। ’ ফোন-ফ্যাক্সের দোকাল থেকে ফোন করতেই ফোন রিসিভ হল। ওপাশে কোন শব্দ নেই। আমি বললাম,‘ হ্যালো, রুবেল, আমি তাজুল। ’ ‘ কী?’ ‘ শোন, তুমি যে বাসা থেকে বের হয়ে গেছ, আমাকে কিংবা সোহেলকে তো কিছু জানাও নাই এই বিষয়ে।

এখন তোমার বাবা তো আমাদের নামে কেস করছে যে আমরা নাকি এই ঘটনার সাথে ছিলাম এবং বাসা থেকে মোবাইল, টাকা পয়সা সব নিয়ে গেছি। ’ ‘তোমগো নামে কেস করব কেন?’ ‘সেইটাই তো তোমারে বলার জন্য ফোন দিলাম। তুমি মিয়া ঘটনা ঘটাইলা এখন ঝামেলায় পড়লাম আমরা। ’ ‘কী কও তুমি। আইচ্ছা আমি দেখতাছি।

কালকে তোমারে ফোন দিব। ’ আমি খুব স্পষ্ট করেই রুবেলের সাথে মিথ্যা বলেছিলাম। জেনেশুনেই বলেছিলাম। বাচ্চা দুটিকে দেখে আমার এত খারাপ লেগেছিল যে সে সময় মনে হয়েছিল মিথ্যাাটা আমার বলা উচিত। যদিও মিথ্যা দিয়ে কখনও কোন সমাধান করা যায় না।

আমি পুরো ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম। রুবেল ‘মেয়ে’ বিষয়ে আনাড়ি। কখনও কোন মেয়ের সাথে ঠিকমত কথাও বলে নি। অন্যদিকে ঐ মহিলা তার হাজবেন্ড নিয়ে সন্তুষ্ট না। দুইটা বাচ্চা হয়ে গেছে।

এভাবে চলতে থাকলে ঢালে-খালেই তার জীবন পড়ে থাকবে। সে এখন মরিয়া। রুবেলকে কব্জা করে সে এখন যে কোন কিছুই করতে পারে। কোন পরোয়া নেই। আর রুবেলের ভাবনাটা হচ্ছে যে দুনিয়ায় কোন মেয়ে তার দিকে তাকাল না আর সে তার জন্য এত কিছু দিয়ে দিচ্ছে? এরকম মেয়ে সে জীবনেও পাবে না।

রুবেল পালিয়েছে একদিন হয়ে গেছে। ঘটনাটি এখনও চারদিকে পুরোপুরি জানজানি হয় নি। এভাবে বেশিদিন বাইরে থাকার সামর্থ রুবেলের নেই। সে বাড়ি ফিরবেই। ততদিনে কেলেংকারি যা হওয়ার হয়ে যাবে।

ঘটনা প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগেই যদি শেষ করা যায় তাহলে রুবেল নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবার সুযোগ পাবে। মেয়ে দুটি তাদের মাকে ফেরত পাবে। চারজনের মধ্যে তিনজনের হয়তবা কোন গতি হবে। আর, একজনের গতি আমার জানা নেই। সব জানার পর রুবেলের পরিবারের সবাই আমার হাতে-পায়ে এসে পড়ল।

যেন আমিই পারি সব সমাধান করতে। আমি বললাম,‘ঠিক আছে। ’ নিজের অজান্তেই ঘটনার লিড এসে পড়ল আমার কাছে। ওদের হোমড়া-চোমড়া আত্মীস্বজন সব তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সূক্ষ্ম একটা প্ল্যান তৈরী করলাম।

সত্যের সাথে মিথ্যাকে এমন ভাবে মেশানো হল যে কোন কিছুতেই সন্দেহ তৈরী হওয়ার সুযোগ নেই। ঘটনা ঘটল সেভাবেই। আমি রুবেলকে ফোন করে বললাম,‘শোন, তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে। আমার আর সোহেলের কেস তুলে নিবে। কিন্তু তোমাকে কখনওই মেনে নেবে না।

’ ‘জানি। ’ ‘কিন্তু তুমি বাইরে বাইরে এইভাবে বেশিদিন থাকতে পারবা না। শেষে তোমার বড় ভাইকে বুঝিয়েছি। অনেক বলার পর তোমার বলেছে যে যেহেতু তোমরা ভুল করেই ফেলেছ, সমাধান তো করতেই হবে। কাউকে না জানিয়ে তোমার ভাই ঢাকায় তোমাদের থাকার একটা জায়গা করে দিবে , তোমাকে কোন কাজ দেয়ার চেষ্টা করবে।

