আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি!
প্রতিটা মানুষের জীবন চলার বাকে অনেক গল্প থাকে। কতক গল্প লোকচক্ষুর অন্তরালে মনের কোণে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় ঘুমন্ত থাকে। কতক হয় পরিব্যাপ্ত। খুব বেশী আনন্দ আর কষ্টের গল্পগুলো ঘুরেফিরে আসে পূণ:পূণ:।
আমাকে গল্প বলতে অনুরোধ করলে একটি গল্পই বলবো।
নির্জলার গল্প। আসলে নির্জলা মানেই এক জীবনে অসংখ্য গল্পের সমষ্টি। তাকে নিয়েই আমার গল্পগুলো সৃষ্টি। কদাচিত অন্য গল্পের আবির্ভাব হলে অনতিকাল বিলম্বে নির্জলার গল্প এসে ভর করে। সমূলে উৎপাটিত হয় নতুন গল্প।
এক জীবনে কতগুলো গৎবাধা গল্পের বিপুল সমারোহ হয়েছে। আনন্দ বেদনার সম্মিলনে সেই গল্পগুলো ডালপালা ছড়িয়েছে কালে কালে।
--------------------------------------------------------------------------
নির্জলা আমার পড়শী ছিল। শিমুলের কাটায় কাটায় যেমন একটা সারিবদ্ধ সম্পর্ক থাকে। সেই হিসেব কষলে গাছের গোড়ার কাটাটা ডাল অব্দি বিস্তৃত শেষ কাটাটারো আত্মীয়।
এরকম দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল তার সাথে। তাই তার সাথে প্রথম যৌবনে পরিচিত হতে হয়নি। শৈশবকাল থেকেই আমরা হাস্যখেলাচ্ছলে পরস্পর পরিচিত হয়েছি। চিনেছি জেনেছি একে অপরকে। কখনো ঘাস ফড়িং ধরার প্রতিযোগীতায় মেতে উঠতাম আমরা।
প্রজাপতি তাড়াতাম ফুলে ফুলে। কখনো আমার ঘুড়ি উড়ানোর সহচর হিসেবে তাকে পেয়েছি।
----------------------------------------------------------------------------
কালের পরিক্রমায় ঘুড়ি ওড়ানোর দিন শেষ হলো। শুরু হলো নতুন জীবন। স্কুল জীবনের শেষ দিকে এসে ঘরকুনো হয়ে পড়লাম।
উজ্জ্বল উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত দিনগুলো মলাটবন্দী হলো। মনের কোণে বন্ধী হলো নির্জলার আয়ত মূখখানি। পড়াশুনার ফাঁকে অবসরে খাতার কোণায় আঁকাআঁকির অভ্যেস গড়ে উঠেছে। সেই সব আঁকাআঁকিতে এক কিশোরীর মুখশ্রী বারবার ফুটে উঠতো। সে যেন প্রাণবন্ত্য হয়ে আমার সাথে হাসছে, টিপ্পনি কাটছে তরবারী সদৃশ ভ্রু কুচকে।
তার ঠোটের কোণের তিলকও যেন হাসছে সেই সাথে। কখনো নদীতীরে কাশবনে, কখনো অশ্বত্থ তলে সুশীতল বাতাসের প্রবাহে তার সাথে কথা হতো। বাস্তবে মুখচোরা স্বভাব হেতু কোনদিন মুখফুটে বলা হলো না। নির্জলা তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
----------------------------------------------------------------------------
স্কুল জীবন শেষ হলো।
জীবনের শ্রীবৃদ্ধির জন্য, পড়াশুনার জন্য গ্রামের পাঠ চুকিয়ে নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মন পড়ে রইলো সেই গ্রামীণ পটেই। যে পটে পুরনো দৃশ্যগুলো আঁকা। পড়াশুনার ফাঁকে, নতুন বন্ধুদের আড্ডায় সবাই যখন তুখোড় দিন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ আড্ডার মধ্যমনি হয়ে চরম আনন্দ বিলি করছো।
অথচ আমি ঠিক মনোনিবেশ করতে পারছি না। মনের মধ্যে চোখের বালির ন্যায় খচখচ করছে নির্জলা। ইচ্ছে করে বারবার ছুটে যাই। গিয়ে না বলা কথাটা বলে ফেলি। না বলা কথা আর বলা হয়ে উঠে না।
---------------------------------------------------------------------------
অনেক দ্রুতলয়ে কলেজ জীবনটা শেষ হয়ে যায়। স্কুলের সাথে কলেজের ফলাফলে তেমন তারতম্য হয়না। একটা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। বিভিন্ন জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামরক্ষাকারী ছাত্রদের সমিল হতে পারিনা। পড়াশুনায় ব্যত্যয় ঘটতে থাকে।
কোনক্রমে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্ঠা করি। ততদিনে তুখোড় আড্ডাবাজে পরিণত হয়েছি। কিছু খোলামেলা অকপট বন্ধুর কল্যাণে সময়গুলো সুন্দর কাটতে থাকলো। পুরাতনকে ভুলতে থাকলাম ক্রমশ। মনের কোণে যে ছবিটা ছিল।
যে ইচ্ছেটা ছিল। সেটা দূরীভূত হতে থাকে আস্তে আস্তে। সময় মানুষকে যেন অচিন নক্ষত্রে পরিণত করে। দীর্ঘদিন যোগাযোগবিহীন আর সাক্ষাতহীনতায় নিজের পরম আত্মীয় যেন দূরের অচেনা মানুষে পরিণত হয়। নির্জলার ক্ষেত্রে তাই হলো।
----------------------------------------------------------------------------
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে কয়েক বছর হলো একটা চাকুরীতে যোগদান করেছি। দুর্মূল্যের এই বাজারে আমার কোন উচ্চ স্বপ্ন নেই। শুধু দু'মুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচা দরকার। জীবনকে জীবনের হাতে সপে দিয়েছি। নদীর স্রোতে যেমন পালতোলা নৌকা চলে।
এই চাকুরী দিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন প্রবাহে চলতে পারবো। তবে একজন মানবী জুটলে সেই নৌকায় উপযুক্ত বায়ুপ্রবাহ হিসেবে কাজ করবে কিনা চিন্তার বিষয়। এই ভাবনায় কয়েক বছর বিরতি দিলাম। কিন্তু পারিবারিক চাপে আর সামাজিকতা রক্ষার কবলে পড়ে এক সময় সৃষ্টিকর্তার হাতে কলকাঠি তুলে দিলাম। তিনি নিশ্চিতে কলকাঠি নাড়লেন।
বিনিময়ে একজন সুদৃশ্য রমনী জুটলো। যার চাওয়া পাওয়াগুলো নিতান্তই ছোটখাটো। আমার সাথে হুবহু মিলে যেতে থাকলো। সংসারে তার আগমনে তেমন একটা উৎপাত মনে হলো না। সুন্দর ছিমছামভাবে কেটে যেতে থাকলো আমাদের দিনগুলো।
কিন্তু বিধি বাধ সাধলো এক জায়গায়। আমাদের সংসারে ছোট্ট ফুটফুটে একটা বাচ্চার অভাব অনুভব করতে থাকলাম প্রকটভাবে। সেটা দিন দিন ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো।
----------------------------------------------------------------------------
ঈদ উৎসব উৎযাপন উপলক্ষ্যে কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ভাই ভগিনী এবং তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে বেশ আনন্দে দিনগুলো কেটে গেল।
সবার সাথে একান্ত আলাপের শেষটুকুর সমাপ্তি হয় আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। বিয়েটা যখন বিধি প্রদত্ত পুরস্কার হিসেবে মেনে নিয়েছি। সন্তানটাও তার মর্জিতেই আমাদের কোলজুড়ে আসবে এরকম একটা সুর টেনে আমাদের গল্পগুলো শেষ হতো। আমার স্ত্রীর অক্ষমতাটুকু ঢেকে রাখার প্রাণপণ চেষ্ঠা করতাম। কিন্তু একদিন সেটা দিবালোকের মত প্রকাশিত হলো।
সেটা এক দূর সম্পর্কের অভিসন্ধিৎসু আত্মীয়ার মাধ্যমে। এরপর সমস্ত দায়ভার গিয়ে আমার স্ত্রীর কাঁধে পড়ছে আর সে ক্রমশ ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। এবারের উৎসব অনেকটা মাঠে মারা গেল।