কিন্তু এই তোমার বাবা বা ঘরের অন্য কাউকে জানানো যাবে না। তোমার বাবা এটা কখনওই মানবে না। ’ ‘বড় ভাই এইটা বলছে। ’ ‘অনেক কষ্টে তাকে বোঝানো হয়েছে। ’ মাঝখান থেকে ফোন নিয়ে রুবেলের পাশ থেকে এক মহিলা কণ্ঠ বলল,‘ ভাই, আপনে সত্য বলতেছেন?’ আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম,‘আপনাদের জন্য অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

’ তৃতীয় দিন। রবেল বলেছিল সকাল নয়টার দিকে বাস স্ট্যন্ডে থাকবে। আমি আর সোহেল সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। দৃশ্যতঃ আমাদের সাথে আর কেউ নেই। কিন্তু আড়ালে অনেক লোকজন গা ঢাকা দিয়ে আছে।

রুবেলদের হোমরা-চোমরা কিছু আত্মীয়স্বজন একটা ইয়ালো ক্যাব নিয়ে রেডি আছে। কিছুক্ষণ পর সোহেল আমাকে বলল,‘ঐ যে ওরা, রিক্সার মধ্যে। ’ আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি রুবেল রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসা, চোখ-মুখ শুকনো। পাশে বোরকা পড়া একজন। তার শুধু চোখ দেখা যাচেছ।

ফর্সা পা, পায়ে স্যান্ডেল। রুবেল বলল,‘ বড় ভাই কই?’ এরপর আর কোন কথার চান্স ছিল না। লোকজন সব বেড়িয়ে এসে রিক্সা ঘিরে দাড়াল। একজন রুবেলকে রিক্সা থেকে নামিয়ে হাত চেপে ধরল। মহিলাটি বলল,‘ভাই, তারে কিছু বইলেন না।

দোষ...। ’ কথা শেষ করার আগেই সম্ভবত মেয়েটির ভাসুর এসে একটা চড় দিয়ে বলল,‘তুই বাড়িতে চল, তোর দোষ দেখামু। ’ তাদের দুজনকে ট্যাক্সি ক্যাবে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। রুবেল তখন মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া বাঘের মত ক্ষিপ্ত। তার হিতাহিত জ্ঞান নেই।

যে কোন বিষয়ে আমার মধ্যে পজেটিভ, নেগেটিভ দুই ভাবনাই চলে আসে। একবার ভাললাম,ও এখন যে অবস্থায় আছে শেষে আমাদেরই না শত্রু ভেবে বসে। যে চায়ের দোকানে বসে টাইম পাস করি সেই দোকানদার বলল,‘আপনারা দুইজন একটা জিডি কইরা রাখেন। ’ আমি রুবেলের বাবার সাথেও আলাপ করলাম। আলাপ করে দেখলাম যে, যা-ই হোক এই কাজটা সে করবে না।

কামনায় মানুষ কিভাবে অন্ধ হয় সেটা আমি কাছ থেকে দেখলাম। কয়েকদিন পরে আমি রুবেলকে বললাম,‘শোন, কোন কিছুতে সুখ পেলে সেটা অবশ্যই আমরা নিব। কিন্তু সেই সুখ নিতে গিয়ে যদি অন্যদেরকে বেশি দুঃখের মধ্যে ফেলে দিই তাহলে সেই সুখ আমাদের নেয়া উচিত না। তুমি ঐ মেয়ের দুই বাচ্চার কথা ভাবছ? তোমার বাবা-মায়ের অপমানের কথা? ঐ মেয়ে কি তোমার বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি?’ ‘আমার বাবা-মায়ের দরকার নাই। মনিকে দরকার।

তোমরা আমার জীবনে এত বড় ক্ষতি করলা?‘ আমি মাথা নাড়ালাম,‘তুমি আছ ঘোরের মধ্যে। এখন বুঝবা না, এক সময় সব কিছু স্পষ্ট হবে। ‘ রুবেলের সাথে এর পর আর তেমন কোন যোগাযোগ হয় নি। তার ঘোর কেটে সবকিছু স্পষ্ট হয়েছে কি না কে জানে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।