মা এবং নিকটাত্মীয়রা যদি মন খারাপ না করতো এই ঝক্কিঝামেলা ঠেলে বাড়িতে যাওয়া হতো না। এত ঝামেলা শেষে বাড়িতে পৌঁছে শেষে এক আকাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরে আসাটা নিশ্চয়ই বেদনাবিধূর।
----------------------------------------------------------------------------
অফিস ছুটির দিনগুলো ফুরিয়ে এলে জীবিকার সন্ধানে আবারো ব্যস্ততম নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। কয়েক শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে একটা লক্কর ঝক্কর বাসে। এই কথা ভেবেই মনটা ত্যক্ত বিষাক্ত হয়ে উঠলো। এই ঈদ পার্বনে ট্রেনের টিকেট প্রাপ্তি এক সপ্তাচার্য। তাই বাধ্য হয়ে এই পথই বেচে নেয়া।
ট্রেন হলে একটা গল্প বা কবিতার বই নিয়ে আশেপাশের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে স্নিগ্ধ রোদের দোলা দেখতে দেখতে যাওয়া যেত। বাসে হওয়ায় শত ঝাকিঝুকি এড়িয়ে একটা খবরের কাগজের অর্ধেকের বেশী পড়ার জো নেই।
-------------------------------------------------------------------------
কিন্তু সকল দূরাশা দূরে ঢেলে আমাদের বিনোদনের জন্য, যেন এক পিচ্চি পরীর আবির্ভাব ঘটলো আমাদের বাসে। এসেই জুড়ে বসলো আমাদের সন্মুখের সিটের বাম পাশটায়। আমার বামপাশের সিটে আসীন আমার স্ত্রী সপ্রতিভ নড়েচড়ে বসলো।
পরীর পিঠ অবধি বিস্তৃত চুল। বয়স আনুমানিক পাঁচ বছর। উচ্ছ্বল উজ্জল দুষ্টুমী ভরা মুখ। চঞ্চলতা ঘেরা তার সমস্ত মুখাবয়বে।
পরীঃ আমার সীটটা এত সোজা কেন? এই আঙ্কেল আমার সীটটা ঠিক করে দেননা?
টিকেট চেকিংয়ে ব্যস্ত বাসের সুপারভাইজার ত্বড়িত হাজির হলো।
সীটটা পেছনের দিকে বাকিয়ে দিলে সে আরামসে ছোট্ট ক্ষুদে শরীরটা এলিয়ে দিলো।
পরীঃ ধন্যবাদ আঙ্কেল। আচ্ছা সবাই বসে আছে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
সুপারভাইজারঃ আমার দাঁড়িয়ে থাকার কাজ যে।
পরীঃ কেন? আপনি টিকেট কাটেন নি বুঝি?
সুপারভাইজারঃ আমার তো টিকেট লাগেনা।
পরীঃ ও ও ও! এই জন্যই বুঝি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
এরপর কথা না বাড়িয়ে সুপারভাইজার টিকেট চেকিংয়ের কাজে লেগে গেল।
পরীঃ আম্মু আমার খুব গরম লাগছে। জানালাটা খুলে দিবো?
তার আম্মু সম্মতিজ্ঞাপক মাথা নাড়ালে জানালা পুরোটাই খুলে দিলো। শীতের ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় আমরা কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম। পিচ্চি পরীর সার্বিক যাত্রায় কোন রকম ব্যঘাত যাতে না ঘটে এজন্য নির্বিকারভাবে বসে রইলাম।
শীতের বাতাসের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করে আমরা অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়েছি। বাস যাত্রীরা দৈনন্দিন কথাবার্তার অনেকখানি সমাপন করেছেন। সবার মাঝে এখন ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে। আমিও সীটে মাথা এলিয়ে ঘুমানোর পায়তারা করছি। এমন সময় ড্রাইভার হার্ডব্রেক কষলো।
ঝিমুনি ভাবটা অকস্মাৎ চলে গেল।
পরীঃ আমার সিটটা আপনি সোজা করে দিয়েছেন?
পেছনের সীটে আসীন আমার স্ত্রী সানন্দা নড়েচড়ে বসলো।
---নাতো মা। আমি সোজা করিনি। একা একাই সোজা হয়ে গেছে।
সানন্দাকে পরবর্তী প্রশ্নবানের আগেই সীটটা বাকা করে দিলাম। একটু পর বিরক্তির ভঙ্গি নিয়ে---
পরীঃ গরম লাগছে আমার। কেউ জানালা খুলে দাও। জানালা খুলে দাও।
গতি জড়তার পরিবর্তনে বন্ধ হয়ে যাওয়া জানালা নিয়েও সে সংশয় প্রকাশ করলো।
নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীর কাজ। সানন্দা জানালা খোলায় সহায়তা করলে পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্বে আসলো। এবার সীটে গা এলিয়ে দিয়ে সে হেরে গলায় গান ধরলো:
আমাদের দেশটা স্বপ্নপূরী
সাথী মোদের লাল পরী
লাল পরী নীল পরী---
একই অন্তরা কয়েকবার গাওয়ার পর গান গাওয়ায় ইসতফা দিলো। এবার ছড়া পাঠ শুরু হলো---টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটিল ষ্টার। ছড়াটা শেষ না হতেই তার আম্মুর হাত থেকে স্মার্ট মোবাইল ফোনটা টেনে নিলো।
মনের আনন্দে আঁকিবুকি শুরু করলো। কিছুক্ষণ আঁকিবুকি করে তার প্রতিভার পরিচয় আমাদের সন্মুখে পেশ করলো। সে একটা বিড়ালের ছবি এঁকেছে। আঁকার হাত অনেক পাকাপোক্ত বলা চলে। বয়সের তুলনায় যথেষ্ঠ পরিপক্ক তার হাত।
এরপর ব্যস্ততার সাথে মোবাইলটা কানে দিয়ে---
পরীঃ হ্যালো আব্বু! তুমি কেমন আছো। দেশে কবে আসবা? এবার আসার সময় আমার জন্য নতুন কালার পেন্সিল বক্স নিয়ে আসবা। তুমি তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু। আমাদের বাসার পুশিক্যাটটা ভালো আছে। জানো--- ও! ও না এখন ভীষন দুষ্টু হয়েছে।
যখন তখন সোফার ওপর শুয়ে ঘুমায়। আমার বিছানায় মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে। আব্বু তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আম্মু বলেছে, আমি বড় হলে নাকি তুমি দেশে আসবে। তখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে ঘুরবে।
আব্বু আমি আর কত বড় হলে তুমি আসবে। এবার আসলে তোমাকে আর কোথাও যেতে দেবো না। তুমি সব সময় আমার কাছে থাকবে। আম্মু আমার জন্য চকোলেট আনতে গিয়ে সারাদিন বাসার বাইরে থাকে। ওকে তুমি বকে দিবে।
মৌসুমী, একদিন আমার পুষিক্যাটকে অনেক মেরেছে। ওকেও বকে দিবে কিন্তু---
তার মোবাইল আলাপন শেষ না হতেই সামনের সিটে বসা দম্পতির প্রায় ছয় মাস বয়সী বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো।
পরীঃ ও কাঁদছে কেন? আন্টি আমার কোলে দিনতো। দেখবেন এখনি চুপ করবে।
মা কিছুটা ইতস্তত করতে করতে তার কোলে বাচ্চাটা দিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণ এটা ওটা সেটা বলে তার কান্না থামালো। শিশুটিও বেশ মজা পেল। খিলখিল ধ্বনিতে হাসা শুরু করেছে। তাকে নিয়ে খেলাধূলা শেষ হলে তার মায়ের কোলে গুজে দিয়ে ডানপাশের সিটে চলে গেল। সেখানে তার আত্মীয়া সম্পর্কীয় বয়স্ক মহিলা তার জন্য নুডুলস নিয়ে বসে আছেন।
পুরো রাস্তায় কথা বলে ক্ষিধেটা হয়ত একটু বেশী লেগেছে। গপাগপ নুডুলস খেয়ে ফেলে একটা চকোলেট হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ তাকাতে থাকলো।
সুপারভাইজার এসে চকোলেটের দাবী করলে প্রথমে না বললো।
সুপারভাইজারঃ তুমি চকোলেট না দিলে তোমাকে আর আমাদের গাড়ীতে নিবোনা। তুমি পরেরবার কেমন করে আসবে?
পরীঃ সত্যি নিবেন না?
এই বলে কান্নার প্রস্তুতি হিসেবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোট বিকৃত করলো।
চকোলেট এগিয়ে দিলো সুপারভাইজারের দিকে। সুপারভাইজার রসিকতা যথেষ্ট হয়েছে মনে করে তাকে পরবর্তীতে বাসে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
পরীঃ আম্মু আমি যদি এখানে ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে কি তুমি কান্না করবে।
তার আম্মুর কাছে যথার্থ কোন উত্তর না পেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক।
পরীঃ আপনাদের দু'জনকে খুব সুন্দর লাগছে।
আমরা দু'জন সমস্বরে থ্যাঙ্কু বললাম। জবাবে সে ওয়েলকাম জানালো।
আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেছি। তার নামটি জিজ্ঞেস করা হয়নি। পুরো রাস্তায় যে মেয়েটির সাহচর্চে কেটে গেল, যার কর্মকান্ড দেখে চোখ জুড়ালো তার নামটি পর্যন্ত জানা হলো না।
শেষে না জিজ্ঞেস করে নামতে পারলাম না।
তোমার নাম কি?
পরীঃ জান্নাতুল ফেরদৌস জাহিন
জাহিন! নামটা শুনেই আমাদের দু'জনের চোখাচোখি হলো নিমিষে। ঠিক এই নামটিই আমাদের মেয়ে সন্তানের জন্য ঠিক করে রেখেছি।
অপরিচিত কোন নারীর দিকে স্বেচ্ছায় চোখ তুলে তাকানোয় একটা জড়তা কাজ করে। এই বয়সে এসেও এই জড়তাটাকে উপেক্ষা করতে পারিনি।
তারপরও সমস্ত অসারতা ঢেলে পুরো রাস্তায় নীরব নিথর জাহিনের মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো। এ কি! নির্জলা! আমি সত্যি দেখছি তো! তার চেহারায় প্রকট ক্লান্তির ছাপ। চোখের নীচে কালিরেখা। কোথায় সেই নিটোল অধর! কোথায় সেই জৌলুসময় চেহারা! কেমন আছো? এই প্রশ্নটিও করার সময় হলো না। কিংবা বাস থেকে নামার তাড়ায় আর দশ বছর যোগাযোগহীনতায় নতুন করে এই নিষ্ঠুর প্রশ্নটা করাও হলো না।
বাস থেকে নামতে নামতে একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হায় সময়---
---------------------------------------------------------------------------
বাস থেকে নেমে বাড়তি পথটুকু রিকসা যোগে যাত্রা শুরু করলাম। সানন্দার চোখে জল টলমল করছে। বাসের মধ্যেই জাহিন নামটা শোনার পরপরই চোখের কোণ ছাপিয়ে জল এসেছিল। সেটা লোকচক্ষুর অন্তরাল করার চেষ্ঠা করেও ব্যর্থ হয়েছে সে।
আমি নিজেকেও প্রবোধ দিতে পারিনি সেই সময়। মানব জীবনে কিছু দুঃখের সময় আসে যখন চোখের জল ছাড়া আর কিছুই প্রবোধ দিতে পারেনা। চোখের জল দ্বারাই বেদনার ভার লাঘব। মানব সমাজে সে এক বিস্ময়কর উপায়।
----------------------------------------------------------------------------
রিকসা বড় রাস্তা ধরে নগরীর শেষ প্রান্ত বরাবর সম্ভুক গতিতে চলছে।
বাম পাশে অতি অনাদরে বয়ে চলা শীতের জীর্ণ হাটু পানির শহুরে নদী। এইতো আগামী বর্ষাতেই জলে থৈথে করবে। তখন বর্ষার পুরো আকাশটা একত্রে উঁকি দিতে পারবে এই নদীতেই। নদীর স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে। পূর্ণিমার চাঁদ আর ঐ আকাশের মিটিমিটি জ্বলা সব তারা হাসবে তার জলে।
চোখে একটা দৃশ্য ভাসছে। এক পূর্ণিমার রাতে ডিঙ্গি নৌকা ভাসিয়ে সানন্দার সঙ্গে নদীবক্ষে ঘুরছি। চাঁদের আলো মাছের আঁশে চকচক করছে। আকাশের সব তারা হাসছে আর নদীর জলে স্নান করছে। আমরাও জ্যোৎস্না স্নান শেষে ভোর পাখিদের ডাকে শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে ঘরে ফিরে আসছি।
----------------------------------------------------------------------------
বড় রাস্তা ছেড়ে আমাদের গলিটা ছাড়িয়ে রিকসা চৌরাস্তায় এসে পড়েছে। সানন্দা এবং আমি কেউই খেয়াল করিনি। রিকসাওয়ালা বললো কোন দিকে যাবো এখন? বললাম আমাদের বাসার গলি তো ছেড়ে এসেছো। কি আর করা! সামনেই যাও, কষ্ট করে পিছনে যাওয়ার কি দরকার? আর্ট গ্যালারীতে চলো।
বেশ কিছুদিন ধরে খবরের কাগজে একটা মনকারা বিজ্ঞাপন দেখছি।
আগামী ২৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হবে। ২৮ ডিসেম্বর প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকর আরিফ মাসুদের "তারপরও স্বপ্ন এবং বেঁচে থাকা" ছবিটি প্রদর্শিত হবে। দুটো অগ্রিম টিকেট কেটে বাসায় রওয়ানা দিলাম।
ছবিঃ নিজস্ব এ্যালবাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।